তত্ত্বাবধায়ক ফেরানোর পথ খুলল
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করাকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিল, অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। এ রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করার সিদ্ধান্ত অবৈধ হয়েছে। তবে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি ফেরার বিষয়টি আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এ বিষয়ে পৃথক রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। আগামী ১৯ জানুয়ারি সেসব রিভিউর শুনানির দিনও ঠিক করা আছে। আপিল বিভাগের রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
একই সঙ্গে হাইকোর্টের এই রায়ের মাধ্যমে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা জাতির পিতা, ৭ মার্চসহ বেশ কয়েকটি বিষয় সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। এসব ব্যাপারে সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন আদালত।
রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। ৬টি বিষয় বাতিল করে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
এদিকে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলেও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে আপিল বিভাগ থেকে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন বিচারাধীন। এখন এই রায়ের (হাইকোর্টের রায়ের) ফাইন্ডিংসগুলো সেখানে তুলে ধরা হবে। সবকিছু মিলিয়ে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’
অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জকারীদের পক্ষের আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটা এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না। কারণ, সেটা বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে।’ তিনি বলেন, ‘বদিউল আলম মজুমদার ও আরও চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।’
আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান আনা হয়। এরপর ওই বছরই জুনে দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারপর ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সংকটকালীন অবস্থায় ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ক্ষমতায় বসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। যেটি বাংলাদেশে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার নামেও পরিচিত ছিল। ওই সরকার প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজন করে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
এরই মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর পাসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিন আইনজীবী দুটি মামলা করেন। হাইকোর্ট সেগুলো খারিজ করে দেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আপিলের শুনানি করে ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, পরবর্তী দুটি নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের রাখার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের মাস দেড়েকের মাথায় একই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এই সংশোধনী পাস হয় সংসদে। এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সে সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোনো অধিবেশন বসবে না বলেও সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া সংশোধনী অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলেও বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে।
একই সঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ২০২১ সালের এই সংশোধনীর মাধ্যমে। অন্যদিকে গত আগস্ট মাসে সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় রিভিউ চেয়ে আবেদন দায়ের করেন। এরপর বিএনপি, জামায়াতের পক্ষ থেকে আরও দুটিসহ মোট তিনটি রিভিউ আবেদন দায়ের হয়েছে। এখন পৃথক চারটি রিভিউ আবেদনের ওপর আগামী ১৯ জানুয়ারি শুনানির জন্য রেখেছেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। আর আপিল বিভাগ থেকেই এই রিভিউর রায়ের মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর আংশিক বাতিলের রায়: গতকাল সকাল ১০ টা ৫২ মিনিট থেকে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা শুরু করেন। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব পৌনে দুই ঘণ্টাব্যাপী এ রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪(২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬টি বিধান বাতিল করেন হাইকোর্ট। বাকিগুলো সংসদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত আরও বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো রয়েছে।
গণভোটের বিষয়ে রায়ে হাইকোর্ট বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো। হাইকোর্টের রায়ে ৭ক, ৭খ এবং ৪৪(২) অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭খ সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। এদিকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা আছে। ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, এ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবেন। এ অনুচ্ছেদ বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।
‘এ রায় দিতে পেরে নারী হিসেবে আমি গর্বিত’: বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করে মূল রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ আদালতে পাঠ করেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রায় প্রদানকালে মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন, এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি, নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এ রায় দেওয়ার সময় আমরা জনগণের চাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছি। এসময় আইনজীবীরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
আইনজীবীরা যা বলছেন: রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, রিটকারীরা সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটাই অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আদালত পুরো সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেননি। আদালত বলেছেন, পুরোটা সংবিধান পরিপন্থি বলছি না। দ্বিতীয়ত বলেছেন, সংবিধানের ৭(এ) ও ৭(বি) এই দুটো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা সংবিধানে ছিলই না—এভাবে ধরে নিতে হবে। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা আদালত অবৈধ বলেছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটা বাতিল করা হয়েছে। রেফারেন্স হিসেবে আদালত বলেছেন, গত তিনটি নির্বাচন কীভাবে হয়েছে, কীভাবে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে, কীভাবে আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, কীভাবে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কীভাবে সংবিধানের মূল ভিত্তিতে আঘাত হানা হয়েছে—এগুলো উনারা বলেছেন। এরপর সংবিধানের ৪৪(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সরকার ইচ্ছা করলেই যে কোনো জায়গায় হাইকোর্ট বসাতে পারবেন। এটা অবৈধ। কারণ, এটা অষ্টম সংশোধনীর রায়ে বলা হয়েছে, এখানে একটি সুপ্রিম কোর্ট থাকবে। এই একটা সুপ্রিম কোর্টকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবেন, এটার সুযোগ নেই। তৃতীয়ত, গণভোটে জনগণের যে ক্ষমতা (পাওয়ার), সরকার যেভাবে সংকুচিত করেছিলেন, সেটা অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করেছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর বাকি বিষয়গুলো নিয়ে আদালত কিছুই বলেননি। বাকি বিষয়গুলো বৈধ নাকি অবৈধ, কিছুই বলেননি। সেগুলো সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে সেগুলো রাখবে কি রাখবেন না।
সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আদালত পঞ্চদশ সংশোধনীর মোট ছয়টি বিধান বাতিল করেছে। ওই সংশোধনীতে ৫৪টি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বাকিগুলো পরবর্তী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। পরবর্তী সংসদ এসে যৌক্তিক মনে করলে রাখবে, অথবা রাখবে না।
রিটকারীদের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে, সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটা ঐতিহাসিক রায়।
সংবিধানে জাতির পিতা, ৭ মার্চসহ কয়েকটি ধারা যে সংসদের জন্য আদালত ‘রেখে দিয়েছেন’ তা জানিয়ে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত। সার্বিকভাবে তিনি রায়কে ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করে বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকবে বলে তিনি আশা করেন। বহাল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না।
মামলার ইতিবৃত্ত: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। এই সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এই রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন।
অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে আরও একটি রিট আবেদন করেন। এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর দ্বাদশ দিনে ৪ ডিসেম্বর শুনানি শেষ হয়। পরদিন আদালত রায়ের জন্য ১৭ ডিসেম্বর তারিখ রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় পর্যবেক্ষণসহ রুল আংশিক যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেন।
আলোচিত এই রিটের রুল শুনানিতে সুজনের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। ইনসানিয়াত বিপ্লব দলের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুর রউফ ও ইশরাত হাসান। এ ছাড়া রুল শুনানিতে পক্ষভুক্ত হওয়া সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন। এদিকে গতকাল রায় ঘোষণার সময় পক্ষভুক্ত হওয়া আইনজীবী ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী, নাফিউল আলম সুপ্ত এবং সাইয়েদ আবদুল্লাহসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪