প্যারিসে ২০২৪ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসে ইসরায়েলের জাতীয় ফুটবল দল মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জাতীয় সংগীতকে কিছু দর্শক থেকে দুয়োধ্বনি এবং "ফ্রি প্যালেস্টাইন" স্লোগানে স্বাগত জানানো হয়। এই দৃশ্যটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম বিবাদপূর্ণ এক প্রকৃতিকে প্রদর্শন করে। অথচ অলিম্পিকের হওয়ার কথা ছিল এমন একটি ইভেন্ট যা বিশ্বব্যাপী একতা এবং শান্তি প্রচার করতে চায়।
গাজায় চলমান সংঘর্ষের মধ্যে ইসরায়েলের অংশগ্রহণ, যেখানে ৩৯,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। কর্মীরা এবং প্রতিবাদকারীরা দাবি করছেন যে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করা উচিত, যেমন অতীতে বিভিন্ন দেশ তাদের কার্যকলাপের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বর্তমানে, রাশিয়া এবং বেলারুশ ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২৪ অলিম্পিক থেকে নিষিদ্ধ রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা অলিম্পিক নিষেধাজ্ঞার ইতিহাসে একটি নতুন সংযোজন নয় এর আগেও যুদ্ধ, ডোপিং, রাজনৈতিক অবস্থান এবং আইওসি নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ করা হয়েছে।
অলিম্পিক ইতিহাসে নিষিদ্ধ হওয়া দেশসমূহ:
১৯২০ অ্যান্টওয়ার্প অলিম্পিক
দেশ: জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া এবং তুরস্ক
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের ভূমিকার জন্য ।
১৯২৪ প্যারিস অলিম্পিক
দেশ: জার্মানি
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: প্যারিসে হওয়া ১০০ বছর আগের অলিম্পিকে উপস্থিত ছিল না জার্মানি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতির জন্য পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত ছিল এই অলিম্পিকেও ।
১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিক
দেশ: জার্মানি এবং জাপান
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ হয় তারা।
১৯৬৪-১৯৯২ অলিম্পিক
দেশ: দক্ষিণ আফ্রিকা
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: বর্ণবৈষম্য এবং বর্ণবাদ নীতির জন্য নিষিদ্ধ করা হয় তৎকালীন শেতাঙ্গ দ্বারা পরিচালিত দক্ষিণ আফ্রিকা দেশকে।
১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিক
দেশ: রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে)
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তাদের বাদ দেওয়া হয় অলিম্পিকের এই আসর থেকে।
২০০০ মেলবোর্ন অলিম্পিক
দেশ: আফগানিস্থান
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: তালেবান শাসনের নারীদের অধিকার বিষয়ে অবস্থানের কারণে নিষিদ্ধ।
২০১৬ রিও অলিম্পিক
দেশ: কুয়েত
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: দেশের অলিম্পিক কমিটিতে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে তাদের এই আসরে খেলতে দেওয়া হয়নি।
২০২২ বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক
দেশ: উত্তর কোরিয়া
নিষিদ্ধ হওয়া কারণ: কোভিড-১৯ নিয়ে উদ্বেগের কারণে ২০২০ টোকিও অলিম্পিক থেকে নাম প্রত্যাহারের করার জন্য এই আসর থেকেও তাদের নিষিদ্ধ করা হয়।
২০১৬ রিও অলিম্পিক, ২০১৮ শীতকালীন অলিম্পিক, ২০২০ টোকিও অলিম্পিক:
দেশ: রাশিয়া
নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ: রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতায় ডোপিংয়ের কারণে অনেক অ্যাথলেট নিষিদ্ধ থাকে।
২০২৪ অলিম্পিক
রাশিয়া এবং বেলারুশকে প্যারিস গেমস থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে, শুধু কিছু নির্বাচিত অ্যাথলেট "স্বতন্ত্র নিরপেক্ষ অ্যাথলেট" (এআইএন) হিসাবে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। এর অর্থ হল এই অ্যাথলেটরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবেন না; কোন জাতীয় পতাকা, সঙ্গীত বা ইউনিফর্ম অনুমোদিত হবে না। তারা অলিম্পিকের পতাকা নিয়েই খেলবে।
অলিম্পিকে রাজনীতির বিতর্কিত ভূমিকা:
ইসরায়েলের মতো দেশের অংশগ্রহণের বিষয়ে চলমান বিতর্ক ক্রীড়া এবং রাজনীতির জটিল সংযোগকে তুলে ধরে। প্যারিস ২০২৪ সংগঠন কমিটির সদর দপ্তরের বাইরে প্রতিবাদকারীরা "গণহত্যাকারী দেশকে কোন খেলা নয়, ইসরায়েলকে বয়কট করুন" লেখা পোস্টার নিয়ে প্রতিবাদ করেছে, অতীতে রাজনৈতিক এবং মানবিক কারণে অলিম্পিক নিষেধাজ্ঞার দাবির সাথে যার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব:
অলিম্পিক নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা এবং নৈতিক বিবেচনার প্রতিফলন করে। বিশ্বযুদ্ধ থেকে বর্ণবাদ এবং রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতায় ডোপিং পর্যন্ত, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো গেমসের বর্ণনাকে আকার দিয়েছে, অলিম্পিক সনদের একতা, শান্তি এবং সুষ্ঠু খেলার প্রতিশ্রুতি জোরদার করেছে।
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের সময় এই নিষেধাজ্ঞার ইতিহাস বিশ্ব সম্প্রদায়কে মনে করিয়ে দেয় যে অলিম্পিকের শক্তি দেশগুলোর কার্যকলাপ এবং নৈতিকতার উপর নির্ভর করে বিশ্বকে একত্রিত বা বিভক্ত করার শক্তি রাখে ।
মন্তব্য করুন