আরও কমলো রপ্তানি সহায়তা শঙ্কা দেখছেন ব্যবসায়ীরা
ডলার সংকটের এ সময়ে পণ্য রপ্তানি বাড়ানো জরুরি হলেও দেশের রপ্তানি আয় সেভাবে বাড়ছে না। এরই মধ্যে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দ্বিতীয় বারের মতো কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল এ বিষয়ে একটি সার্কুলারও জারি করেছে। এতে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকরা।
তারা বলছেন, করোনার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তারপর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমেছে। এই কঠিন সময়ে গত বছর রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমানো হয়েছে। প্রতিনিয়ত ব্যবসার খরচ বাড়ছে। গ্যাসের সংকট কাটছে না। অথচ ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ নগদ সহায়তা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্তে বড় চাপের মধ্যে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত।
এই প্রসঙ্গে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত মোটেও ঠিক হয়নি। আমরা আগামী ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবো। এর পরও আরও তিন বছর নগদ সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আমরা তো অন্তত ২৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা পেতেই পারি। কিন্তু এর আগেই নগদ সহায়তা কমানো শুরু করেছে। এটা দেশের রপ্তানি খাতের জন্য মোটেও ভালো হবে না। এ ছাড়া রপ্তানিমুখী দেশি নিট পণ্যের ওপর থেকে সহায়তা কমায় পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশি প্রতিষ্ঠান থেকে নিট পণ্য ক্রয় থেকে বিমুখ হবে। এতে এই শিল্পই হুমকির মুখে পড়বে। এক কথায়, তৈরি পোশাকের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি বাড়বে। আর দেশি শিল্প ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়া শুরু হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগে রপ্তানি আয়ের ওপর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা প্রদান করা হতো, যাতে রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করা যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা যায়। এখন নতুন ঘোষণার পর, সর্বোচ্চ হার ১০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে বলে সার্কুলারে জানানো হয়েছে।
তথ্য বলছে, নগদ সহায়তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। তবে এখন নগদ সহায়তা কাটছাঁট করা হলে তৈরি পোশাক শিল্পের কমপক্ষে অর্ধেক পণ্য রপ্তানি প্রণোদনা থেকে বাদ পড়বে। এ ছাড়া নগদ সহায়তা কমছে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানি খাত চামড়া, পাটজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, আসবাব, প্লাস্টিকসহ বেশকিছু পণ্যে।
নতুন হার অনুযায়ী, রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্রুব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ৩ শতাংশ ছিল। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের প্রণোদনার হার ১ দশমিক ৫ শতাংশের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তাও ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। নিট, ওভেন, সোয়েটারসহ তৈরি পোশাক খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প অতিরিক্ত সুবিধা ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন পণ্য বা নতুন বাজারে ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ২ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ নগদ সহায়তা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
পাটজাত চূড়ান্ত দ্রব্যে ৫ শতাংশ, পাটসুতায় ৩ শতাংশ এবং চামড়াজাত দ্রব্যাদি রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে। অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে হাতে তৈরি পণ্যে ৬ শতাংশ, গরু-মহিষের নাড়িভুঁড়ি, শিং ও রগে ৬ শতাংশ, হিমায়িত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রপ্তানি খাতে ১ দশমিক ৫ থেকে ৮ শতাংশ, হালকা প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ, কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, পেট বোতল-ফ্লেক্স রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, পেট বোতল-ফ্লেক্স থেকে উৎপাদিত পলইয়েস্টার স্টাপল ফাইবার রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, জাহাজ রপ্তানির বিপরীতে ৬ শতাংশ, পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বন ও জুট পার্টিকেল বোর্ড রপ্তানিতে ৮ শতাংশ, শস্য ও শাকসবজির বীজ রপ্তানিতে ৮ শতাংশ, ফার্নিচার রপ্তানিতে ৮ শতাংশ, প্লাস্টিকদ্রব্য রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, দেশে উৎপাদিত কাগজ ও কাগজ জাতীয় দ্রব্য রপ্তানিতে ৬ শতাংশ এবং আগর ও আতর রপ্তানিতে ৮ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন রপ্তানিকারকরা।
এ ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যে ৫ শতাংশ, অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারিতে ১০ শতাংশ, সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যার রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, সফটওয়্যার ও আইটিইএস সেবা রপ্তানিতে ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য ২ দশমিক ৫ শতাংশ, মোটরসাইকেল রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, রেজার ও রেজার ব্লেড রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, সিরামিক পণ্য রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, টুপি রপ্তানিতে ৭ শতাংশ, কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, কেমিক্যাল পণ্য (ক্লোরিন, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, কস্টিক সোডা এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড) রপ্তানিতে ৫ শতাংশ, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল হোম ও কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য রপ্তানিতে ৬ শতাংশ, চাল রপ্তানিতে ৩ শতাংশ, চা রপ্তানিতে ২ শতাংশ, স্টিল রপ্তানিতে ২ শতাংশ, বাইসাইকেল ও এর পার্টস রপ্তানিতে ৩ শতাংশ, সিমেন্ট সিট রপ্তানিতে ৩ শতাংশ, বেজা, বেপজা ও হাইটেক পার্ক এ অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে রপ্তানিতে দশমিক ৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
০১ জুলাই, ২০২৪