‘যে কোনো দেশ চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে’
যে কোনো দেশ চাইলেই বাংলাদেশের সেন্ট্রালে ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।  রোববার (৭ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণাল‌য়ে আয়ো‌জিত এক সংবাদ স‌ম্মেল‌নে এ তথ‌্য জানান তিনি।  পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীন সফরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তিনি বলেন, দুই দেশের সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে প্রায় ২০টির মতো অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ষষ্ঠ ও নবম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ হতে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি প্রভৃতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে।  চীন সফরে দুই দেশের বাণিজ্যিক চুক্তিগুলোকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্যিক আলোচনার জন্য এই সফরে বাংলাদেশের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল থাকছে। চীনে আমরা রপ্তানি বাড়াতে চাই। বিশেষ করে কৃষি পণ্যসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে যেসব শুল্ক বাধা আছে তা নিয়ে আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া অতীতের যেসব চুক্তি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি সেগুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। চীনের সহযোগিতায় আমাদের পূর্ব উন্নয়ন ও চাইনিজ কমিউনিটি পার্টির সঙ্গে আলোচনাও চলমান থাকবে।  চীন থেকে আমরা কী পরিমাণ ঋণ পেতে পারি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই সফরে ঋণের বিষয়ে কোনো ফাংশন নেই। এ নিয়ে দু’দেশের আলোচনা হতে পারে। তবে, অফিসিয়াল প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। এ সময় ড. হাছান মাহমুদ বলেন, যে কোনো দেশ চাইলেই বাংলাদেশের সেন্ট্রালে ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ কার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত। 
১৫ ঘণ্টা আগে

কাল চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, ২০ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে ২০ থেকে ২২টির মতো সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে।  রোববার (৭ জুলাই) দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এই তথ্য জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ৮ থেকে ১১ জুলাই চীন সফর করবেন। সোমবার (৮ জুলাই) সকাল ১১টায় হজরত শাহ্জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রওনা দিবেন, বেইজিংয়ে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় পৌঁছাবেন। হাছান মাহমুদ জানান, ১০ জুলাই সফরের তৃতীয় দিনে প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হল অব দ্য পিপল -এ চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল লি ছিয়াংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাতের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। একই স্থানে প্রধানমন্ত্রী এবং চীনের প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কাউন্সিল দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলসহ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন। এর পর দুই দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে প্রায় ২০ থেকে ২২টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে এবং কিছু প্রকল্প উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়া হবে। অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাত, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, ডিজিটাল ইকোনমি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহায়তা, ৬ষ্ঠ ও ৯ম বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ নির্মাণ, বাংলাদেশ হতে কৃষিপণ্য রপ্তানি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি প্রভৃতি বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনা আছে। হাছান মাহমুদ বলেন, এই সফরে বাংলাদেশের উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। দেশটির সঙ্গে স্ট্র‍্যাটেজিক সম্পর্ক রয়েছে। এই সফর আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসময় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে কীনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তিস্তা বিষয়ে চীন যদি আগ্রহ দেখায় তাহলে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, তিস্তা ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দেশের যৌথ নদী। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারত আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এখন সেটি পর্যালোচনা করতেছি। চীন থেকে বাজেট সহায়তা নেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, এই সফরে চীনের সঙ্গে ইকোনমিক কোঅপারেশন নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি হবে। এর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে আলোচনা হবে। এ সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রয়োজনের নিরিখে এবং আমাদের প্যারামিটারগুলো পর্যালোচনা করে আমরা সহযোগিতা নেই। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর পুনরায় সাহায্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা তা গ্রহণ করিনি। চীনকে বাংলাদেশ অফসোর ব্যাংকিংয়ের প্রস্তাব দেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অফসোর ব্যাংকিং ওপেন ফর অল। যে কোনো দেশ যদি চায়, আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাংকে চাইলে টাকা রাখতে পারে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ব্যাংকে অনেক দেশ টাকা রাখতে পারে। তবে অফসোর ব্যাংকিং কিছুটা ভিন্ন বিষয়। মোংলা বন্দর উন্নয়নের বিষয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব চীনকে দেওয়া হবে কি না, এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মোংলা বন্দর উন্নয়নের বিষয়ে চীনের সঙ্গে আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্যে আছি। এই সফরে আশা করছি বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে। চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি থেকে আমরা করছি বেশি, রপ্তানি কম হয়। আমরা পরিকল্পনা করছি আমাদের পণ্য রপ্তানি বাড়াতে। ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল স্বাধীনতারও পূর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক চীন সফরের মাধ্যমে, যে সময় চীনের তৎকালীন নেতা মাও সে-তুং -এর সঙ্গে জাতির জনকের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধু রচনা করেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটি। চীন ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, যার ধারাবাহিকতায় দুই দেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান আছে। ২০১৬ সালে শি চিনপিং-এর ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ‘কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারত্ব’ -এ উন্নীত হয়। বিগত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হবার পর প্রধানমন্ত্রীকে চীনের পক্ষ থেকে সরকারি সফরের জন্য আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানানো হয়। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, আর্থিক সহায়তা এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ চীনের সহায়তা কামনা করবে। একই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ চীনের প্রতি সমর্থন প্রদান করে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরকালে অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব, অন্য সচিবসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাগণ সফরসঙ্গী হবেন। প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত ব্যংকুয়েটের (ভোজের) মাধ্যমে গ্রেট হলে উল্লিখিত সাক্ষাতের আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ১০ জুলাই বিকেলে প্রধানমন্ত্রী গ্রেট হল অব দ্য পিপল -এ চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শি চিনপিং -এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফর উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ও চীন একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করবে। ১১ জুলাই বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রী চীন ত্যাগ করবেন এবং দুপুর ২টায় ঢাকা অবতরণ করার কথা রয়েছে তার।
১৬ ঘণ্টা আগে

পাকিস্তান সফর নিয়ে রোমাঞ্চিত শান্ত
দুটি টেস্ট খেলতে আগামী মাসে পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। বাংলাদেশের সিরিজটিসহ ২০২৪-২৫ মৌসুমের সবকটি আন্তর্জাতিক ব্যস্ততার সূচি প্রকাশ করেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। আগামী ২১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হতে যাওয়া বাংলাদেশের দুই টেস্টের ভেন্যু রাখা হয়েছে রাওয়ালপিন্ডি ও করাচিতে। সিরিজের প্রথম টেস্ট শুরু হবে ২১ আগস্ট, আর দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টটি ৩০ আগস্ট। সবকটি ম্যাচই আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। আসন্ন সফর ঘিরে বেশ রোমাঞ্চিত বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনি জানিয়েছেন, পাকিস্তানের মাটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলতে প্রস্তুত তার দল। গতকাল পিসিবির প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমনটাই বলেছেন শান্ত। নিরাপত্তাজনিত কারণে পাকিস্তানে যখন দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক সিরিজগুলো খেলতে যাচ্ছিল না কোনো দল। ঠিক সে সময় ২০২০ সালের শুরুর দিকে দেশটিতে সফর করেছিলেন সাকিব আল হাসানরা। এরপর করোনা মহামারি ও বিভিন্ন ব্যস্ততায় প্রায় চার বছর কেটে গেলেও আর দেশটিতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে যাওয়া হয়নি তাদের। যদিও সর্বশেষ এশিয়া কাপ খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার আবারও দেশটিতে টেস্ট সিরিজ খেলতে যাবেন শান্তরা। সিরিজটি ঘিরে মুখিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল বলেছেন, ‘আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে দল হিসেবে আমরা পাকিস্তানে ফিরতে মুখিয়ে আছি। পাকিস্তানে খেলা সব সময় চ্যালেঞ্জিং, তবে রোমাঞ্চকর ব্যাপারও।’ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লাল বলে শান্তদের রেকর্ড ভালো নয়। দুদলের দেখা ১৩ ম্যাচের ১২টিতেই জিতেছে পাকিস্তান, একটি ড্র। বাংলাদেশের অর্জনের পাল্লা নেই বললেই চলে। তারপরও এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশা শান্তর, ‘ঘরের মাঠে শক্তিশালী একটি দলের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে আমাদের সেরাটি দিতে হবে।’ আসন্ন সফর নিয়ে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আইসিসি ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচগুলোর সূচি নিশ্চিত করায় আমরা পিসিবিকে ধন্যবাদ জানাই। এ সিরিজে আমাদের পরীক্ষা হবে। কিন্তু এ সংস্করণে আমাদের উন্নতি দেখানোরও সুযোগ এটি।’ পাকিস্তানের পর এ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গেও টেস্ট সিরিজ আছে শান্তদের।
০৬ জুলাই, ২০২৪

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন। টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর এ মেয়াদে এটি তার প্রথম চীন সফর। তিন দিনব্যাপী এ সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত সফরের পর পরই চীন সফরটি আন্তর্জাতিক মহলে গুরুত্ব পাচ্ছে। চীনও প্রধানমন্ত্রীর এ সফরটিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে। গেল জানুয়ারিতে চীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চীন সফরের আহ্বান জানিয়েছিল। কয়েকদিন আগে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করেছেন। সফরে তিনি শেখ হাসিনার সফরের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সফরকালের চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী লিকিয়াং তাকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। দুই সরকার প্রধান সহযোগিতার নথিতে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন। দুই দেশের বন্ধুত্বকে কীভাবে আরও গভীর করা যায়, পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে কীভাবে আরও সম্প্রসারিত করা যায়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায় এ বিষয়ে তারা মতবিনিময় করবেন।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্মান ও সমতার। নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রেখে বিগত ৪৯ বছর ধরে দুটি দেশ একে অপরকে সহযোগিতা করছে। চীনের ৩টি প্রধান বৈশ্বিক উদ্যেগের বাস্তবায়নে এ সফরটি ভূমিকা রাখবে। চীন বাংলাদেশ সম্পর্ক একটি নতুন উচ্চতায় যাবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ এর আওতায় বাংলাদেশে আরও কয়েকটি মেগা প্রজেক্টে চীন বিনিয়োগ করবে এবং বাস্তবায়ন করবে। ইতোমধ্যে চীনের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বের সঙ্গে খবর প্রচার করছে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও এ বিষয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ এর জুন মাসে চীন সফর করেছিলেন। পরে চীনের রাষ্ট্রপতি ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফর করেন। শি-এর সেই সফরে ২৪ টি প্রকল্পের বিপরীতে ২৪ বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট লাইনের আওতায় অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের জন্য চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। গত বছর দুই নেতা ব্রিকস সম্মেলনের সময় সাইড লাইনে মুখোমুখি আলোচনায় বসেন। ইতোমধ্যে আমরা দেখছি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চীন তাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে। এ সম্পকর্কে কেন্দ্র করে চীন বলছে তারা কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারত্বকে ব্যাপকতর কৌশলগত সহযোগিতার  অংশীদারত্বের দিকে নিয়ে যেতে চায়।  তবে সম্পর্কের মাত্রা এগিয়ে যেতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। দুদেশের সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে নিরাপত্তাও অর্থনীতিকে দেখানো হয় যাকে বিশ্লেষকরা টুইন পিলার বলছেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতির বিপরীতে বাংলাদেশ ঋণ চাইবে। অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্বের মতোই চীনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে। রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বা শূন্য শুল্কের ক্ষেত্রে তা শতভাগ উন্নীত করা, রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিশেষ করে গার্মেন্ট পণ্যকে প্রাধান্য দেওয়া, চীনের মার্কেটে বাংলাদেশের শেয়ার বৃদ্ধি বর্তমানে যা মাত্র ০.০৫ শতাংশ। চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতি বছরে ২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা, ঋণের সুদের হার হ্রাস করা, শিক্ষাবৃত্তি বৃদ্ধি করা, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া সহজিকরণ, ঋণ ডলারে না নিয়ে চীনা ইউয়ানে নেওয়া এ বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা যায়। কনস্ট্রাকশন সুপার পাওয়ার খ্যাত চীনের কাছে অবশ্যই আরো কয়েকটি ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই অর্থায়ন চাইবে। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের সাথে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ আরেকটি মেট্রোরেল প্রকল্পে চীনের কাছে অর্থায়ন চাওয়া হবে বলে জানা গেছে। তিস্তার ক্ষেত্রে আমাদের চাহিদার বিপরীতে চীনের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আহবান করা যেতে পারে। অথবা তিস্তা সমস্যার সমাধানে প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের সাথে যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব আহ্বান করা যেতে পারে এবং সেটা অবশ্যই হতে হবে আমাদের চাহিদার বিপরীতে। সামরিক ক্ষেত্রে চীনের অর্থায়ন হ্রাস পেলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তবে অবশ্যই বাণিজ্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি, কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রেও চীনকে আমরা সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে পারি। পরিবেশসংক্রান্ত ইস্যুগুলোতে দুদেশ কিভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারবে এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।  ব্রিকস এর পরবর্তী  সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে চীনের একনিষ্ঠ সমর্থন অথবা প্রকল্প ভিত্তিক ক্ষেত্রগুলোতে ব্রিকসভুক্ত দেশের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে চীনের সমর্থন বা প্রস্তাব আদায়, বেসিক গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশগত ইস্যু নিয়ে আলোচনা সুযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডে চীনের অনুদান এবং ক্ষেত্র বিশেষে সুদহীন অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা সময়ের দাবি। বড় ধরনের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে বাংলাদেশ চীনের কাছে অর্থায়ন চাইতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চীনকে সরাসরি মধ্যস্থতার প্রস্তাব ও বাংলাদেশ দিয়ে রাখতে পারে। আগামী  বছর চীন বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি হতে যাচ্ছে। এ পর্যায়ে চীন বাংলাদেশের সম্পর্কের সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরো সম্প্রসারিত হোক এটাই প্রত্যাশা। লেখক : সৈয়দ সাফিউল হাসান চিশতী, সাবেক ছাত্রনেতা, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আমরা ক’জন মুজিব সেনা, আহ্বায়ক, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ।
০৫ জুলাই, ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে বিদ্যুৎ জ্বালানির সাত প্রস্তাব
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে সাত প্রস্তাব দেওয়া হবে। এর মধ্যে মহেশখালী পাইপলাইন নির্মাণ এবং ছয়টি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ। এতে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রযোজন হবে। বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সচিবালয়ে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এ তথ্য জানান।  তিনি বলেন, আমরা পরিকল্পনা করেছি, ২০২৭ সালের মধ্যে দেশে কোনো গ্যাস সংকট থাকবে না। এ জন্য আমরা বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা চীনকে গ্যাস পাইপলাইনের প্রস্তাব দিচ্ছি। এ ছাড়াও চলতি মাসে নেপালের বিদ্যুৎ আনতে চুক্তি করে ফেলতে পারব বলে আশা করছি- যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী।
০৪ জুলাই, ২০২৪

কাঙ্ক্ষিত সময়ে সফল এক সফর
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল বাংলাদেশকে ঘনিষ্ঠ ও মূল্যবান প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করে ভারত। এসএজিএআর (আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রবৃদ্ধি) মতবাদ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন ছাড়াও বাংলাদেশ ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশী অগ্রাধিকার) এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ (পূর্বমুখী) নীতির একত্র বিন্দু। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নেও বাংলাদেশ অপরিহার্য। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘প্রধান প্রতিবেশী’, ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়) এবং প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করে। এশিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজারও ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনার ভারত সফর বিস্ময়কর ছিল না। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৪০ বছরের তুলনায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ফল অর্জন করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীই সম্পর্কের এই সময়কে ‘সোনালি অধ্যায়’ বা সুবর্ণ যুগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে একটি সংক্ষিপ্ত সফর করেছেন। সংক্ষিপ্ত সফর হলেও এটি ছিল পর্যাপ্ত তাৎপর্যপূর্ণ উপাদানে পূর্ণ; যেখানে দশক ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কূটনৈতিক পরিভাষায় এ সফরকে রাষ্ট্রীয় সফর বলা হয়, যেখানে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয়। তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগদানের দু সপ্তাহ পর এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১-২২ জুনের সফরটি কেবল মোদির তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় সফরই নয়; বরং এটি জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রথম কোনো বিদেশ সফরও। এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটা মোটেও বাহুল্য নয়, বিগত এক দশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাণিজ্য, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, জ্বালানি, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন—প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। দুই দেশের মধ্যকার ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐতিহাসিক মিল সার্বভৌমত্ব, সমতা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি আধুনিক শক্তিশালী অংশীদারত্ব বিকশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য একটি মডেল হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক স্তরে টেকসই সংলাপ এ সম্পর্কে অবদান রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই উল্লেখ করেছেন, গত এক বছরে দুই নেতা ১০ বার সাক্ষাৎ করেছেন। এবারের সফরে দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী ১০টি চুক্তি সই করেন। এর মাধ্যমে চলমান গতিশীল সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এটি দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা জোগায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির কথায়, দুই দেশের রয়েছে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ‘বিকশিত ভারত’ এবং বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করতে চায়। ‘ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি: সমৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি’ পরিবেশ, স্থায়িত্ব ও নীল অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে অংশীদারত্বের কথা বলা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় ভুগছে। এ বিবেচনায় দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্বে মনোযোগ দেওয়া কেবল সময়োপযোগী নয়; বরং অপরিহার্য। সুতরাং ইন্দো-প্যাসিফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভের (আইপিওআই) দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, তা ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে কাজ করা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে সহযোগিতা করতে উভয় দেশের পক্ষে সম্মত হওয়াও স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। উভয় দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল। জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা উভয় দেশের কাছে অগ্রাধিকার পায়। আলোচনার সময় দুই প্রধানমন্ত্রী তথ্য বিনিময়ে অগ্রাধিকার এবং যৌথ নদী কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন পানিবণ্টনের কাঠামো প্রণয়নে সম্মত হন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি (ফারাক্কা বাঁধ) হয়। ২০২৬ সালে চুক্তিটির ৩০ বছর পূর্ণ হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির পুনর্নবীকরণের জন্য আলোচনা শুরু করতে দুই দেশ একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি কয়েক দশকের উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা কমানো এবং ভারতের সুনাম তৈরিতে সহজ করবে। আরেকটি বিষয় হলো, দুই প্রধানমন্ত্রী ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্যও সম্মত হয়েছেন। এ সফরে নতুন একটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য দুই দেশ হাত মিলিয়েছে। তা হলো, মহাকাশ খাত। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সাহায্য করবে ভারত। উভয় দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে জ্বালানি ও ডিজিটাল খাতে সহযোগিতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যৌথ ভিশন অনুযায়ী—ভারত, নেপাল ও ভুটানে ‘ক্লিন এনার্জি প্রকল্প’ থেকে উৎপন্ন আন্তঃআঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জ্বালানি সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ বিদ্যুৎ বাংলাদেশ হয়ে বিহার ও আসামের মধ্যে একটি নতুন ৭৬৫ কেভিওয়াট উচ্চক্ষমতার আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। এ লাইন তৈরিতে অর্থায়ন করবে ভারত। নতুন লাইনটি শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ প্রেরণের সংক্ষিপ্ততম রুট নয়; বরং সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে ট্রানজিট চাপও কমিয়ে দেবে। এ ছাড়া বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করতে দুই দেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। এদিকে মোংলা ও মিরসরাইয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক কার্যক্রম, নতুন সীমান্ত-হাট খোলা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য সুবিধা, সড়ক, রেল, বিমান ও সামুদ্রিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নতি, ‘আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে আমাদের জনগণের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করতে’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আলোচনার অধীনে রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার মূল ভিত্তি হলো আন্তঃসংযোগ। এটি বাণিজ্য এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বহুগুণ প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৬৫ সালের আগে যেসব আন্তঃসীমান্ত সড়ক ও রেল সংযোগ চালু ছিল সেগুলো আবারও চালু করা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিরামহীনভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিষেবা চালু করতে আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন তিনি। এই সংযোগ বৃদ্ধিতে উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ফলে ভারতের রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন এই রেল ট্রানজিট চুক্তিতে রাজশাহী-কলকাতার মধ্যে একটি নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা এবং গেদে-দর্শনা থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ও হাসিমারা হয়ে ভারত-ভুটান সীমান্তে ডালগাঁও পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালুর কথা বলা হয়েছে। দুই দেশ উপ-আঞ্চলিক সংযোগকে উন্নীত করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) মোটর যানবাহন চুক্তি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতিও জোরদার করেছে। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি নতুন বাস সার্ভিসেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব বৃদ্ধির কথাও আলোচনা করেছে দুই দেশ। বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা করবে ভারত। যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়নেও কাজ করা হবে। এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার বাংলাদেশ। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত সফট লোনের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশ এখন একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে কাজ করছে। ফলে দেশ দুটির যৌথ প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতাকে আরও প্রসারিত করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠ সংযোগ অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। জনগণের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো উভয় সরকারের অন্যতম একটি অগ্রাধিকার। বিশেষ করে দেশ দুটি এখানে তাদের যুবসমাজকে প্রাধান্য দিয়েছে। আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে একটি স্বাগত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ঘোষণা ছিল—চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা সুবিধা সম্প্রসারণ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণের জন্য কনস্যুলার এবং ভিসা পরিষেবা দ্রুততর করার লক্ষ্যে রংপুরে ভারতের একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার ঘোষণাও দিয়েছে দিল্লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর এবং ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্থিতিশীল অবস্থায় দেখা গেলেও উভয় পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে। ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হুমকি সদা বর্তমান। পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোও এই হুমকির বাইরে নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ভারতের জন্য উদ্বেগের। এই উদ্বেগগুলো ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিরূপ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই দুই দেশের অংশীদারত্বকে সামনে রেখে এগোতে হবে সচেতনভাবেই। বাংলাদেশ ভারতের সব থেকে ঘনিষ্ঠ এবং মূল্যবান প্রতিবেশী। একই সঙ্গে দেশটি ভারতের জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা খুব দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এটা স্বাভাবিক—ভারত দুদেশের এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে লালন করতে চাইবে। বাংলাদেশের জন্যও ভারত এমন একটি অংশীদার যে, প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে, দেশটির প্রয়োজনে পণ্য সরবরাহ করেছে। নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যে পরীক্ষিত এই বন্ধুত্ব আরও এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে এ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। লেখক: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার (নিবন্ধটি বাংলাদেশের ডেইলি সান থেকে অনূদিত)
০১ জুলাই, ২০২৪

বাণিজ্য-বিনিয়োগ ও ক্রাউন প্রিন্সের সফর প্রাধান্য পাবে
রিয়াদে আজ বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিতীয় রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। এ বৈঠকে আলোচনায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বাংলাদেশি অভিবাসী, রোহিঙ্গা সংকট এবং পারস্পরিক স্বার্থের বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্য পাবে। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ পর্যায়ের এ বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ দুই দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, আইসিটি ও পর্যটন সংক্রান্ত বিষয়েও আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পাবে। এক্ষেত্রে গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি জোর দেওয়া হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনায় তোলা হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা যায়, দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর বাইরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুও উঠে আসবে আলোচনায়। এগুলোর মধ্যে ইয়েমেন পরিস্থিতি, মক্কা-মদিনাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হুতিদের হামলা, ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে একে অপরকে সমর্থনের বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল কালবেলাকে বলেন, দুই দিনের সরকারি সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের আজ সোমবার ভোরে রিয়াদে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। আগামী বুধবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে তার। এ সফরে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রতিনিধিদলের অংশ থাকবেন; কারণ বিনিয়োগের বিষয়গুলো বৈঠকে প্রাধান্য পাবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব (দ্বিপক্ষীয় পূর্ব ও পশ্চিম) মো. নজরুল ইসলাম, সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, পশ্চিম এশিয়া অণুবিভাগের মহাপরিচালক শফিকুর রহমান এবং পরিচালক নাফিসা মনসুর। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল-সৌদ, যিনি সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রীও। এ বছরের শেষের দিকে তার বাংলাদেশে সরকারি সফরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এর আগে এ বছর বাংলাদেশ সফরের জন্য সৌদি ক্রাউন প্রিন্স প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। সৌদি যুবরাজের বাংলাদেশ সফরের বিস্তারিত চূড়ান্ত করার বিষয়ও বৈঠকে আলোচনা হতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ১৯৮৫ সালের পর সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের ঢাকা সফরের পর এটিই হবে কোনো সৌদি যুবরাজের প্রথম বাংলাদেশ সফর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক ঘটনা হবে, যা বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুদেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের বাংলাদেশ সফরে বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক এবং চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে দৃঢ় করবে বলে আশা করছে ঢাকা। এর আগে ২০২২ সালের ১৬ মার্চ ঢাকায় বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে প্রথম রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান স্থায়ী বন্ধন এবং বন্ধুত্বের বন্ধন পুনঃনিশ্চিত করতে এবং দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। বেশ কিছু সৌদি কোম্পানি এরই মধ্যে বাংলাদেশে কিছু খাতে বিনিয়োগ করেছে এবং আরও কিছু কোম্পানি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি সম্পৃক্ততার কথা ভাবছে।
০১ জুলাই, ২০২৪

কাঙ্ক্ষিত সময়ে সফল এক সফর
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল বাংলাদেশকে ঘনিষ্ঠ ও মূল্যবান প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করে ভারত। এসএজিএআর (আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রবৃদ্ধি) মতবাদ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন ছাড়াও বাংলাদেশ ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশী অগ্রাধিকার) এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ (পূর্বমুখী) নীতির একত্র বিন্দু। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নেও বাংলাদেশ অপরিহার্য। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘প্রধান প্রতিবেশী’, ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়) এবং প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করে। এশিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজারও ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনার ভারত সফর বিস্ময়কর ছিল না। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৪০ বছরের তুলনায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ফল অর্জন করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীই সম্পর্কের এই সময়কে ‘সোনালি অধ্যায়’ বা সুবর্ণ যুগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে একটি সংক্ষিপ্ত সফর করেছেন। সংক্ষিপ্ত সফর হলেও এটি ছিল পর্যাপ্ত তাৎপর্যপূর্ণ উপাদানে পূর্ণ; যেখানে দশক ধরে গড়ে ওঠা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কূটনৈতিক পরিভাষায় এ সফরকে রাষ্ট্রীয় সফর বলা হয়, যেখানে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয়। তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগদানের দু সপ্তাহ পর এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১-২২ জুনের সফরটি কেবল মোদির তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় সফরই নয়; বরং এটি জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রথম কোনো বিদেশ সফরও। এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটা মোটেও বাহুল্য নয়, বিগত এক দশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাণিজ্য, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, জ্বালানি, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন—প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। দুই দেশের মধ্যকার ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐতিহাসিক মিল সার্বভৌমত্ব, সমতা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি আধুনিক শক্তিশালী অংশীদারত্ব বিকশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য একটি মডেল হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক স্তরে টেকসই সংলাপ এ সম্পর্কে অবদান রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই উল্লেখ করেছেন, গত এক বছরে দুই নেতা ১০ বার সাক্ষাৎ করেছেন। এবারের সফরে দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী ১০টি চুক্তি সই করেন। এর মাধ্যমে চলমান গতিশীল সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এটি দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা জোগায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির কথায়, দুই দেশের রয়েছে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ‘বিকশিত ভারত’ এবং বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করতে চায়। ‘ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি: সমৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি’ পরিবেশ, স্থায়িত্ব ও নীল অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে অংশীদারত্বের কথা বলা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় ভুগছে। এ বিবেচনায় দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্বে মনোযোগ দেওয়া কেবল সময়োপযোগী নয়; বরং অপরিহার্য। সুতরাং ইন্দো-প্যাসিফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভের (আইপিওআই) দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, তা ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে কাজ করা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে সহযোগিতা করতে উভয় দেশের পক্ষে সম্মত হওয়াও স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। উভয় দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল। জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা উভয় দেশের কাছে অগ্রাধিকার পায়। আলোচনার সময় দুই প্রধানমন্ত্রী তথ্য বিনিময়ে অগ্রাধিকার এবং যৌথ নদী কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন পানিবণ্টনের কাঠামো প্রণয়নে সম্মত হন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি (ফারাক্কা বাঁধ) হয়। ২০২৬ সালে চুক্তিটির ৩০ বছর পূর্ণ হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির পুনর্নবীকরণের জন্য আলোচনা শুরু করতে দুই দেশ একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি কয়েক দশকের উত্তেজনা-দুশ্চিন্তা কমানো এবং ভারতের সুনাম তৈরিতে সহজ করবে। আরেকটি বিষয় হলো, দুই প্রধানমন্ত্রী ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্যও সম্মত হয়েছেন। এ সফরে নতুন একটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য দুই দেশ হাত মিলিয়েছে। তা হলো, মহাকাশ খাত। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সাহায্য করবে ভারত। উভয় দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে জ্বালানি ও ডিজিটাল খাতে সহযোগিতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যৌথ ভিশন অনুযায়ী—ভারত, নেপাল ও ভুটানে ‘ক্লিন এনার্জি প্রকল্প’ থেকে উৎপন্ন আন্তঃআঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জ্বালানি সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ বিদ্যুৎ বাংলাদেশ হয়ে বিহার ও আসামের মধ্যে একটি নতুন ৭৬৫ কেভিওয়াট উচ্চক্ষমতার আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। এ লাইন তৈরিতে অর্থায়ন করবে ভারত। নতুন লাইনটি শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ প্রেরণের সংক্ষিপ্ততম রুট নয়; বরং সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে ট্রানজিট চাপও কমিয়ে দেবে। এ ছাড়া বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করতে দুই দেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। এদিকে মোংলা ও মিরসরাইয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক কার্যক্রম, নতুন সীমান্ত-হাট খোলা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য সুবিধা, সড়ক, রেল, বিমান ও সামুদ্রিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নতি, ‘আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে আমাদের জনগণের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করতে’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আলোচনার অধীনে রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার মূল ভিত্তি হলো আন্তঃসংযোগ। এটি বাণিজ্য এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বহুগুণ প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৬৫ সালের আগে যেসব আন্তঃসীমান্ত সড়ক ও রেল সংযোগ চালু ছিল সেগুলো আবারও চালু করা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিরামহীনভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিষেবা চালু করতে আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন তিনি। এই সংযোগ বৃদ্ধিতে উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ফলে ভারতের রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন এই রেল ট্রানজিট চুক্তিতে রাজশাহী-কলকাতার মধ্যে একটি নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা এবং গেদে-দর্শনা থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ও হাসিমারা হয়ে ভারত-ভুটান সীমান্তে ডালগাঁও পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালুর কথা বলা হয়েছে। দুই দেশ উপ-আঞ্চলিক সংযোগকে উন্নীত করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) মোটর যানবাহন চুক্তি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতিও জোরদার করেছে। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি নতুন বাস সার্ভিসেরও পরিকল্পনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব বৃদ্ধির কথাও আলোচনা করেছে দুই দেশ। বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা করবে ভারত। যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়নেও কাজ করা হবে। এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার বাংলাদেশ। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত সফট লোনের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশ এখন একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে কাজ করছে। ফলে দেশ দুটির যৌথ প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতাকে আরও প্রসারিত করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠ সংযোগ অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। জনগণের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো উভয় সরকারের অন্যতম একটি অগ্রাধিকার। বিশেষ করে দেশ দুটি এখানে তাদের যুবসমাজকে প্রাধান্য দিয়েছে। আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে একটি স্বাগত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ঘোষণা ছিল—চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা সুবিধা সম্প্রসারণ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণের জন্য কনস্যুলার এবং ভিসা পরিষেবা দ্রুততর করার লক্ষ্যে রংপুরে ভারতের একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার ঘোষণাও দিয়েছে দিল্লি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর এবং ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্থিতিশীল অবস্থায় দেখা গেলেও উভয় পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে। ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হুমকি সদা বর্তমান। পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোও এই হুমকির বাইরে নয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ভারতের জন্য উদ্বেগের। এই উদ্বেগগুলো ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিরূপ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই দুই দেশের অংশীদারত্বকে সামনে রেখে এগোতে হবে সচেতনভাবেই। বাংলাদেশ ভারতের সব থেকে ঘনিষ্ঠ এবং মূল্যবান প্রতিবেশী। একই সঙ্গে দেশটি ভারতের জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা খুব দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এটা স্বাভাবিক—ভারত দুদেশের এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে লালন করতে চাইবে। বাংলাদেশের জন্যও ভারত এমন একটি অংশীদার যে, প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে, দেশটির প্রয়োজনে পণ্য সরবরাহ করেছে। নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যে পরীক্ষিত এই বন্ধুত্ব আরও এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে এ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। লেখক: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার (নিবন্ধটি বাংলাদেশের ডেইলি সান থেকে অনূদিত)
০১ জুলাই, ২০২৪

ভারতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী : কাঙ্ক্ষিত সময়ে সফল এক সফর
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দ্রুত বর্ধনশীল বাংলাদেশকে ঘনিষ্ঠ এবং মূল্যবান প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করে ভারত। এসএজিএআর (আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও প্রবৃদ্ধি) মতবাদ এবং নয়াদিল্লির ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন ছাড়াও বাংলাদেশ ভারতের ‘প্রথম প্রতিবেশী’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির একত্র বিন্দু। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নেও বাংলাদেশ একটি অপরিহার্য অংশীদার। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘প্রধান প্রতিবেশী’, ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথায়) এবং একটি প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে মূল্যায়ন করে। এ ছাড়া এশিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজারও ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনার ভারত সফর বিস্ময়কর কিছু ছিল না। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ৪০ বছরের তুলনায় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট ফল অর্জন করেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীই সম্পর্কের এই সময়কে ‘সোনালি অধ্যায়’ বা সুবর্ণ যুগ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।  সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লিতে একটি সংক্ষিপ্ত সফর করেছেন। তবে এ সফর পর্যাপ্ত রূপান্তরমূলক উপাদানে ভরপুর, যেটিতে দশক ধরে গড়ে উঠা সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কূটনৈতিক পরিভাষায় এ সফরকে রাষ্ট্রীয় সফর বলা হয়, যেখানে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানানো হয়। তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগদানের ঠিক একপাক্ষিক পরে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।   সেই দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১-২২ জুনের সফরটি কেবল মোদির তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় সফর নয়, বরং এটি জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রথম কোনো বিদেশ সফর। এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এটা মোটেও বাহুল্য নয় যে, বিগত এক দশকে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বাণিজ্য, নিরাপত্তা, যোগাযোগ, জ্বালানি, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি, জনগণের মধ্যে আদান-প্রদান এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন– প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে।  দুই দেশের মধ্যকার ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐতিহাসিক মিল সার্বভৌমত্ব, সমতা, বিশ্বাস এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি আধুনিক শক্তিশালী অংশীদারত্বে বিকশিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়া এবং এর বাইরেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য একটি মডেল হিসেবে গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর স্তরসহ একাধিক স্তরে টেকসই সংলাপ এ সম্পর্কে অবদান রেখেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই উল্লেখ করেছেন, গত এক বছরে দুই নেতা ১০ বার সাক্ষাৎ করেছেন। এবারের সফরে দুই দেশের দুই প্রধানমন্ত্রী ১০টি চুক্তি সই করেন। এর মাধ্যমে বর্তমান গতিশীল সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। যা দ্বিপাক্ষিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য দিকনির্দেশনা ও প্রেরণা জোগায়। প্রধানমন্ত্রী মোদির কথায়, দুই দেশের রয়েছে সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গি। ভারত ২০৪৭ সালের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ‘বিকশিত ভারত’ এবং বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করতে চায়। ‘ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গি : সমৃদ্ধির জন্য যোগাযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধি’ পরিবেশ, স্থায়িত্ব ও নীল অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রগুলোতে অংশীদারত্বের কথা বলা হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যায় ভুগছে। এ বিবেচনায় দ্বিপাক্ষিক অংশীদারত্বে মনোযোগ দেওয়া কেবল সময়োপযোগী নয়, বরং অপরিহার্য। সুতরাং ইন্দো-প্যাসিফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভের (আইপিওআই) দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, তা ব্যবস্থাপনায় একসঙ্গে কাজ করা এবং দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে সহযোগিতা করতে উভয় দেশের পক্ষে সম্মত হওয়াও স্বাভাবিক ছিল।  ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। উভয় দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এসব নদীর ওপর নির্ভরশীল। জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা উভয় দেশের কাছে অগ্রাধিকার পায়। আলোচনার সময় দুই প্রধানমন্ত্রী তথ্য বিনিময়ে অগ্রাধিকার এবং যৌথ নদী কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন পানিবণ্টনের কাঠামো প্রণয়নে সম্মত হন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি (ফারাক্কা বাঁধ) হয়। ২০২৬ সালে চুক্তিটির ৩০ বছর পূর্ণ হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির পুনর্নবীকরণের জন্য আলোচনা শুরু করতে দুই দেশ একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করেছে।  এ চুক্তি স্বাক্ষরকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। এ ছাড়া এর মাধ্যমে কয়েক দশকের দুশ্চিন্তা কমানো এবং ভারতের জন্য সুনাম তৈরি করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, দুই প্রধানমন্ত্রী ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্যও সম্মত হয়েছেন। এ সফরে নতুন একটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য দুই দেশ হাত মিলিয়েছে। তা হলো, মহাকাশ খাত। চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সাহায্য করবে ভারত৷ উভয় দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে জ্বালানি ও ডিজিটাল খাতে সহযোগিতার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। যৌথ ভিশন অনুযায়ী- ভারত, নেপাল ও ভুটানে ‘ক্লিন এনার্জি প্রকল্প’ থেকে উৎপন্ন আন্তঃআঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জ্বালানি সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ বিদ্যুৎ বাংলাদেশ হয়ে বিহার ও আসামের মধ্যে একটি নতুন ৭৬৫ কেভিওয়েট উচ্চক্ষমতার আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। এ লাইন তৈরিতে অর্থায়ন করবে ভারত। নতুন লাইনটি শুধু ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ প্রেরণের সংক্ষিপ্ততম রুট নয়; বরং সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরে ট্রানজিট চাপও কমিয়ে দেবে। এ ছাড়া বাণিজ্যকে আরও গতিশীল করার জন্য দুই দেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করবে। এদিকে মোংলা ও মিরসরাইয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রাথমিক কার্যক্রম, নতুন সীমান্ত-হাট খোলা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য সুবিধা, সড়ক, রেল, বিমান ও সামুদ্রিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য অবকাঠামোর উন্নতি, ‘আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে আমাদের জনগণের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করতে’ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আলোচনার অধীনে রয়েছে।  ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার মূল ভিত্তি হলো আন্তঃসংযোগ। এটি বাণিজ্য এবং দুদেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্কের ওপর বহুগুণ প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৬৫ সালের আগে যেসব আন্তঃসীমান্ত সড়ক ও রেল সংযোগ চালু ছিল সেগুলো আবারও চালু করা হয়েছে। দুদেশের মধ্যে বিরামহীনভাবে যাত্রী ও পণ্য পরিষেবা চালু করতে আরও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন তিনি। এই সংযোগ বৃদ্ধিতে উপ-আঞ্চলিক উদ্যোগও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ফলে ভারতের রেলপথ ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন করতে পারবে বাংলাদেশ।  বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন এই রেল ট্রানজিট চুক্তিতে রাজশাহী-কলকাতার মধ্যে একটি নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন পরিষেবা এবং গেদে-দর্শনা থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ও হাসিমারা হয়ে ভারত-ভুটান সীমান্তে ডালগাঁও পর্যন্ত একটি পণ্যবাহী ট্রেন পরিষেবা চালুর কথা বলা হয়েছে। দুই দেশ উপ-আঞ্চলিক সংযোগকে উন্নীত করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) মোটর যানবাহন চুক্তি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতিও জোরদার করেছে। কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি নতুন বাস সার্ভিসেরও কল্পনা করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব বৃদ্ধির কথাও বলেছে দুই-দেশ। বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা করবে ভারত। যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়নেও কাজ করা হবে।  এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার বাংলাদেশ। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত সফট লোনের পরিমাণ প্রায় $১০ বিলিয়ন। দুই দেশ এখন একটি নতুন ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তিতে কাজ করছে। ফলে দেশ দুটির যৌথ প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতাকে আরও প্রসারিত করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের এই ঘনিষ্ঠ সংযোগ অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।  জনগণের মধ্যে সংযোগ বাড়ানো উভয় সরকারের অন্যতম একটি অগ্রাধিকার। বিশেষ করে দেশ দুটি এখানে তাদের যুবসমাজের কথা চিন্তা করেছে। আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে একটি স্বাগত এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ঘোষণা ছিল- চিকিৎসার জন্য আসা বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ই-মেডিকেল ভিসা সুবিধা সম্প্রসারণ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণের জন্য কনস্যুলার এবং ভিসা পরিষেবা দ্রুততর করার লক্ষ্যে রংপুরে ভারতের একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খোলার ঘোষণাও দিয়েছে দিল্লি।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর এবং ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্থিতিশীল অবস্থায় দেখা গেলেও উভয় পক্ষকেই সচেতন থাকতে হবে। ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদের হুমকি সদা বর্তমান। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোও এই হুমকির বাইরে নয়। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ভারতের জন্য উদ্বেগের। এই উদ্বেগগুলো ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ককে বিরূপ পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই দু-দেশের অংশীদারত্বকে সামনে রেখে সচেতনভাবেই এগোতে হবে। বাংলাদেশ ভারতের সব থেকে ঘনিষ্ঠ এবং মূল্যবান প্রতিবেশী। একই সঙ্গে দেশটি ভারতের জন্য একটি অপরিহার্য অংশীদার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে খুব দ্রুতই। তাই এটা স্বাভাবিক- ভারত দু’দেশের এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে লালন করতে চাইবে। বাংলাদেশের জন্যও ভারত এমন একটি অংশীদার যে, প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে, দেশটির প্রয়োজনে পণ্য সরবরাহ করেছে। নিঃসন্দেহে দুই দেশের মধ্যে পরীক্ষিত এই বন্ধুত্ব আরও এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে এ বন্ধুত্ব নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।  হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা: ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার
৩০ নভেম্বর, ০০০১

ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছে তা গোলামির নবতর সংস্করণ মাত্র।  রোববার (৩০ জুন) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সর্বশেষ দিল্লি সফরটি কার্যতই একপাক্ষিক। এ সফরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা কিংবা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থ সুনিশ্চিত করে না। তাছাড়া আলোচনায় এমন কিছু বিষয় এসেছে যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।  গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। মির্জা ফখরুল বলেন, কানেক্টিভিটির নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এক অংশ থেকে আরেক অংশ পর্যন্ত রেল যোগাযোগের নামে করিডোর প্রদানের মাধ্যমে যা করা হয়েছে তাতে আমাদের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। নিশ্চয়ই ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের গোলামি চুক্তির কথা স্মরণ আছে। ৫২ বছর পর সে ধারাবাহিকতায় গত ২২ জুন ভারতের সঙ্গে সমঝোতার আড়ালে যেসব চুক্তি করা হলো তা বাংলাদেশকে আজীবনের জন্য ভারতের গোলামে পরিণত করবে। এর ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব চুক্তি-স্মারকের মাধ্যমে আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে ভারতের জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার অংশে পরিণত করা হয়েছে, যা খুবই বিপজ্জনক এবং দেশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি। এটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থি।  তিনি বলেন, বস্তুত এসব সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নিরাপত্তা কৌশলগত ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে চায়। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে। যে ৭টি সমঝোতা স্মারক নতুন করে সই করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক। প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’-কে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব সমঝোতা চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এহেন চুক্তি জনগণ মেনে নেবে না।  বিএনপির মহাসচিব বলেন, শাসক গোষ্ঠী দাবি করে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘অনন্য উচ্চতায়’ পৌঁছেছে। কিন্তু সম্পর্কের তথাকথিত ‘সোনালি অধ্যায়’- এর সময়কালে বাংলাদেশের জনগণের তরফে প্রাপ্তি শূন্যের কোঠায়। এ সময়ে দুই দেশের মধ্যকার লেনদেনের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে কানেক্টিভিটির নামে একের পর এক ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা প্রদান। ট্রানজিট-করিডোর দেওয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ঝুঁকি সত্ত্বেও সবকিছুই একতরফাভাবে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।  মির্জা ফখরুল বলেন, একদিকে ভারত পেয়েছে অবাধ স্থল ও নৌ ট্রানজিট যা ভারতের অবশিষ্ট অংশের সঙ্গে উত্তর পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্সের যোগাযোগের সময় ও দৈর্ঘ্য কমিয়েছে সর্বনিম্ন প্রায় তিন চতুর্থাংশ। কলকাতা আগরতলার ১৭০০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কিলোমিটারে। ভারত পেয়েছে বাংলাদেশের পায়রা, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধা।  অন্যদিকে বাংলাদেশ নেপালের মাত্র ২১/২২ কিলোমিটারের ট্রানজিট সুবিধা ভারতের কাছে থেকে আদায় করতে পারেনি। একতরফা আগ্রাসী বাণিজ্যে বাংলাদেশকে ভারতের অবাধ বিপণিকেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। দুই দেশের সামগ্রিক ২৬ বিলিয়ন বাৎসরিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র দুই বিলিয়ন। এর মাঝেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। তীব্র বেকারত্বের বাংলাদেশে কাজ করছে লাখ লাখ ভারতীয় যুবক। ভারতের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান উৎসের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪ নম্বরে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, গত ১০ মাসে ভারতীয়রা নিয়ে গেছে ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার। আমরা জানি, এর বাইরেও অবৈধ পন্থায় নিয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ ডলার। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অবৈধ সরকার অনেক আগেই স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যত অক্ষম হয়ে পড়েছে। তারা রাষ্ট্রের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কেবলমাত্র ক্ষমতার দখলদারত্ব অব্যাহত রাখতে দেশি-বিদেশি সহযোগী গোষ্ঠী কিংবা প্রভুদের নিরন্তর আস্থা অর্জনে সচেষ্ট। ‘ঢাকা ও দিল্লি নতুন যাত্রা শুরু করেছে, উভয় দেশ রূপকল্প ২০৪১ ও বিকশিত ভারত ২০৪৭ অনুসরণ করে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে’- শেখ হাসিনার এ বক্তব্যের মাধ্যমেই তার ভারত সফরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। যা দেশবাসীও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। এ সফরসহ ভারতের সঙ্গে ইতোপূর্বে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি অবিলম্বে জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি জানাচ্ছি। আমরা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী এসব চুক্তি জনগণ কখনো মেনে নেবে না। বিএনপি এসব দেশবিরোধী চুক্তি/সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করছে। সর্বশেষে, আপনাদের মাধ্যমে সমগ্র দেশবাসীর সামনে আবারও উল্লেখ করতে চাই, শেখ হাসিনার বর্তমান অবৈধ সরকার একটি অনির্বাচিত সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ন্যূনতম নৈতিক অধিকার নেই। আর এরকম একটি জনম্যান্ডেটবিহীন অনৈতিক সরকারের সঙ্গে যে কোনো রাষ্ট্রীয় চুক্তি— তা সমঝোতা কিংবা অন্য যে নামেই হোক না কেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির এই যুগে সব বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অংশদারত্ব বাড়াতে নানাভাবে কানেক্টিভিটি তৈরি করার পক্ষেই বিএনপির অবস্থান।
৩০ জুন, ২০২৪
X