প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ভবিষ্যতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। শুক্রবার (১০ জুলাই) রাজধানীর দৃকপাঠ ভবনে আয়োজিত ‘প্রস্তাবিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ : মানবাধিকারকর্মীদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এমন মন্তব্য করা হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সুরক্ষা সংগঠন ‘ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্স’র আয়োজনে এই আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল ভুঁইয়া, আইন গবেষক ও লেখক মিল্লাত হোসেন, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী কল্লোল মোস্তফা প্রমুখ।
রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, পূর্ববর্তী আইনের ধারাবাহিকতায় প্রস্তাবিত আইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিনা ওয়ারেন্টে ফোন চেক করা, কোনো অপরাধ না হওয়ার পরও ঘরে ঢুকে চেক করা এটার প্রথম ভিক্টিম জনাব নাহিদ হবেন, তারপর আসিফ নজরুল হবেন, তারপর আদিলুর রহমান শুভ্র হবেন।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইন পাস করা হলে পূর্ববর্তী আইনের কিছু ধারায় করা মামলা বাতিল করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ২১ নং ধারায় জাতীয় পতাকার অবমাননাকে শাস্তিযোগ্য রাখার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, তবে এ নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এই আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ডিজিটাল রাইটসের কন্টেন্ট আর সাইবার সুরক্ষা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা এবং নতুন আইন তৈরি করার জন্য একটা অধ্যাদেশ দিতে পারে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল ভুঁইয়া বলেন, বর্তমান আইনটি পূর্বের আইনের ধারাবাহিকতা নয় বরং পুরোপুরি বাতিল করা উচিত। সাইবার সুরক্ষা আইনে থাকা অস্পষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য আইনগুলোর আওতা বাড়াতে হবে। এ সময় তিনি প্রস্তাবিত আইনে বহাল থাকা বিনা ওয়ারেন্টে পুলিশের তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রহিত করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, প্রস্তাবিত আইনে আপত্তিজনক ধারাগুলো বজায় রেখে চিত্তাকর্ষক কিছু শব্দ ঢুকানো হয়েছে, এভাবে এই আইন বাস্তবায়ন করা যাবে না। এ সময় আইনে সাইবার স্পেসে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করা হলে শাস্তির বিধান রাখা হলেও কোনো ব্যক্তি বৈধ প্রবেশাধিকার প্রয়োগ করে নাগরিকদের ক্ষতিসাধন করলে কী হবে তার উল্লেখ নেই।
আলোচনায় ধারা ৮ অনুযায়ী কন্টেন্ট ব্লক করা হলে তা রিভিউর ব্যবস্থা রাখার ওপর গুরুত্ব দেন বক্তারা। এ সময় এই আইনটি পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন বক্তারা। একজন বক্তা পরামর্শ দেন প্রস্তাবিত আইনটি এখনই পাস না করে পরবর্তীতে রাজনৈতিক সরকার আসার পর আরও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং আরও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে প্রণয়ন করা উচিত।
এ সময় বিগত সাইবার সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে উল্লেখ করে বক্তারা জানান, প্রস্তাবিত আইনের মাধ্যমেও ভবিষ্যতে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আইনে ডিপফেক প্রযুক্তির মাধ্যমে কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হলে তার প্রতিকার কী হবে তা উল্লেখ নেই বলে জানান মানবাধিকারকর্মী কল্লোল মোস্তফা।
অনুষ্ঠানে ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার্সের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত আইন নিয়ে বেশ কিছু আপত্তি ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, প্রস্তাবিত আইনটিও পূর্বের আইনের মতো ভিন্নমত দমনে ব্যবহৃত হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় প্রস্তাবিত আইনে নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তা ক্ষুণ্ন হলে কী প্রতিকার পাওয়া যাবে তার কোনো বিবরণ নেই।
মানবাধিকার সংগঠনটি জানায়, প্রস্তাবিত আইনের ধারা ২৫-এ অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রচারে শাস্তির কথা উল্লেখ করলেও তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া নেই। ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডার্সের মতে এটি আপেক্ষিক বিষয়, দেশ-কাল-সংস্কৃতিভেদে অশ্লীল বিষয় একই হয় না। ফলে এ নিয়ে ভুল ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও অভিযুক্তদের বিচারপূর্ব আটক রাখার বিষয়েও আপত্তি তেলে সংগঠনটি। তারা জানায়, এই বিধান সব অভিযুক্তদের জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত নয়।
মন্তব্য করুন