বিএনপির অগ্রাধিকারে খালেদা জিয়ার মুক্তি
জাতীয় নির্বাচনের পর বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও এবার ‘গুরুতর অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জোরালোভাবে মাঠে নামতে চায় বিএনপি। দীর্ঘদিনেও দলীয় চেয়ারপারসনকে মুক্ত করতে না পারায় অনুতপ্ত নেতারা এই ইস্যুতে ধারাবাহিক আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেইসঙ্গে দুর্নীতি, লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ চলমান কিছু ইস্যুকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে তিন দিনের চলমান কর্মসূচির পর আরও কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। অবশ্য নতুন কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে মানববন্ধন, বিক্ষোভ, অবস্থান, অনশনের মতো কর্মসূচি দলের হাইকমান্ডের বিবেচনায় রয়েছে। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পর্যায়ক্রমে এসব কর্মসূচি দেওয়া হবে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন ত্বরান্বিত হবে।
নতুন কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির স্বার্থে কারও সঙ্গে কোনো আপস হবে না। আমরা তাকে মুক্ত করে ছাড়ব। নেত্রীর মুক্তির লক্ষ্যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে, এরপর আরও কর্মসূচি আসবে। আমরা বহুদিন পর প্রথম খালেদা জিয়াকে নিয়ে মুখ খুলেছি, এই মুক্তির আন্দোলন থামবে না।’
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন তিনি। ওই সময় আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশব্যাপী মানববন্ধন, অবস্থান, গণঅনশন, লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ সমাবেশ, সমাবেশসহ নানান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। পরে করোনা মহামারির সময় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার সাজা ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাময়িক স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। তখন থেকে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। কারামুক্তির পর থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় থাকছেন শারীরিকভাবে অসুস্থ খালেদা জিয়া। এমন অবস্থার মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২১ জুন গভীর রাতে খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত হওয়ায় মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শে খালেদা জিয়ার হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়।
বিএনপি নেতারা জানান, দলের নেতাকর্মীদের কাছে খালেদা জিয়া প্রবল আবেগের নাম। তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন জোরদার করা দলের প্রতিটি স্তরের দাবি। এ কারণেই দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে দলীয় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে তিন দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত শনিবার ঢাকায় সমাবেশ করে বিএনপি।
নির্বাচনের পর খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির দাবিতে ঢাকায় সমাবেশসহ দু-একটি কর্মসূচি হলেও শনিবারের সমাবেশ ছিল বৃহৎ সমাবেশ। দলটির দাবি, ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও মহানগরগুলো থেকে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল, বড় সমাবেশের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পুনর্গঠন, ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সামনে রেখে এই সমাবেশকে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্র হিসেবেও দলের বিবেচনায় ছিল। ওই দিনের সমাবেশে যুবদল নেতা মোনায়েম মুন্না, নুরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জাহাঙ্গীর, মামুন হাসান, মহানগর উত্তর বিএনপির আমিনুল হক, সাইফুল আলম নীরব, দক্ষিণ বিএনপির নবীউল্লাহ নবী, রফিকুল আলম মজনু, তানভীর আহমেদ রবিন, কেন্দ্রীয় বিএনপির আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, কৃষক দলের শহীদুল ইসলাম বাবুল, ঢাকা জেলা বিএনপির নিপুণ রায় চৌধুরীসহ অনেকেই ব্যাপক শোডাউন করেন।
সমাবেশ থেকে দীর্ঘদিনেও খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে না পারায় অকপটে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। এমন অনুধাবন থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আগামীতে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিএনপির এই সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে যুগপতের শরিকদের সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়ে। তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে একত্রীভূত করে সোচ্চার আওয়াজ তুলতে বলেন বিএনপি নেতারা। খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে সরকারকে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
ঢাকার সমাবেশ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, ‘২৯ জানুয়ারির সমাবেশের বেশ কয়েকটি সফল দিক আছে। গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর প্রথম ঢাকায় এত বড় সমাবেশ হলো। বৃষ্টি ও গরম উপেক্ষা করে সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপচে পড়া উপস্থিতি লক্ষণীয়, যা সামনের আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে। এর মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন আর ত্বরান্বিত হবে।’
নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচন দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। জানা গেছে, সংগঠন পুনর্গঠন ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এই দুই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের আগামী দিনের সেই আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য আবার প্রস্তুত করছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকার সমাবেশে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি দলকে আশাবাদী করে তুলেছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, বিগত আন্দোলন ঘিরে শত অত্যাচার-নির্যাতন, হতাশা সত্ত্বেও কেউ দল ছেড়ে যায়নি। ঢাকার সমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি সেটা ফের প্রমাণ করেছে। বিএনপিই যে তাদের আশ্রয়স্থল, সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। এটাই দলের বড় সম্পদ।
ঢাকা ও সিলেট ছাড়া সব মহানগরে সমাবেশ আজ:খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ সোমবার ঢাকা বাদে সব মহানগরে একযোগে সমাবেশ করবে বিএনপি। এ ছাড়া আগামী বুধবার দেশব্যাপী জেলা শহরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এসব সমাবেশ সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতারা নিজ নিজ জেলায় কর্মসূচিতে সার্বিকভাবে সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ করবেন। আর সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকরা কর্মসূচি সফল করতে সার্বিকভাবে সমন্বয় করবেন। এসব সমাবেশ ঘিরে জেলা জেলায় দলের সিনিয়র নেতারা যাবেন।
জানা গেছে, গাজীপুর মহানগর ও জেলার সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন মির্জা আব্বাস। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ মহানগর ও জেলায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়; ময়মনসিংহ মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় সেলিমা রহমান; চট্টগ্রাম মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী; খুলনা মহানগর ও জেলায় শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি; বরিশাল মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় আলতাফ হোসেন চৌধুরী; কুমিল্লা মহানগর এবং উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় মো. শাহজাহান; রংপুর মহানগর ও জেলায় শামসুজ্জামান দুদু; ফরিদপুর মহানগর ও জেলায় নিতাই রায় চৌধুরী এবং রাজশাহী মহানগর ও জেলায় রুহুল কবির রিজভী প্রধান অতিথি থাকবেন। তবে বন্যাকবলিত হওয়ায় সিলেট মহানগর ও জেলায় এই ধাপে সমাবেশ হবে না।
০১ জুলাই, ২০২৪