রুম তোমার নাম দেব কী
অর্ধশত থেকে শতবছর, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন জরাজীর্ণ হলে বাস করছে শিক্ষার্থীরা। ‘গণরুম’ তো আছেই, আছে ‘মন্ত্রীপাড়া’ ‘দরবার’ ‘চিলেকোঠা’ ‘আল মদিনা হোটেল’। রুমগুলোর মেজাজ-মর্জির সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয় বিচিত্র সব নাম। সোনার খাঁচায় পুরে রাখা দিনগুলোর শত শত স্মৃতি মিশে যায় সেই নামের বাঁকে বাঁকে। নানা ক্যাম্পাস ঘুরে এমনই কিছু কক্ষের নাম সংগ্রহ করেছেন সিফাত রাব্বানী—
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বড় আবাসিক হল শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। এই হলের একটি কক্ষে অন্ধকারের সঙ্গে বসবাস করতে হয় বলে নাম ‘লাদেন গুহা’। একটি কক্ষের নাম ‘ক্রেমলিন’; এখানে থাকেন শাহরিয়ার। তার মতে, ‘ক্রেমলিন হলো শহরের অভ্যন্তরে দুর্গের মতো। রাশিয়ার ক্রেমলিনের মতোই আমাদের কক্ষ। আর আমরা এই কক্ষের গর্বিত বাসিন্দা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার দা সূর্য সেন হলেও তিনটি কক্ষ নিয়ে গঠিত একটি গণরুম ‘লাদেন গুহা’ নামে পরিচিত।
ঢাকা কলেজ
বেশ পুরোনো এই বিদ্যাপীঠে হলের কক্ষগুলোর নাম অবাক না করে ছাড়বে না। অনেক আগের নামকরণ হওয়া কক্ষের বাসিন্দাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি তেমন। তবে নামগুলো টিকে আছে ঠিকই।
তালিকায় আছে ছায়াবীথি, খোয়াব, ভ্যাগাবন্ড, লাইসিয়াম, চিলেকোঠা, গাংচিল, রাজদরবার, পদ্মা প্যালেস, বঙ্গনিবাস, বন্ধন, কুরুক্ষেত্র ও চিলেকোঠার সেপাই। ইমদাদ হোসেন সোহাগ, সোহান সিকদার, সোহান মামুন, খালিদ হাসান দিপু কক্ষগুলোর বাসিন্দা। তারা জানালেন, অনেক দিন আগ থেকে সিনিয়র ভাইরা নামগুলো দিয়েছিলেন। নামকরণের ইতিহাস জানা নেই; তবে এগুলো এখানকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এগুলো আর বদলানো হবে না বলেও জানান তারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বাকৃবির শহীদ শামসুল হক হলের ১২২/সি কক্ষে ক্যাম্পাসের জনপ্রিয় ছবিয়াল সাদিক খানের আবাসস্থলের নাম ‘আঁতুড়ঘর’। তিনি বলছিলেন, ‘বাকৃবি ক্যাম্পাসে আমার সব শৈল্পিক চিন্তাভাবনা হয় এ রুম থেকেই। গান, ছবি কিংবা সাহিত্যচর্চার আঁতুড়ঘর আমার প্রিয় হলের এই ১২২ নম্বর রুম। বাকিরাও বহুমুখী প্রতিভাধর। লিটন দারুণ রান্না করে। তার কাছে রন্ধনশিল্পেই যত মজা। নাহিদ সবসময় পড়ালেখা করে। পড়াটাকে সে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এজন্য রুমের নামও এটা।’
একই হলের ৩২২/বি ব্লকের কক্ষটির নাম ‘কারাগার’। এখানে থাকতেন আবু রায়হান মিথুন। সম্প্রতি ৪৩তম বিসিএস এ সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন কৃষি ক্যাডারে। কক্ষটির নামকরণ তিনিই করেছিলেন। তার মতে, ‘আমার ক্যাম্পাস জীবনে দিন ও রাতের অধিকাংশ সময় রুমের বাইরে কেটেছে। রুমে এলেই মনে হতো কারাগারে আছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নুরুজ্জামান শুভ। তার রুমের নাম ‘পুতিনস ওয়ারিয়র্স’। জানালেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সবার পদচারণা বলে এর এমন প্যারোডি নামকরণ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাবির শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের কক্ষ নম্বর ১৪০। নতুন নাম ‘প্যালেস্টাইন’। এর বাসিন্দা অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মোস্তফা কামাল জানালেন, ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এ নামকরণ। একই হলের আরেকটি কক্ষ ‘নোঙরখানা’। এখানে থাকেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের আব্দুর রহমান। বললেন, ‘আমাদের রুমে যে কেউ যখন ইচ্ছে চলে আসতে পারে। এখানে চাইলে এসে নিজে রান্নাও করে খেতে পারে। তাই রুমের এমন নাম।’ ‘ডাকবাংলো’ নামে আরেকটি রুম আছে একই হলে।
ক্যাম্পাসের মতিহার হলের একটি কক্ষের নাম দিয়েছে কক্ষের বাইরের বন্ধুরাই। নাম ‘হোটেল আল মদিনা’। ওই বন্ধুরা বললেন, ‘যখনই ক্লাস শেষে দুপুরের খাবার কোথাও না পাই, তখন বন্ধুর রুমে গেলে কিছু না কিছু খাবার পাওয়া যায়, এজন্য সবাই মিলে রুমের নাম দিয়েছে হোটেল আল মদিনা।’
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের সি-ব্লকে থাকেন মিম্মা রহমান রিতি। তাদের কক্ষের নাম ‘জলসা ঘর’। জানালেন, তাদের কক্ষে যে চার-পাঁচজন থাকেন, তারা ব্লকের অন্যদের চেয়ে বেশি আমোদে সময় কাটান। টিপটপ বাতি জ্বালিয়ে গানের আসর আর আড্ডাবাজি দেখলে মনেই হবে এটি জলসা ঘর। ব্লকের যে কোনো ছোটখাটো অনুষ্ঠান যেমন—বিয়ের ট্রিট, হরেক রকম পাওনা ট্রিট, বাড়ি থেকে আনা খাবার কিংবা জন্মদিন; সব পালন হয় ওই রুমে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জবির একমাত্র ছাত্রী হলের একটি কক্ষের নাম ‘আট সতিন’। এর এক বাসিন্দা জানালেন, আটজনই তারা সতিনের মতো। এই ভালো এই মিল মহব্বত হারিয়ে গেল বুঝি—এমন অবস্থা!
হলের আরেকটি কক্ষের নাম ‘মায়াকুঠির’। ওই রুমে থাকেন নাসরিন নাঈমা। বললেন, ‘হলের রুমে আমরা একেকজন শিক্ষার্থী একেক জেলার। ভিন্ন সংস্কৃতির হলেও একই রুমে থাকতে থাকতে মায়ার বন্ধনে আটকে আছি। তাই এমন নাম দিয়েছি আমরা।’
হলের আরেক কক্ষের নাম ‘তন্দ্রালয়’। আলো বাতাস আসে না এই রুমে। কখন দিন, কখন রাত বোঝা মুশকিল। ‘কুইন্স ক্যাসেল’, ‘ক্ষণিকা’, ‘পদ্মরাগ’ এ নামের রুমও আছে এখানে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রায়হান জাকারিয়া। তার রুমের নাম ‘চিলেকোঠা’। সকালে ছোট জানালা দিয়ে আলোর ঝকঝকানি, নিরিবিলি পরিবেশ, এসব কারণে রুমটাকে নিজের বাড়ির মতোই মনে হয় তার।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ক্যাম্পাসটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানজিদা ইসলাম। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার কক্ষের নামকরণের ইতিহাস। তার মতে, বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা একত্র হয়েছি আমাদের কক্ষে, যেখানে সবার হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ-বেদনা মিলেমিশে একাকার। নানা পাগলামিতে একেকজনের সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমাদের করে তুলেছে পাগলাগারদের সদস্যদের মতো। তাই রুমের নাম ‘পাগলাগারদ’।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের নতুন ব্লকের ৫০৭ নম্বর কক্ষের নাম দিয়েছেন কক্ষের শিক্ষার্থীরা ‘লিলিঝিলি ৫০৭’। কক্ষের শিক্ষার্থী সালসাবিল আলাইকা ইকা বলেন, “আমাদের কক্ষের চারজনের মধ্যে অন্যরকম একটা কেমিস্ট্রি আছে, কেউ খুব চঞ্চল, কেউ দুষ্টু, কেউ মিষ্টি আর কেউ একটু চাপা। চারজনের জেলাও ভিন্ন। সব মিলিয়ে ‘লিলিঝিলি ৫০৭’।”
সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
এই ক্যাম্পাসে আছে নিজস্ব কটেজ। যার যার কটেজের নাম নিজেরাই দিয়ে থাকেন। এখানে পড়েন তানভীর। তার দেওয়া নিজের কটেজের নাম ‘দরবার’। প্রতি সাপ্তাহিক ছুটিতে কাছের বন্ধুরা মিলে গানের আসর জমান এখানে।
২১ এপ্রিল, ২০২৪