মোহাম্মদপুরের একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ত মেয়েটি। বয়স ১৫ বছর। বিদ্যালয়, কোচিংয়ে আসা-যাওয়ার পথে প্রায়ই একটি ছেলে তাকে উত্যক্ত করত। প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মেয়ে তাতে রাজি না হওয়ায় তুলে নেওয়ার হুমকি দেয়। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারি মেয়েটিকে কৌশলে তুলে নিয়ে যায়। মেয়েটির বাবা-মা ছেলেটির পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তারা মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু আট মাস কেটে গেলেও মেয়েকে ফেরত পান না অভিভাবক। অবশেষে পুলিশ অসুস্থ অবস্থায় মেয়েকে উদ্ধার করতে পারলেও ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এদিকে ছেলেটি ফোন করে হুমকি দিতে থাকে।
মেয়েটির মা বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করার পরামর্শ দেন। নারী ও শিশু নিযাতন দমন আইন ২০০০ (সং/২০০৩) এর ৭/৯(১) ধারায় ৪ অক্টোবর ২০২২ সালে অভিযোগপত্র দাখিল করে। মোহাম্মদপুর থানার মামলা নং ১৩(১০)২২। নারী ও শিশু নিযাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ এ বিচার চলতে থাকে।
মেয়েটির মতে, মামলার শুরু থেকে ছেলেটি পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পুলিশ রিপোর্ট গ্রহণবিষয়ক শুনানি হয়েছে এ বছরের ১৪ মার্চ। এরপর বিচারক একের পর এক প্রায় ২২ এর বেশি তদন্ত প্রতিবেদনের তারিখ দিয়েছেন। কিন্তু আদালতে প্রতিবেদন আজও জমা পড়েনি। আসামিও ধরা পড়েনি।
মোহাম্মদপুর থানার তদন্ত কর্মকর্তা সাব ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ রকিবুল আলম বলেন, আমি অক্টোবরে ওই থানা থেকে বদলি হয়েছি। এই মামলার তদন্ত সম্পর্কে এখন আমি কিছুই জানি না।
নারী ও শিশু নিযাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এ আরেকটি মামলা ধারা ৯(১) এর। ২০০৪ সালে মেয়েটির বিয়ে হয়। বড় ছেলের বয়স ১৪ আর মেয়ের বয়স ১১ বছর। ২০২১ সালের ২০ জুলাই জানতে পারেন তার স্বামী ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট তাকে তালাক দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী কালবেলাকে বলেন, ২০২১ সাল পর্যন্ত আমার স্বামী আমাদের সাথেই ছিল। আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কও ছিল। ৫ বছর আগে সে আমাকে তালাক দিয়ে আমার কাছে তা গোপন করে শারীরিক সম্পর্ক করে। তাহলে তো তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। প্রথমে মুরব্বিদের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি। তা না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছি।
বংশাল থানার সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলামের মতে, তার স্বামী তালাক দেওয়ার পরও বিষয়টি গোপন করে রেখেছিল। এরপর স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করায় তার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩৭৫ ধারার ৪ উপধারায় নারী ও শিশু নিযাতন দমন আইন ২০০০ এর ৯(১) ধারায় অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সন্তানদের কথাও সেই সত্যতাই উঠে এসেছে। তারা দুজনেই মধ্যবিত্ত পরিবারের। দেশে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর এসব ক্ষেত্রে নারীদের বিচার পাওয়ার হার কম। এ ছাড়া সামাজিকভাবে সম্মানহানি তো হচ্ছেই।
ঢাকা জেলার সাতটি ট্রাইব্যুনালের তিন বছরের (২০২২ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত) গুরুতর ছয়টি অপরাধের মামলা নিয়ে কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায় নারীর বিচার পাওয়ার হার কম। মামলা যত গড়ায়, সাক্ষী এনে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে আসামিদের শাস্তি দেওয়ার সম্ভাবনা তত কমে। আপসের সম্ভাবনাও বাড়ে।
ঢাকা জেলার ৭টি ট্রাইব্যুনালের বিচারিক নিবন্ধন খাতা থেকে অপহরণ করে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা, ধর্ষণ করে হত্যা, ধর্ষণ মামলা, যৌতুকের জন্য নিযাতন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ- এই ৬টি ধারা অনুযায়ী অপরাধের মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২২ সালে ৭টি ট্রাইব্যুনালে ৬টি ধারায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৮৬১টি। চলমান রয়েছে ১ হাজার ৭৬৫টি মামলা। খালাস হয়েছে ৩৯৬টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ৬টি মামলার। ২০২৩ সালে ৭টি ট্রাইব্যুনালে ৬টি ধারায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৪৮টি। চলমান রয়েছে ১ হাজার ৫৬টি মামলা। খালাস হয়েছে ১৯০টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১টি মামলায়। ২০২৪ সালে ৭টি ট্রাইব্যুনালে ৬টি ধারায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩৬৩টি। চলমান রয়েছে ১ হাজার ৩১১ টি মামলা। খালাস হয়েছে ৫২টি মামলা। মামলার সংখ্যা ২০২২ সালে বেশি ছিল, ২০২৩ সালে কিছুটা কমলেও ২০২৪ সালে তা আবার বেড়ে যায়।
এর মধ্যে ২০২২ সালে যৌতুকের জন্য নিযাতনের মামলা সবচেয়ে বেশি ৮৮৬টি। ২০২৩ সালে তা কমে ৪৯১টিতে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালে ৪৯৩টি। অর্থাৎ আবার বেড়েছে। ২০২২ সালে ধর্ষণ মামলা হয় ৫৫৯টি, ২০২৩ সালে ৪১৮ এবং ২০২৪ সালে আবার বেড়ে হয় ৪৮৩টি মামলা।
৭টি ট্রাইব্যুনালের ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পযন্ত জানা যায়, ধারা ৭/৯(১) এ অপহরণ করে ধর্ষণে ২৭১টি মামলা চলমান, ৫২টিতে আসামি খালাস পেয়েছে এবং ২টি মামলায় আসামির একজনের ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং আরেক আসামির কারাদণ্ড হয়েছে। ধারা ৯(৪)(খ) এ ধর্ষণের চেষ্টায় ২৭টি মামলা চলমান, খালাস পেয়েছে ১২টি, ধারা ৯(২) এ ধর্ষণ করে হত্যায় ৯টি মামলা চলমান, ধারা ৯(১) ধর্ষণ মামলায় ৪৮৫টি মামলা চলমান, ৭৪টিতে আসামি খালাস পেয়েছে এবং ৩টি মামলায় আসামির কারাদণ্ড হয়েছে। ধারা ১১(গ) যৌতুকের জন্য নির্যাতন ৬৩৩টি মামলা চলমান, ২৫৩টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ৯(৩) সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ৩৪টি মামলা চলমান, ৫টিতে আসামি খালাস পেয়েছে এবং ১টি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত জানা যায়, ধারা ৭/৯(১) এ অপহরণ করে ধর্ষণের ২০১টি মামলা চলমান, ২৩টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ৯(৪)(খ) এ ধর্ষণের চেষ্টায় ৮২টি মামলা চলমান, খালাস পেয়েছে ৫টি এবং ১টি মামলায় আসামির ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। ধারা ৯(২) এ ধর্ষণ করে হত্যায় ৩টি মামলা চলমান, ধারা ৯(১) ধর্ষণ মামলায় ৩৬৭টি মামলা চলমান, ৫১টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ১১(গ) যৌতুকের জন্য নিযাতন ৩৮০ টি মামলা চলমান, ১১১টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ৯(৩) সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২৩টি মামলা চলমান, ১টিতে আসামি খালাস পেয়েছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত জানা যায়, ধারা ৭/৯(১) এ অপহরণ করে ধর্ষণে ২৫৭টি মামলা চলমান, ৩টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ৯(৪)(খ) এ ধর্ষণের চেষ্টায় ৯৭টি, খালাস পেয়েছে ১টি, ধারা ৯(২) এ ধর্ষণ করে হত্যায় কোনো মামলা নেই। ধারা ৯(১) ধর্ষণ মামলায় ৪৭১টি মামলা চলমান, ১২টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ১১(গ) যৌতুকের জন্য নির্যাতন ৪৫৭ টি মামলা চলমান, ৩৬টিতে আসামি খালাস পেয়েছে, ধারা ৯(৩) সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ২৯টি মামলা চলমান রয়েছে। অর্থাৎ তিন বছরে মোট ৪ হাজার ৮৭৪টি মামলার মধ্যে মাত্র সাতটিতে সাজা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন ও বিচার বিভাগের একজন উপসচিব কালবেলাকে বলেন, নারী ও শিশু দমন আইন ট্রাইব্যুনালে যদিও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির কথা বলা রয়েছে, আদালতে যথাসময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া এবং পুলিশও তার তদন্ত সম্পন্ন করেন না। চার্জশিট দাখিল করতে পারেন না। আবার চার্জশিট দেওয়ার পর মামলার প্রক্রিয়া কাজ শুরু হয়।
তিনি আরও বলেন, আদালতে সময় মতো মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার এটা একটা বড় বাঁধা। ট্রাইব্যুনাল করাই হয়েছিল স্পেশাল ফোকাস দিয়ে দ্রুত মামলাগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য। আদালতগুলোর ওপরও মামলার প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। মামলা যতগুলো নিতে পারত তার থেকেও বেশি নেওয়া হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো, সকল পক্ষগণকে পুলিশ, আইনজীবী, বিচারকের সম্মিলিতভাবে প্রয়াস চালানো। এই তিন জন একসাথে উদ্যোগ নিলেই এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।
নিযাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তায় স্থাপিত ওয়ার-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতে প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। ধর্ষণ, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ, পাচার, পর্নোগ্রাফির মতো সংবেদনশীল মামলার জন্য পুলিশের পৃথক তবন্তকারী সেল গঠন করা জরুরি।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক কালবেলাকে বলেন, নারীর উপর নিপীড়ন, নিযাতন, আক্রমণ নতুন কোনো চিত্র না। এর সংখ্যা বছরভেদে ওঠানামা করে। সার্বিকভাবে এই চিত্রের কোনো মৌলিক পরিবর্তন নেই। নির্যাতনের শিকার নারীদের বেশির ভাগই আপনজন যথা পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিত-অপরিচিতদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।
তিনি বলেন, এই সমস্যা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হলে, গোটা সমাজের মনস্তাত্বিক পরিবর্তন দরকার। নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা, সম্মান করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যদিও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তবে যতখানি দরকার ততখানি হচ্ছে না। এজন্য প্রতিটি গৃহে, সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার।
মন্তব্য করুন