সাজ্জাদ জহিরের নিবন্ধ / নির্বাচনে প্রার্থীদের বিদেশি নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে খোলা চিঠি
পূর্বের বেশ কিছু লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে , বাংলাদেশে ‘দ্বৈত নাগরিক’ নামে একটি আইনি সত্ত্বার অনুমোদন ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। যদিও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকরা অন্য পাঁচজন বিদেশিদের তুলনায় সীমিত পরিসরে অধিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন, তাদের বাংলাদেশি নাগরিকদের (যাদের আনুগত্য শুধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি রয়েছে) সমপর্যায়ে দেখা সমীচীন নয়। বিশেষ করে, দেশের সংবিধানে বর্ণিত যোগ্যতার মানদণ্ড এবং দেশের আইন ও বিধিগুলোর বর্তমান ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি বোঝা যায়- বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই বিদেশি নাগরিকরা (FCBO- ফরেন সিটিজেনস অফ বাংলাদেশ অরিজিন) দেশের সংসদে সদস্যপদপ্রার্থী হওয়ার জন্য নাগরিকত্ব-সম্পর্কিত পূর্বশর্ত পূরণ করেন না। এমনকি তারা কোনো কোনো সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন না বলে জেনেছি। প্রধানমন্ত্রী সংবিধানকে সমুন্নত রাখার এবং এর মৌলিক নীতিমালার কোনো লঙ্ঘন না হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। উপরে বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, এটা কাঙ্ক্ষিত ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের প্রার্থী হওয়ার আবেদন নির্বাচন কমিশনে (নিক) জমা দেওয়ার আগে, যাচাইবাছাই করে দেখবেন। সেটা করলে নিক-এর ওপর চাপ কম পড়ত। তবে অনস্বীকার্য, চূড়ান্ত যাচাইবাছাইয়ের দায়িত্ব নিক-এর। স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে এককভাবে তারাই এ কাজটি করবে, এবং দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যাচাইবাছাইয়ের দায়িত্বও নিক-এর।  এই কাজটি পোক্ত হয় যদি নিক প্রার্থী-পর্যায়ে এবং মনোনয়নকারী রাজনৈতিক দলগুলো (কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব) কর্তৃক হলফনামা দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়, যেখানে ‘বাইরের দেশের নাগরিক নই’ মর্মে স্বীকৃতি থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে অঙ্গীকার থাকবে, মনোনীত কোনো প্রার্থীই বাইরের দেশের নাগরিক নন। এ ছাড়াও, বাংলাদেশের বিদেশি মিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে এবং নেট থেকে সংগৃহীত তথ্য, একজন প্রার্থীর ‘বিদেশি নাগরিকত্বের স্থিতি’ মূল্যায়নে সহায়ক হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিদেশি নাগরিকত্ব (সাধারণত দ্বৈত নাগরিকত্ব হিসেবে আখ্যায়িত) থাকার কারণে নির্বাচন কমিশন কারও কারও প্রার্থিতা প্রত্যাখ্যান করেছে। অবহেলিত এই বিষয়টি নিক-এর নজরে এসেছে এবং তারা এ-সংক্রান্ত কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে জেনে আশা জাগে। সেসব খবরে জানা যায়- বরিশাল-৪ আসনের আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী (এবং আ.লীগ আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সচিব!) শাম্মী আহমেদ অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক হওয়ার কারণে নিক তার প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রার্থী আপিল করেছেন কি না তা অজানা। তবে জানা যায়, এ-সংক্রান্ত সব আপিলের সুরাহা কিছুটা বিলম্বে করা হবে।  গণমাধ্যমে আসা আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো ফরিদপুর-৩ আসনে আ.লীগের প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদ নিক-কে অনুরোধ করেছেন। শামীম হক বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বলে অভিযোগ করা সত্ত্বেও শামীম হকের প্রার্থিতা আবেদন নাকচ করা হয়নি। আজাদ আপিল করেছেন বলে জানা গেছে, যদিও সেই আবেদনের ফলাফল জানা যায়নি। নাগরিকত্ব যাচাই করর জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ হতে হয়। শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য আজাদের আপিলের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা পদ্ধতিটি পড়লে মনে প্রশ্ন জাগে। কেন, একজন প্রার্থী বিদেশি নাগরিকত্ব থাকার কারণে যোগ্য নয়, তা প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযোগকারীর ওপর বর্তাবে? জানা গেছে, আপিলটিতে শামীম হকের বিদেশি পাসপোর্টের ফটোকপি প্রমাণ হিসেবে দিতে হয়েছিল। যদি, অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে, বিদ্যুতের অর্থ প্রদান, অনাদায়ী ঋণসংক্রান্ত ব্যাংক ছাড়পত্র, আয়কর প্রদান, ইত্যাদি পূর্বশর্ত নিশ্চিত নিক-এর পক্ষে করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে ভিনদেশের নাগরিকত্ব যাচাই কেন সম্ভব হবে না, তা বোধগম্য নয়। ন্যুনতম, প্রতিজন প্রার্থীর একটি হলফনামা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত, যেখানে উল্লেখ থাকবে, তিনি অন্য কোনো দেশের নাগরিক নন এবং পরবর্তী যে কোনো সময়ে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে, তার প্রার্থিতা বা পদ খারিজ হবে।  এ জাতীয় কঠোর ব্যবস্থা না থাকলে জাতীয় সংসদে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটবে। সেই সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। নাগরিকত্বের ব্যাপারে ভুল তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে, আরও অনেক প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নিক-এর অনুমোদন পেয়ে থাকতে পারে। সে সবের অনেক ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ না হতে পারে, যার ফলে, সেসব প্রার্থীর নাগরিকত্ব পরিচয় এবং অবৈধ অংশগ্রহণ জনসাধারণের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যাবে। এটা জরুরি যে নির্বাচন কমিশন বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে এবং সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য বর্তমান যাচাইবাছাই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবে। বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার কারণে কোনো ব্যক্তিকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার জন্য সংবিধানে যথেষ্ট কার্যকারণ রয়েছে। ভেবে দেখুন, একটি সার্বভৌম দেশের (বাংলাদেশ) আইন প্রণয়নকারী সংস্থাতে (জাতীয় সংসদ) এমন সব সদস্য রয়েছেন যারা অন্য দেশের নাগরিক এবং যাদের আইনানুগ বশ্যতা সেই দেশের সংবিধানের প্রতি! সেই দেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার শপথে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগের কথা উল্লেখ করুক বা না করুক, কার্য্যত, নতুন দেশে নাগরিকত্ব গ্রহণের ফলে সেই দেশের সরকারের (এবং রাষ্ট্রের) প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। সংবিধান লঙ্ঘন ছাড়াও এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের সংসদে অন্তর্ভুক্তির ফলে ভিন্ন একটি বিপদের সম্ভাবনা জাগে। দেশের আইন প্রণয়ন বা পরিমার্জনের কেন্দ্র না হয়ে, সংসদ একটি ট্রেডিং হাউসে (বাণিজ্য কেন্দ্রে) পরিণত হবার সম্ভাবনা জাগে। যেখানে টেন্ডার ও সরকারি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের দর-কষাকষি ও বণ্টন নিকটত্বের কারণে সহজ হয়।  তথ্য ঘাঁটলেই জানা যাবে, সমস্ত প্রধান ঔপনিবেশিক শাসকদের (তথাকথিত উন্নত পশ্চিম) দেশে এইসকল ‘দ্বৈত নাগরিক’গণ ছড়িয়ে আছেন এবং সেসব দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর চাহিদা মেটাতে সংসদে অনুপ্রবেশকারীরা তৎপর হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্পষ্টতই, এটি ওয়াশিংটন ডিসি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), লন্ডন (যুক্তরাজ্য), সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশেষ ভিসাধারী ব্যক্তিদের মধ্যে (যেমন : মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ভারত) কাউন্টারপার্ট ‘ট্রেডিং হাউস’গুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি করবে!  দেশের সম্পদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং রাষ্ট্র ‘ব্যর্থ’ হিসেবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একটি অনুন্নত দেশে এই ধরনের ব্যবসা চলতে পারে! সেই ক্রান্তিকাল সৃষ্ট হলে এফসিবিওরা গণহারে বিদায় নেবে, যা সংসদে শূন্যতা সৃষ্টি করে অরাজকতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। একটি ভূখণ্ডের সবদিকে বেড়ার বেষ্টনী হয়তো ন্যায্যতা খুঁজে পায় এমনই একটি আশঙ্কায়! এসব শঙ্কা জাগার কারণে বিষয়টির প্রতি নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং আশা করছি , তারা প্রমাণ করবেন যে নির্বাচন না হওয়ার চাইতে একটি সুষ্ঠু ও সংবিধান-মোতাবেক নির্বাচন হওয়া ভাল। প্রার্থিতা যাচাইবাছাইয়ের বর্তমান পর্যায়ে, সংসদে অনুপ্রবেশের প্রথম ধাপ হিসেবে অনাকাঙ্ক্ষিত (ও সাংবিধানিকভাবে অবৈধ) ব্যক্তিদের নির্বাচলে অংশগ্রহণ বন্দ করার জন্য সব সম্ভাব্য উপকরণ প্রয়োগ করার জন্য নিক-কে আন্তরিকভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে। যেমনটি উল্লেখ করা হয়েছে, নন-এফসিবিওর ঘোষণাসহ একটি হলফনামা হলো প্রথম আইনি পদক্ষেপ, যা আরোপ করা জরুরি।  আরও কিছু সাদামাটা পদ্ধতি রয়েছে যা নিক পরবর্তী ধাপে বিবেচনা করতে পারেন। ভিনদেশে নাগরিকত্ব নেওয়া ব্যক্তিদের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেসব দেশের আয়কর আইনজীবীরা সরবরাহ করতে পারেন, কিন্তু তারা তাদের মক্কেলদের হয়তো হারাতে চাইবেন না। বিকল্প পন্থা হিসেবে, প্রতিটি প্রার্থীকে পূর্ব-নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি) থেকে আগমন বা সেখানে গমনের (ভ্রমণের) শেষ তারিখ ঘোষণা করতে বলা যেতে পারে।  একজন অনুমোদিত কর্মকর্তা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে ভ্রমণটি বিদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে করা হয়েছিল কি না। যদি বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করা হয়, সেই পাসপোর্টে বিশেষ ভিসা (যেমন : পিআর বা গ্রিন কার্ড) ছিল কি না। এসব উপাত্ত বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট দপ্তরের তথ্যাভাণ্ডারে পাওয়ার কথা। এসবের বাইরে, প্রার্থীর বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় পরিপূরক তথ্য সংগ্রহ সম্ভব। এসকল উদ্যোগ নৈর্ব্যক্তিকভাবে কার্যকর করা হলে প্রার্থীর ভিনদেশের নাগরিকত্ব যাচাই করতে সহায়ক হবে। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগে উপরোক্ত বিষয়ে কার্যকর যাচাইবাছাই বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা এমন ব্যক্তিতে ভরা নতুন সংসদ দেখতে চাই না যারা সহজেই রঙ পরিবর্তন করতে পারবে এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে বিপন্ন করবে। ড. সাজ্জাদ জহির : অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ  
১২ ডিসেম্বর, ২০২৩

ড. সাজ্জাদ জহিরের সাক্ষাৎকার / সততা ও মেধার ক্ষেত্র বিস্তৃতির জন্য দলগত আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন
ড. সাজ্জাদ জহির, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতি-বিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-অর্থনীতি ইস্যু নিয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা। শ্রুতলিখন : মুজাহিদুল ইসলাম।  কালবেলা : দেড় মাস পর আমাদের জাতীয় নির্বাচন। এর মধ্যে আমরা অনেক ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছি। আপনি বাংলাদেশে বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে কীভাবে দেখছেন?  ড. সাজ্জাদ জহির : আমাদের সামনে এ মুহূর্তে বড় দুটি চ্যালেঞ্জ হলো নাগরিকদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের সংকট মোকাবিলা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।  যে জনগোষ্ঠীর কাছে সরকার দায়বদ্ধ তাদের আর্থিকভাবে বেঁচে থাকা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। আর্থিকভাবে বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের যে সংকট সেটা আরও তীব্র হবে বলে অনেকেই মনে করছেন। এই সংকট মোকাবিলা করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, কর্মসংস্থান। এটি একটা মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কিন্তু এরও কিছু স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাও রয়েছে। আমরা আগে চিন্তা করতাম, ত্রাণ না দিয়ে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কীভাবে অর্থ এবং খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। সব সময় সেটি বাজারভিত্তিক হবে, বিষয়টি তা নয়। বাজারের বাইরে গিয়েও সেটা হতে পারে।  চ্যালেঞ্জগুলো তৈরি হয়েছে বাইরের এবং ভেতরের ঘটনাগুলো মিলিয়ে। সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য সব সময় বাজারকেন্দ্রিক চিন্তা করা সঠিক হবে না। বিভিন্ন অঙ্গনে যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে তা মেটানোর জন্য চাহিদা ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। বাংলাদেশে এখনো খাদ্য ঘাটতি তৈরি হয়নি। তবে খাদ্য কিনতে যে অর্থের প্রয়োজন অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা, তার সংকট তৈরি হয়েছে। দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। তার সঙ্গে তালমিলিয়ে মানুষের আয় বাড়েনি। এ প্রেক্ষাপটে চাহিদা ব্যবস্থাপনা জরুরি হয়ে পড়েছে।  কালবেলা : উদ্ভূত সংকটের জন্য আপনি কার দায় দেখেন? বাংলাদেশে এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে?  ড. সাজ্জাদ জহির : বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে যে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ তার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারেনি। হয়তো আমরা দুর্বল দেশ বলে অনেক কিছু মেনে নিয়েই চলতে হচ্ছে। কিন্তু এর ভেতরেও জনগণের সামনে একটি পরিষ্কার রোড ম্যাপ তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। আমাদের জনগোষ্ঠী নানা কারণে বহুধাখণ্ডিত। সেই জায়গায় সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করা প্রয়োজন ছিল, সরকারের দায়বদ্ধতা কার প্রতি।  কিছুদিন আগে আমি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। সরকার নিজেই জানে না- তার দায়বদ্ধতা কার প্রতি। যারা আমাদের নাগরিকত্ব নাম নিয়ে বিদেশের মাটিতে আছেন কিন্তু মূলত সেবা করে অন্য দেশের- তাদের ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট একটি নীতিমালা থাকা দরকার। যারা দ্বৈত বশ্যতার শিকার হয়েছেন সেখান থেকে উত্তরণটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাইরের শক্তিগুলো যখন বিভিন্নভাবে খেলতে শুরু করে তখন ভেতরের শক্তিকে একত্রিত করা দরকার হয়। এখানে আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে। সেই ব্যর্থতা থেকে বের হয়ে এসে বাইরের শক্তিকে মোকাবিলা করাটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে আমরা ভেতরেও টিকতে পারব না।  কালবেলা : ঋণ-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই কি দেশে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে?  ড. সাজ্জাদ জহির : ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দেখার প্রয়োজন ছিল তা হলো- আমি কতটুকু ঋণ করব এবং সেই ঋণ কী কাজে ব্যবহার করব। আমি যখন ঋণের টাকা একটি ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করব তখন সেখান থেকে টাকাটা কীভাবে, কত দিনে রিটার্ন আসবে এবং কী ধরনের চুক্তিতে আমরা সেগুলো করছি সেটার একটি টাইমলাইন দরকার হয়। আমাদের চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে কিছু ব্যর্থতা রয়ে গেছে। আমাদের ব্যর্থতার কারণে অনেক ধরনের অপচয় করেছি। অন্যদিকে বাইরের স্বার্থের কাছে আমরা কিছুটা বশ্যতা স্বীকার করেছি। বৈদেশিক ঋণ নেওয়া এবং তার দায় আগামী দিনে আমরা কীভাবে মেটাব সেখানে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার ছিল। কিন্তু সেই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে বলে মনে হয়েছে।  যারা এক সময়ে খুব জোর দিয়ে বলত ঋণ নেওয়া দরকার। তারাই আবার আজ বলছে সব বাংলাদেশ ব্যাংকের দোষ। এক সময় তারা বলতো টাকার অবমূল্যায়ন দরকার। এখন তারাই বলছে অবমূল্যায়ন করা হলো বলে সংকট তৈরি হয়েছে। নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাব এবং তাদের জ্ঞানের ঘাটতি দৃশ্যমান। যিনি কর্তৃত্বে থাকবেন তার পেশাদারিত্ব থাকা দরকার। আজ কেউ ঋণ দিতে চাইছে বলেই আমরা তা নিয়ে নেব তেমনটা হওয়া উচিত নয়। নীতিনির্ধারণে যারা কাজ করছেন তাদের দায়বদ্ধতা কার প্রতি সেটিকে আগে খুঁজে বের করে তার আলোকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমাদের ব্যবস্থাপনার বড় ব্যর্থতা হলো, ঋণের পোর্টফোলিও এবং তা পরিশোধে রোডম্যাপটাকে বোঝার চেষ্টা না করা।  যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের ঘাটতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত- তারা দেশের স্বার্থ চিন্তা করেননি। দ্বৈত নাগরিকদের ভেতরে সব সময় এক ধরনের লুটপাটের প্রবণতা থাকে। অর্থাৎ যত বেশি অর্থ আসে তার মধ্য থেকে তারা তত বেশি বের করে নিতে পারেন। এই বিষয়টাকে রাজনৈতিকভাবেই ডিল করা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা আমরা এখনও দেখিনি।  নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারের তদারকি করাটা অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম হঠাৎ করে একটি হাইপ তোলা হলো, সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এরপর আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এখানে ধারাবাহিকভাবে আমাদের আমদানি নির্ভরতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই সংকটের জায়গাটা সব রাজনৈতিক অঙ্গনের ভাবার দরকার ছিল। কিন্তু আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখিনি। এটাকে আমরা ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার বলব না কি বলব অন্য কোনো স্বার্থের কাছে নিজেদের আত্মসমর্পণ করা হচ্ছে?  ব্যাংকিং খাত অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। এই সংকটের শিকড় এতটাই গভীরে যে এটা কোনোভাবেই রাতারাতি ঘটেনি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সামনে আসা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই বিষয়ের দায়িত্বে আমাদের মন্ত্রীপর্যায়ে যারা রয়েছেন তারা হয়ত একান্তই ব্যক্তি ব্যবসায়িক স্বার্থের ভেতরে জড়িয়ে গেছেন। সেজন্য হয়ত তারা সম্মুখভাবে চ্যালেঞ্জটাকে নিতে পারছেন না।  রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো- আমরা রাজনীতিতে এখনো দেশের এজেন্ডা সামনে আনতে পারিনি। চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা তখনই সাজে যখন আমরা সেখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইব। কিন্তু আমরা চ্যালেঞ্জ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছি না। একটি দল যখন আরেকটি দলের বিরোধিতা করছে তখন তাদের মধ্যকার আলোচনা ও বাকবিতণ্ডায় কোনো সারবস্তু নেই। ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের দীনতা লক্ষ্য করা যায়। আমি অনেক সময় বলি পার্টির ভেতরে আত্মশুদ্ধি এবং পার্টির ভেতরে বিপ্লব- এটাই সবার আগে প্রয়োজন।  দেশের সব জায়গা থেকে পেশাদারিত্ব চলে গেছে। প্রশাসনে এবং দেশের ভেতরে এখনো বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন যাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব রয়েছে। তাদের পলিটিক্যালি মোটিভেট করে মবিলাইজ করা প্রয়োজন। তাদের কাছে দেশ এবং দেশের স্বার্থকে ডিফাইন করতে হবে। তাদের মাধ্যমে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে হবে।  যে অতীতকে সামনে রেখে আমাদের সমাজ পরিবর্তনের জন্য বা বিনিয়োগ আনার জন্য একটি গতি আনা হয়েছিল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক মহল যদি পরবর্তী ধাপে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে না পারে তাহলে সবকিছুই ব্যর্থ হয়ে যাবে।  কালবেলা : রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে একটি গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রেখেই রাষ্ট্র এবং দল পরিচালনা করতে চায় কেন?  ড. সাজ্জাদ জহির : বাজারব্যবস্থা এমন একটি জায়গা যেখানে ব্যবসায়ীরা সব সময়ই ‘দুই নম্বরী’ করতে চেষ্টা করবে। যে কোনোভাবেই হোক মানুষকে ঠকিয়ে হলেও তারা অর্থ পেতে চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে আমি আংশিক বা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত বাজারে তাদেরকেই অংশগ্রহণ করতে দিব যারা মৌলিকভাবে সৎ। এই জায়গাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে সৎ ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি জেনে শুনে খারাপ লোকগুলোকে বেছে বাজারে এনে বসিয়ে থাকে তাহলে সেই নেতৃত্ব থাকা উচিত নয়। আর তারা যদি ভুল করে এটা করে থাকে, তাহলে তা শোধরানো দরকার। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এটা ঘটেছে পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে। কিন্তু আমাদের অনেক শিক্ষা হয়েছে। এখন আমাদের রাজনীতিতে বড় আকারের গুণগত পরিবর্তন দরকার।  কালবেলা : রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে কীভাবে সংশোধন হবে?   ড. সাজ্জাদ জহির : দল বা প্রশাসনের ভেতরে এক ধরনের ফিল্টারিংয়ের প্রসেস চালু করা যেতে পারে। যারা আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে তাদের সৎ হতে হবে এবং সৎ ব্যক্তিদেরই রাজনৈতিক দলগুলোতে স্থান দিতে হবে। কিন্তু যিনি এই ফিল্টারিং করবেন তিনি নিজেই যদি দুর্নীতিপরায়ন হয়ে থাকেন তাহলে সমাধান থাকে একমাত্র বিপ্লব। তবে বাইরের শক্তিকে নিয়ে আসা কোনোভাবেই উচিত নয়। কারণ তাদের অন্যান্য অনেক ইন্টারেস্ট থাকে। বাইরের শক্তিকে আসার সুযোগ দেওয়া মানে রং প্লেয়ারদের ‘খেলার’ সুযোগ করে দেওয়া।  আমরা অভ্যন্তরীণভাবে চাহিদা ও দেশজ উৎপাদনের যোগসূত্রতার পরিধি বৃদ্ধি করতে পারি। বাইরে কর্মসংস্থান, বাইরের লোকজনের ওপর নির্ভরতা এমনকি এদেশের লোক বাইরের নাগরিকত্ব নিয়ে আবার এদেশে এসে শাসন করা বা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃত্ব করা—এই নির্ভরশীলতা আমাদের সংকটে ফেলতে পারে।  আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি বিদেশে আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাসের জন্য অনেক হুমকি আসছে। আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টসের রপ্তানির ওপরে হুমকি আসতে যাচ্ছে। আমাদের সেনাবাহিনীর আয়ের জায়গায় হুমকি আসতে পারে। অর্থাৎ বাইরের উপরে নির্ভর করার কারণে আমাদের অনেক ক্ষেত্রে হাত-পা বাঁধা। এই হাত-পা বাঁধা থেকে উত্তরণের একটি মেকানিজম আমাদের থাকা দরকার। সেই অল্টারনেটিভ মেকানিজম দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব এখনো আমরা দেখাতে পারিনি।  কালবেলা : সংকট উত্তোরণের জন্য কীভাবে এগোনো উচিত বলে মনে করেন?  ড. সাজ্জাদ জহির : আমরা চাইলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারি। কিন্তু সেটার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে যে ধরনের সুস্পষ্ট অবস্থান প্রয়োজন সেই জায়গাটায় আমরা মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলছি। এই অবস্থার উত্তরণের জন্য দেশের এবং সমাজের সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই বাইরের শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে।  সুতরাং দেশের স্বার্থ কারা দেখবে সেটাকে ডিফাইন করা এখন খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব ঘিরে আমাদের পলিটিক্যাল এডুকেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি আমি দুএক জায়গায় বলেছি, আমাদের যুবসমাজকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার দরকার যাতে প্রয়োজন হলে তারা দেশকে রক্ষা করতে পারে। শুধু বহিঃশত্রু নয়, ভেতরেও অনেক ধরনের শক্তি দানা বাঁধে। সেগুলো থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সৎ ও শিক্ষিত দেশপ্রেমিক যুবসমাজ দরকার। একটি জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও পেশাদারিত্বের দিক থেকে তৈরি করার পাশাপাশি নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্য তৈরি করাটা নেতৃত্বেরই দায়িত্ব। (প্রথম পর্ব)   
২১ নভেম্বর, ২০২৩
X