বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে জনসমবায়ের নারীরা অবদান রাখছে। শুক্রবার (২২ মার্চ) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সিবিসিবি সেন্টারে ক্ষুদ্র কৃষক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে জনসমবায়ের ভূমিকা ও গুরুত্ব শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এ কথা বলেছেন আলোচকরা।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-র উদ্যোগে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন- সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান, বিএলআরআই-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (ফার্মিং সিস্টেম ব্যবস্থাপনা) ড. রেজিয়া খাতুন এবং বিএআরআইর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গবেষক ড. নাজিম উদ্দীন।
এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় আরও বক্তব্য রাখেন- সহযোগী সংস্থা রুলফাও’র নির্বাহী প্রধান আফজাল হোসেন, বিএফএফ’র নির্বাহী প্রধান আ ন ম ফজলুল হাদি সাব্বির, ডব্লিউসিডিবি’র নির্বাহী প্রধান সন্ধ্যা মালো, তৃণমূল জনসমবায় দলের নেত্রী শরীফা আক্তার নিপা এবং মমতাজ বেগম।
তার আগে এএলআরডি’র চলমান কার্যক্রম সমবায়ভিত্তিক জনসমবায় দলের পরিবর্তনে কেমন প্রভাব ফেলছে তা টেকসই উন্নয়ন মূল্যায়ন কাঠামোর আলোকে নিরূপণ করার জন্য একটি প্রশ্নপত্র সমীক্ষা করা হয়েছে। তার ভিত্তিতে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুবিনুর রহমান।
এ সময় তিনি সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করে বলেন, জনসমবায়ের দলীয় সদস্যদের সামাজিক মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে ও নিজেস্ব উদ্যোগে সামাজিক পুঁজি গঠন বৃদ্ধি পাচ্ছে, জৈব কৃষির প্রচলন বেড়েছে এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া নারীর ভূমি মালিকানা ও উত্তরাধিকার বিষয়ে সচেতনতাসহ প্রবেশাধিকার ঘটছে। তবে ভূমিস্বত্ব সংরক্ষণে খাজনা, খারিজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরে তিনি একটি সুপারিশমালা তুলে ধরেন।
প্যানেল আলোচনায় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রেজিয়া খাতুন বলেন, সরকারি কৃষি সম্প্রসারণ থেকে যে কৃষিকার্ড দেওয়া হয়, সেটি সম্পর্কে আরও একটু জেনে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণের জন্য কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চল ভেড়া চাষ করার উপযোগী। সেখানে যদি কোনো জনসমবায় দলের সদস্যরা যৌথভাবে এটি করতে চায় তাহলে রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসের সাথে লিংক করিয়ে দেওয়া হবে। তাছাড়া খড়াপ্রবণ এলাকায় ঘাস চাষ করার ব্যাপারেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, ফরিদপুর নিচু জায়গা বলে সেখানে রুপালি নাগেশ্বরী হাঁসের চাষ ভালো হয়। যদি এ অঞ্চলে জনসমবায় দল হাঁস চাষ করতে চায়, সেক্ষেত্রে বিএলআরআই’র ভাঙ্গার অফিস থেকে সেবা দেওয়া সম্ভব। তাছাড়া বাজারের বিষয়ে বলেন, বিএলআরআইর নিজস্ব অ্যাপস রয়েছে যা ব্যবহার করে বাজারকে সম্প্রসারণ করা যাবে।
আবু সাঈদ খান বলেন, সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে জনসমবায় একটি ভালো পন্থা। এর মাধ্যমে উৎপাদন যেমন বাড়ানো যায় তেমনি ঔক্যবদ্ধভাবে এলাকার নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব। সরকারি সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। সমবায়ের মাধ্যমে পুঁজি সঞ্চয় করা এবং রাষ্ট্র থেকেও পুঁজি গ্রহণ করা যাবে। তবে আপনাদের অনেক দূর যেতে হবে। একটি নেটওয়ার্ক দরকার, এ কাজটিকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে এর সাথে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানুষকে দরকার। সমমনা মানুষের সাথে আরও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাছাড়া আইন ও কাঠামোর পরিবর্তন করা দরকার।
তিনি দলগুলোকে বলেন, শিক্ষা তহবিল বা কল্যাণ তহবিল করতে পারেন। যার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে সমবায় একটি শক্তি। এর মাধ্যমে ন্যায্য পাওনা আদায় করা সম্ভব।
ড. নাজিব উদ্দিন বলেন, বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র কৃষকের একটি সংজ্ঞা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২ হেক্টরের নিচে যাদের জমি তাকে ক্ষুদ্র কৃষক হিসাবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কৃষকের দেশ। মুষ্টিচাল দিয়ে পুঁজি গঠন মেলবন্ধকে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু টাকা তা পারে না। জনসমবায়ের ধারণা কিন্তু যুগান্তকারী। ডেল্টা পরিকল্পনায় কৃষিকে বাণিজ্যিককরণ করা হয়েছে। এতে ক্ষুদ্র কৃষকদের অবস্থা আরও সংকটময় করবে আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে আপনারা যে জনসমবায় গঠন করে যৌথভাবে কাজ করছেন এটি এ জন্যই যুগান্তকারী।
আইনুন নাহার লিপি বলেন, নারীর ভূমির অধিকার একটি বড় সমস্যা। তবে সবাই মিলে কথা বললে এ সমস্যাগুলোর সামধান করা সম্ভব।
এতে আফজাল হোসেন বরেন্দ্র অঞ্চলের সমস্যাগুলো তুলে ধরে আদিবাসীদের ভূমির মালিকানার সমস্যা তুলে ধরেন। তবে জনসমবায়ের মাধ্যমে তাদের মালিকানার জায়গাতে কাজ করা হচ্ছে। এ দলের নারীরা যৌথ উদ্যোগে গবাদি প্রাণী লালন পালন এবং স্থানীয় পুকুর লিজ নিয়ে মাছচাষ করছে। তারা গবাদি প্রাণীদের স্বাস্থ্য বিষয়ে টিকা দানে দক্ষ হয়েছে এবং টিকাদান কর্মসূচি দিচ্ছেন। তবে সরকারি প্রণোদনার জায়গাটিতে তাদের অধিকার ক্ষীণ। তাদের জমির খাজনা-খারিজের জন্য ডিজিটাল সেবা প্রাপ্তি দূরূহ। তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতি লক্ষ্য রাখার দাবি জানান।
আ ন ম ফজলুল হাদি সাব্বির বলেন, জনসমবায় হলো নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় যে সকল সম্পদ রয়েছে তা ব্যবহার করে নিজেদের যৌথ উদ্যোগে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা। ফরিদপুরের নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই মানুষগুলোকে সংগঠিত করা হয়েছে। বর্তমানে এই কার্যক্রমের আওতায় ১০টি দল রয়েছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের আহ্বান জানান তিনি।
শরীফা আক্তার নিপা বলেন, আমরা এই জনসমবায় দল করে মুষ্ঠিচালের মাধ্যমে পুঁজি গঠন করে বিভিন্ন কৃষি উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে আমাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জনসমবায় দলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে নারীদের জন্য বাজার তৈরি করার দাবি জানান।
মমতাজ বেগম, ‘মুষ্টি চালের দল করে এমনভাবে আগাইছি যে, আমরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পুরুষদের সাথে কাজে সহায়তা করছি। নিজেরা পুঁজি গঠন করছি। বিনিয়োগ করছি। জৈবসার উৎপাদন করছি। নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছি।’
তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, আমাদের কৃষিপণ্য বাজারজাত করতে পারি তার একটি ব্যবস্থা করা দরকার। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার করা দরকার। কৃষিবিষয়ক প্রণোদনা, সরকারি সহযোগিতা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। আমরা ভূমিহীন, আমরা খাসজমি পাইনি। এই বিষয়গুলোতে সহযোগিতা পেলে আমরা উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখতে পারব।
সঞ্চালক শামসুল হুদা বলেন, আমরা আমাদের একটি কাজের মূল্যায়নের জন্য জরিপ করেছি। এটি আসলে গবেষণা নয়। তবে জরিপের জন্য কিছু নিয়ম মেনে কাজ করতে হয়। সেটা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এটি আরও সংশোধন করার সুযোগ রয়েছে। আমরা অবশ্যই সেটি করব।
তিনি আরও বলেন, ব-দ্বীপ পরিকল্পনা নিয়ে পর্যালোচনা বেসরকারি পর্যায় হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তবে আমরা এ বছরের মধ্যে এটি নিয়ে একটি উদ্যোগ নিতে পারি। তবে জনসমবায় ভিত্তিক কার্যক্রমের ঘাটতিগুলো পূরণ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই পর্যায়ে এটিকে আরও সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঐক্যদ্ধতার ভেতর দিয়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। সে দিক থেকে আজকের আলোচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য।
মন্তব্য করুন