লালমাই পাহাড়জুড়ে মৌ মৌ করছে কাঁঠালের ঘ্রাণ
কুমিল্লা ঐতিহ্যবাহী লালমাই পাহাড় ও গোমতী নদীর বেড়িবাঁধের ওপর এ বছর কাঁঠালের বাম্পার ফলন হয়েছে। লালমাই পাহাড়ের আশপাশের বাজারগুলোয় এখন কাঁঠাল আর কাঁঠাল। এদিকে গোমতী নদীর বেড়িবাঁধের ওপর প্রতিদিন বিকেল হলেই বসে কাঁঠালের হাট। লালমাই পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলার চূড়া, ঢাল ও টিলার ফাঁকে-ফাঁকে, পাহাড়ের পাদদেশে ও আশপাশের সমতল ভূমিতে গাছে গাছে প্রচুর কাঁঠাল ধরেছে। পাকা সুমিষ্ট কাঁঠালের গন্ধ পুরো পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে এখন কাঁঠাল বিক্রির ধুম লেগেছে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে হাটবারে বিক্রির জন্য সাইকেলসহ বিভিন্ন বাহনে নেওয়া হচ্ছে কাঁঠাল। কেউ-কেউ স্বজনদের বাড়িতে কাঁঠাল পাঠাচ্ছেন। কেউ জামাই আদর করে দাওয়াত দিয়ে কাঁঠাল খাওয়াচ্ছেন। এ ছাড়া বাজারে কাঁঠালের ভালো দামও পাচ্ছেন। গোমতী নদীর বেড়িবাঁধের উত্তর পাড় সারিসারি কাঁঠাল গাছ। তাতে ধরেছে হাজার হাজার কাঁঠাল। যা দেখলে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। শহরের নিকটবর্তী গোমতী নদী হওয়ায় কাঁঠালের দৃশ্য দেখার জন্য নগরীর বাসিন্দারা ছুটে যান গোমতী নদীর পাড়ে। অন্যদিকে কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে লালমাই পাহাড়। ১২ মাইল লম্বা ও সর্বোচ্চ ৩ কিলোমিটার প্রস্থের এই পাহাড়ের যেদিকে যত দূর চোখ যায়, শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। ছোট-বড় সব গাছেই কাঁঠাল ফলেছে। গাছের গোড়া থেকে মগডাল পর্যন্ত শোভা পাচ্ছে কাঁঠাল। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার চন্ডীমুড়া মন্দির, ধর্মপুর, লালমাই, লালমাই সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস, বড় ধর্মপুর, রতনপুর, বিজয়পুর, মধ্যম বিজয়পুর, রাজারখলা, চৌধুরীখলা, জামমুড়া, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বন বিভাগ, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), কুমিল্লা সেনানিবাস, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, ফায়ারিং স্কোয়াড ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কুমিল্লা সেক্টরে এবার বেশি পরিমাণে কাঁঠাল ধরেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ কুমিল্লা সেক্টরের সব গাছেই কাঁঠাল ধরেছে। বিজিবির মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ছোট-ছোট গাছেও দেখা গেছে বড় আকৃতির কাঁঠাল ঝুলে আছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের অনুচ্চ ও সরু পাহাড়শ্রেণি এলাকায় এক গাছেই ধরেছে অন্তত ৫০টির মতো কাঁঠাল। কুমিল্লার লালমাই, রতনপুর, চন্ডীমুড়া, বাতাইছড়ি বাজার, কোটবাড়ি বাজার, বিজয়পুর বাজারে প্রচুর কাঁঠাল উঠছে। এবার কাঁঠালের দাম আকারভেদে সর্বনিম্ন ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা পর্যন্ত। রতনপুর বাজারের বিক্রেতা মনির হোসেন বলেন, এখন পুরোদমে কাঁঠাল বিক্রি হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার দাম একটু বেশি। লালমাই পাহাড়ের কাঁঠালের ঐতিহ্য আছে। একটি কাঁঠাল বাগানের মালিক সফিকুল ইসলাম জানান, লালমাই পাহাড়ের কাঁঠাল কুমিল্লার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশই। লাল মাটিতে কাঁঠালের ফলন বেশি হয়ে থাকে। লালমাই পাহাড়ের মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য উপযোগী। এই মাটিতে কাঁঠাল ফলনের সব উপাদান রয়েছে। এসব কারণে লালমাই পাহাড়ে প্রতিবছরই কাঁঠালের বাম্পার ফলন হচ্ছে। পাহাড়ের ছোট গাছেও কাঁঠাল ঝুলছে। এই মৌসুমে শখ করে হলেও মানুষ লালমাইয়ের কাঁঠাল কেনেন।
২৯ মে, ২০২৪

লালমাই পাহাড়ে আলো ছড়াচ্ছে ‘জাপানি স্কুল’
কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বড় একটি এলাকায় পাহাড়ি শিশুদের শিক্ষার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অকালেই ঝরে যায় সেসব এলাকার পাহাড়ি শিশুরা। সেসব শিশুদের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে ‌‘মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল’। যা জাপানি স্কুল হিসেবে জেলাজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে।  স্কুলটিতে বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ে, বাংলা অক্ষর ও শব্দসহ বাঙালি সিলেবাসে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। জাপানি অক্ষর কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা কোনো ছিটেফোটাও  নেই, তবুও স্কুলটি জাপানি স্কুল হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে।  লালমাই পাহাড়ের বুকে শিক্ষার আলো ছড়ানো স্কুলটি কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বারোপাড়া ইউনিয়নের বড় ধর্মপুর এলাকায়। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক চারলেন সড়কের রতনপুর থেকে পশ্চিম দিকে ২ কিলোমিটার পথ। লালমাটির পাহাড়ের বুকে এ যেন এক মনোযোগ আকর্ষণ করা ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ২০১৬ সালে। স্কুলটি জাপানি স্কুল হিসেবে পরিচিতির রহস্য হলো- স্কুলটি নির্মাণ করেন মূলত তোশিকো অনিশি নামের একজন জাপানি নাগরিক ও তার বন্ধুরা। তিনি জাপানের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। তারিকুল ইসলাম মজুমদার নামের এক বাঙালির সাথে বন্ধুত্ব তার। একবার তিনিসহ বেশ কয়েকজন জাপানি কুমিল্লায় আসেন তারিকুল ইসলাম মজুমদারের আমন্ত্রণে। পাহাড়ি এলাকায় শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের কথা ভেবে তারিকুল ইসলাম মজুমদারের প্রস্তাবে তোশিকো অনিশিসহ বেশ কয়েকজন জাপানি স্কুলটি নির্মাণ করেন। শুধু স্কুল নির্মাণই নয়। এখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার যাবতীয় খরচ, দুপুরের খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খেলনার সামগ্রী, শিক্ষকদের বেতনভাতাসহ যাবতীয় খরচ বহন করেন জাপানিজরা। স্কুলটিতে মাসে প্রায় ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ হয় তাদের। আনুষঙ্গিক খরচ জমিদাতা তারিকুল ইসলাম মজুমদার বহন করেন। জাপানিরা প্রতি বছর স্কুলটি পরিদর্শনে আসেন। স্কুলে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দিনভর খেলাধুলা, আড্ডা দেওয়াসহ সারা দিন সময় কাটান।  স্কুল শিক্ষার্থীদের কলম, পেন্সিল, খাতা, স্কুল ড্রেস ও খেলনাসমাগ্রীসহ যাবতীয় খরচ স্কুল কর্তৃপক্ষ বহন করে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এসব শিক্ষার্থীদের গরম ভাত, বাহারি তরকারি আর মাছ-মাংস দিয়ে খাওয়ানো হয় দুপুরের খাবার। তবে তাদের পাঠ্যবই দেওয়া হয় সরকারিভাবে। বই ছাড়া যাবতীয় সব শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হয় স্কুল থেকেই। স্কুলটিতে বিনামূল্যেই পড়তে পারেন শিক্ষার্থীরা।  নিরাপত্তার জন্য স্কুলটির চারপাশে সীমানায় সাপ যেন আসতে না পারে সেজন্য তৈরি করা হয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি বিশেষ এক প্রাচীর। যা স্কুলের সীমানায় সাপ প্রবেশ রোধ করছে। মনোরম পরিবেশে, সবুজ পাহাড়ের বুকে ৩ তলা ভবনে গড়া হয় স্কুলটি। প্রতিটি শ্রেণির জন্য আলাদা শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীদের বসার জন্য বিশেষভাবে তৈরি প্লাস্টিকের বেঞ্চ-টেবিল। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য নজর কাড়া ইউনিফর্ম। তবে ইউনিফর্মটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ছেলেদের জন্য সাদা শার্টের বুকে একটি লাল সূর্য আর সবুজ রঙের ফুলপ্যান্ট। মেয়েদের জন্য সাদা জামা, লাল স্কার্ফ আর সবুজ পাজামা।  স্কুল কর্তৃপক্ষের সূত্র মতে, ইউনিফর্মটিতে জাপান এবং বাংলাদেশের প্রতীক তুলে ধরা হয়েছে। জাপানের পতাকার রং সাদা তার বুকে লাল সূর্য, বাংলাদেশের পতাকা সবুজের বুকে একটি জ্বলন্ত লাল সূর্য। দুটো দেশের সার্বভৌমত্বের পতাকার আদলে ইউনিফর্মটি তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের খাবার রান্নার জন্য দুজন বাবুর্চি রয়েছেন। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে তারা ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের তরকারি রান্না করে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করেন শিক্ষার্থীদের। স্কুলটি এখানে হওয়াতে আশপাশের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা নিতে পারছে।  এমন মহৎ উদ্যোগ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে স্কুলের উদ্যাক্তা প্রতিষ্ঠাতা তারিকুল ইসলাম মজুমদার। সেই সাথে জাপানি অর্থায়নে চলা এই স্কুলটি থেকে অনেক পথ শিশু ও গরিব মেধাবীরা পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এলাকায় স্কুলটির ব্যাপক সুনাম রয়েছে।
১৫ জানুয়ারি, ২০২৪
X