প্রাণে বাঁচতে সবাই পালালেও সংসার ছাড়েন না ‘মা’
ঘূর্ণিঝড় এলেই আতঙ্কে থাকেন দেশের উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দারা। আতঙ্কের মাঝেও ছেলে সন্তানকে আগলে রাখতে ব্যস্ত থাকেন মায়েরা। ঝড়ের তীব্রতার মাঝে সবাই বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও যেতে চান না শুধু মা। পরম মায়ায় ভিটেমাটি আগলে সেখানে অবস্থান করেন তারা।
শুধু উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দারাই জানেন ঘূর্ণিঝড় কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মায়েরা কতটা কষ্ট করে থাকেন। ঘূর্ণিঝড়ে তীব্র বাতাসে বাড়িঘরের ছাদ, টিন, আসবাবপত্র উড়িয়ে নিয়ে গেলেও শেষ অবলম্বনটুকু টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন যিনি- তিনি হলেন মা।
মায়ের ভালোবাসা সবসময়ই অতুলনীয়। ঝড়, বৃষ্টি রোদে সবাই নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও মায়েরা সবাইকে নিয়ে টিকে থাকতে চান। বাংলাদেশ আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। সেগুলোর ক্ষত এতটাই তীব্র হয় যে, পরবর্তীতে সেখানে ফের বসবাস উপযোগী করতে কয়েক বছর সময় লেগে যায় সেখানকার বাসিন্দাদের।
তবে উপকূলীয় অঞ্চলের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বেশিরভাগ নারীরা আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চান না। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি বা সিপিপির স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, বেশিরভাগ নারীরা অসেচতন। বারবার বলার পরও তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না।
উল্লেখ্য, রোববার (২৬ মে) সন্ধ্যায় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চল। প্রায় ৭ ঘণ্টাব্যাপী প্রচণ্ড শক্তির ঘূর্ণিঝড়ে প্লাবিত এবং তছনছ হয়ে গেছে বহু জনপদ, ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, গাছপালা, মাছের ঘের, ফসলের ক্ষেত, দোকানপাট, বাতিল হয়েছে বিমানের বহু ফ্লাইট।
সোমবার (২৮ মে) সকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ সাত জেলায় প্রাণহানি ঘটেছে অন্তত ১৬ জনের।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১০৭টি উপজেলার সাড়ে ৩৭ লাখ মানুষ। পৌনে ৩ কোটি গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছেদ পড়েছে। ১৫ হাজার মোবাইল টাওয়ার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। এ ছাড়া আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি।
ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, ফেনী, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর।
রিমালের আঘাতে মারা যাওয়াদের মধ্যে রয়েছে- ঢাকায় ৪, ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ১২ জন।
রিমালের প্রভাবে রাজধানীতে বৃষ্টির মধ্যে বিদ্যুৎস্পর্শে আলাদা ঘটনায় নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।
মৃতরা হলেন- খিলগাঁও রিয়াজবাগ এলাকার রিকশার গ্যারেজে বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়া রাকিব (২৫), খিলগাঁও সিপাহিবাগে রাস্তায় জমে থাকা পানির মধ্যে বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়া মরিয়ম বেগম (৪৫), যাত্রাবাড়ীতে টিনের প্রাচীর স্পর্শ করে বিদ্যুৎস্পর্শ হওয়া লিজা আক্তার (১৬) ও অপরজন বাড্ডার বাসিন্দা। তার নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ভোলায় বসতঘরে গাছ পড়ে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলার লালমোহন উপজেলার পশ্চিম চরউম্মেদ ইউনিয়নে তীব্র বাতাসে টিনের ঘরে গাছ পড়ে মনেজা (৫৪) নামে একজনের মৃত্যু হয়। গাছের ডাল পড়ে জেলার বোরহানউদ্দিনে সাচড়া ৬নং ওয়ার্ডে জাহাঙ্গীর (৫০) নামে আরেকজন ও দৌলতখান পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডে বসতঘরে গাছ পড়ে মাইশা নামের ৪ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকত মোড়ল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. শরীফ (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়।
এ ছাড়া বাউফলে ঘরের নিচে চাপা পড়ে করিম খানের (৬২) মৃত্যু হয়েছে। বরিশালে রিমালের প্রভাবে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন একটি বিল্ডিংয়ের ৩য় তলার দেয়াল ধসে লোকমান হোটেলের মালিকসহ ২ জন মারা গেছেন। তারা হলেন- লোকমান (৫৫) ও মোকলেস (২৫)। এ ছাড়া জালাল সিকদার নামের আরও একজন মারা গেছেন।
কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক যুবক মারা গেছেন। যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬)।
খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও বৃষ্টিতে ঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
২৮ মে, ২০২৪