রমজানে মজুত করে মুনাফা রোধে কঠোর হতে হবে
মাঠ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি জেলা প্রশাসকদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আসন্ন রমজান কেন্দ্র করে মজুতদারির মাধ্যমে মুনাফাকারী ও ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধেও কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে স্থাপনা ও ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড যথাযথ অনুসরণের দিকেও নজর দিতে বলেন তিনি।
গতকাল রোববার নিজ কার্যালয়ের শাপলা হলে জেলা প্রশাসকদের চার দিনব্যাপী সম্মেলন উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করার পর থেকে নিত্যপণ্য মজুতকারীদের বিরুদ্ধে টানা হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, সামনে রমজান মাস, এ সময় কিছু কিছু ব্যবসায়ী সব সময় পণ্য মজুত করে, কৃত্রিমভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটতে চায়। সেদিকে নজর দিতে হবে, কেননা এটি আমাদের আশু করণীয় কাজ। কোথাও যেন ভোক্তাদের হয়রানির শিকার হতে না হয়। আমাদের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। পরনির্ভরশীলতা কমাতে হবে, আর এটা যে আমরা করতে পারি সেটা আমরা অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছি। সেদিকে একটু নজর দেওয়া একান্তভাবে দরকার।
সরকার প্রধান বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সরবরাহ। সেটা নিয়েও সমস্যার সৃষ্টি হয় অথবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কেউ কেউ মজুতদারি করে। পণ্য পচিয়ে ফেলবে তবু বাজারে ছাড়বে না। সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। রমজান সামনে রেখেই এ কথাগুলো আমি সবার আগে বললাম। যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথাযথভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দিকে সবাইকে নজর দিতে হবে।
খাদ্যে ভেজাল দেওয়া প্রতিরোধেও জেলা প্রশাসকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, রোজা এলেই এই সমস্যাগুলো বেশি পরিমাণে দেখা দেয়। এগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে।
সম্প্রতি রাজধানীর বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে সঠিকভাবে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, তা সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন এলাকায় নয়, দেশের অন্যান্য স্থানেও এটি অনুসরণ করতে হবে। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা এগুলো রেখেই ভবন নির্মাণ করতে হবে।
তিন ফসলি আবাদি জমি বাড়িঘর বা শিল্প-কারখানাসহ অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না মর্মে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ফসলি জমি রক্ষা করতে হবে। সরকার দেশের উন্নয়ন করছে, পাশাপাশি দেশের মানুষের অধিকারও নিশ্চিত করা দরকার।
সমাজে কিশোর গ্যাং সমস্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাবে এবং পড়াশোনা করবে সেই সময় এই সমস্যাটা দেখা দেয়। এলাকাভিত্তিক নজরদারি বাড়াতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যারা লেখাপড়া করবে তারা তা না করে কেন বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়াবে? এ ব্যাপারে কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকদের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের নিয়ে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন কারও ছেলে মেয়ে এ ধরনের কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে না পারে। প্রতিটি পরিবারকে নিজের সন্তান-সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে।
প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধের দিকে মননিবেশ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবারগুলোকে একটু সচেতন করতে হবে, শুধু গ্রেপ্তার করে বা ধরে লাভ নেই। সেক্ষেত্রে সেখানে থাকা বড় অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে এরা আরও বড় কোনো ধরনের অপরাধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। এ কারণে গোড়া থেকেই আমাদের ধরতে হবে এবং পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।
তিনি মাঠ প্রশাসনকে জনগণকে কর প্রদানে উৎসাহিতকরণ ও সচেতনতা সৃষ্টি, সার্বজনীন পেনশন স্কিম গ্রহণ, সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিকে উৎসাহিতকরণ, সেচ কাজে সোলার প্যানেলের ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টি, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার রোধ করে ভূউপরিস্থ জলাধার সংরক্ষণ ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করা, লবণাক্ততা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় খননকার্য চালানো, জনগণের সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পানি শোধনাগারগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে তদারকি নিশ্চিত করা ও যথাযথ প্রাপ্যরাই এর সুবিধা পাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা, আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর উপকারভোগীদের খোঁজ খবর নেওয়া ও তাদের সমস্যার সমাধান, যুব সমাজকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠায় সরকারের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগানোয় উৎসাহিত করার এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগারি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করার আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, যত বেশি ছেলে-মেয়েদের খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে তত বেশি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, মাদকসহ তাদের মাঝে বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। এ জন্য তিনি উপজেলাভিত্তিক মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রকল্পগুলার দ্রুত বাস্তবায়ন এবং বছরজুড়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নানারকম প্রতিযোগিতার আয়োজনে জেলা প্রশাসনকে নজর দেওয়ার কথা বলেন।
সরকারের প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে নজর রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না এবং এগুলো কতটুকু স্থানীয় জনগণের কাজে আসবে, সে বিষয়ে প্রয়োজনে আমাকে সরাসরি রিপোর্ট দিতে হত। শুধু নামকাওয়াস্তে প্রকল্প যেন না করা হয়, সে বিষয়ে তিনি সবাইকে পুনরায় সচেতন করেন।
পুনরায় ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনায় সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিতা অব্যাহত রাখার সুযোগ প্রদানের জন্য আবারও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন. আমি ১৯৭৫ সালের পর যে নির্বাচনগুলো প্রত্যক্ষ করেছি এবং অংশ নিয়েছি, তার মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠু, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধারাবাহিকভাবে সরকারে আছি, তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতাকে শুধু ভোগ করতে এসেছি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল বক্তব্য দেন।
০৪ মার্চ, ২০২৪