আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দেশের সবচেয়ে পুরোনো ছাত্র সংগঠনটি নিষিদ্ধ করা হয়।
নিষিদ্ধ এই সংগঠনটির নামে নানা অভিযোগ রয়েছে। এবার নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ব্লগার অনন্ত আরফাত।
অনন্ত আরফাত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পোস্টে ছাত্রলীগের নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন।
কালবেলার পাঠকদের জন্য তার ফেসবুক পোস্টটি হুবুহু তুলে ধরা হল -
তখন কলেজে পড়ি। একদিন রাত একটার দিকে আব্বার ফোন। এই সময়ে ফোন মনের ভিতরে আতংক ঢুকায়ে দেয়। কোনো দূর্ঘটনা ছাড়া তো এই সময়ে ফোন আসার কথা না। ওই ফোনটা ছিলো আতংকিত হওয়ার মতোই ফোন। ফোন ধরে বললাম—হ্যালো। আব্বা বললেন—ঘুমাস নাই? বললাম—না। এখনো ঘুমাইনি। ‘আচ্ছা। শুন। মাসুম মারা গেছে।’ মাসুম ভাই আমাদের মামাতো ভাই। খুলু মামার বড় ছেলে। আমার নানার বাড়িতে সবচাইতে ডিসেন্ট, সবচাইতে স্নিগ্ধ ছেলেটার নাম মাসুম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ। যখনই বাড়িতে আসতো দেখতাম হয় পেপার পড়ছে, নয়তো কোনো ম্যাগাজিন। বেশিরভাগ সময় দেখতাম Carrier নামে একটা ম্যাগাজিন পড়তো। মাসুম ভাই মারা গেছেন। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। উনি তো কোনো রকম অসুস্থ ছিলেন না। আব্বারে বললাম—মাসুম ভাই, কেমনে মারা গেছে? আব্বা বললেন—আমি তো এতো কিছু জানি না। মাত্র খবর পাইলাম। ষোলশহর কারা জানি ছুরি মারছে! ‘এখন কোথায় আছে?’ ‘পাঁচলাইশ থানায়। তোর দুধু মামারে ফোন দিয়ে সকালে যাইস।’
আমি আর অপেক্ষা করলাম না। দুধু মামারে ফোন দিলাম। মামা কয়েকবার ফোন ধরলেন না। পরে ফোন ব্যাক করে বললেন—ভাইগ্না, মাসুম তো খুন হইছে। আমরা পাঁচলাইশ থানায় আছি। আমি বললাম—আচ্ছা মামা। আমি আসতেছি। মামা বললেন—আয়।
আমি তখন থাকি বহদ্দারহাট, চেয়ারম্যান ঘাটা। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম। পাঁচলাইশ থানায় গিয়ে দেখলাম মামাতো ভাই, খালাতো ভাই, মামা, সবাই চলে আসছেন ইতোমধ্যে। দুধু মামা আর বড় মামা ওসির রুমে। বাকিরা সবাই রুমের বাইরে দাঁড়ায়ে আছে। জালাল ভাইয়ারে বললাম, ঘটনা কি ভাইয়া?
জালাল ভাইয়া বললেন—ছাত্রলীগের পোলাপাইন মাসুমরে ষোলশহর স্টেশনে কোপাইছে।
বিস্তারিত শুনলাম ভাইয়ার কাছে। মাসুম ভাই টিউশনি শেষ করে এসে ভার্সিটিতে ফিরার জন্যে স্টেশনে বসছেন। ট্রেনের জন্যে ওয়েট করছেন। এই সময়ে ছাত্রলীগের এক গ্রুপ এসে এলোপাতাড়ি কোপাইলো। মাসুম ভাই ওইখানেই শহীদ হয়ে গেলেন। স্টেশনের লোকজন উনারে হাসপাতালে নেওয়ার পর দেখে অলরেডি উনি মারা গেছেন। পরে থানায় আনা হইছে উনাকে। থানার একপাশে একটা স্ট্রেচারে শোয়ায় রাখা হইছে। একটা সাদা চাদর উপরে দেওয়া। ওই চাদরটা রক্তে ভেসে গেছে। চাদর উল্টায়া চেহারাটা একবার দেখলাম। কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে এই চেহারাটা দেখা সম্ভব না। ঠোঁটের ডানপাশের একটা অংশ দাঁতসহ ঝুলে গেছে। আর সারা শরীরে সব কোপের দাগ। গলা জবাই করা। আমি ছিটকে দূরে সরে আসলাম। এই লাশ দেখা সম্ভব না। আমরা সবাই সারারাত থানায় দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে কাটায়া দিলাম। সকালে লাশ নেওয়া হলো চট্টগ্রাম মেডিকেলে। পোস্টমর্টেম হলো। তারপর লাশ নিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। আমার মামীকে এই লাশ দেখতে দিইনি আমরা। দেখানো অবস্থা ছিলো না। আমার মামী গড়াগড়ি দিয়ে শুধু বলছেন—আমার সোনারে আমি একটু দেখি। আমার সোনারে আমি একটু দেখি। মুরব্বীরা উনারে উনার সোনারে দেখানোর সাহস পাননি। আমি নিজে মামীরে ধরে দাঁড়ায়ে ছিলাম।
ওইদিন আমি জীবনে প্রথম লাশ গোসল করানোর কাজ করলাম। লাশের বর্ণনা এই এত বছর পরেও আমি দিবো না। দেওয়া সম্ভব না। ওইদিনের পরে আমি অনেকদিন আর রাতে একা ঘুমাতে পারতাম না। ভয় পেতাম। ওইদিনের পর থেকে আমি আর কোনোদিন ছাত্রলীগরে মানুষের সন্তান মনে করতাম না। আজকেও করি না।
শহীদ মহিউদ্দিন মাসুম। আমার আপন মামাতো ভাই। আমার মামা-মামী কোনোদিন এই খুনের বিচার পর্যন্ত চাইতে পারেনি।
আজকে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের এই রাতে চোখের সামনে শুধু মাসুম ভাইয়ের লাশের ছবি ভাসছে। উরুসন্ধিসহ সারা শরীতে কোপের দাগ। ঠোঁটের একটা অংশ ছিড়ে ঝুলে গেছে। গলাটা জবাই করা! আহারে আমার মাসুম ভাই!
প্রসঙ্গত, বুধবার (২৩ অক্টোবর) সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ। দেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে তারা নরকে পরিণত করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরুর দিকে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংসতা চালিয়ে দেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে।
মন্তব্য করুন