সংসার চালাতে পেরেশান মধ্যবিত্ত
ডিসেম্বর মাস। সন্তানদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। অনেক আগেই সপরিবারে গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আনোয়ার। কিন্তু বাড়ি ভাড়া আর সংসারের নিয়মিত খরচের সঙ্গে মেয়ের স্কুলে ভর্তির ফি যোগ হয়ে হাতে আর টাকা নেই তার। বাসায় ফিরলেই মেয়েটি দাদুর বাড়ি যাওয়ার দিনক্ষণ জানতে চায়। কিন্তু তাকে একথা বলতে পারছে না, এবারের ছুটি গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না তাদের।
ঢাকার মালিবাগ এলাকায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে দুই রুমের ফ্লাটের একটিতে সাবলেট থাকেন আনোয়ার। করোনার আগে নিয়মিত আয় থাকায় নিজেরাই বাসা নিয়ে থাকতেন। এখন মেয়ের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই এলাকায় বাসা নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার সময় চাকরি হারিয়ে টানা ছয় মাস বেকার ছিলেন। প্রথমে সামান্য সঞ্চয়ের টাকা এবং পরে ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন। এখন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন।
কালবেলার সঙ্গে আলাপে আনোয়ার জানান, জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে নিজের সংসারের খরচ আর গ্রামে মা-বাবাকে টাকা পাঠানোর পর বিশেষ কিছুই হাতে থাকে না। বছর শেষে মেয়ের স্কুলের ফি কিংবা কারও অসুস্থতায় বাড়তি টাকার প্রয়োজন হলেই ঝামেলা পড়ে যান।
শুধু আনোয়ার নন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অধিকাংশ পরিবারের চিত্রই এমন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ব্যাপক মাত্রায় বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়েনি। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে পেরেশান হয়ে যাচ্ছে সিংহভাগ মানুষ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ঢাকা শহরের চারজনের পরিবারে প্রতি মাসে শুধু খাবারের খরচ ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। তবে এ থেকে মাছ ও মাংস বাদ দিলে খরচ হবে ৭ হাজার ১৩১ টাকায়। জানা গেছে, এ বছর মার্চে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে। তবে গত নভেম্বর মাসে এই হার কিছু কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে এসেছে, যা এখনো মার্চের তুলনায় শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে ধনীদের একটি অংশ মধ্যবিত্তের কাতারে এবং মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি পেরেশানিতে পড়েছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নিম্ন শ্রেণি বা দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় (পরিমাণে পর্যাপ্ত না হলেও) নিয়মিত ভর্তুকি মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি লোকলজ্জার কারণে রাস্তায় সেই লাইনেও দাঁড়াতে পারছে না। বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে তাদের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সবসময় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অনুকূলে থাকতে হবে। কারণ আয়ের বিকল্প কোনো মাধ্যম বা সঞ্চয় না থাকায় নির্ধারিত আয় দিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যাদের সম্পদ থাকে বা স্টক থাকে, তাদের সম্পদ রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে তারা আরও ধনী হয়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তারা সবসময় লাভবান হয়। দেশে এখন সেটিই চলমান। অসুবিধায় পড়ে যারা ভোক্তা বা ক্রেতা। এভাবে চলতে গেলে আমাদের আয় বৈষম্য আরও অনেক বেড়ে যাবে। অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি চলে যাবে। সুতরাং সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।’ তিনি বলেন, মধ্যবিত্তদের থেকে (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে) আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে তাদের হাতে সঞ্চয় কম। বর্তমানে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কাজেই তাদের নতুন সঞ্চয় করাটা কঠিন। সেজন্য নতুন সঞ্চয় কমে যাচ্ছে।’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে চিকন চাল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা এবং মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডালের কেজি মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা, মুগ ডাল ৯৫ থেকে ১৪০ টাকা এবং ছোলার ডাল ৮০ থেকে ১০০ টাকা। খোলা আটার কেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, প্যাকেট আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, খোলা ময়দা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা তেলের লিটার ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, বোতলজাত ১ লিটার ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। খোলা পাম অয়েলের কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, ডিমের হালি ৪২ থেকে ৪৩ টাকা, তেলাপিয়া ও পাঙাস মাছের কেজি আকার এবং মানভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, ছোট মাছের কেজি মানভেদে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, আকারভেদে রুই কাতল মাছের কেজি ২৩০ থেকে ৩৫০ টাকা।
এদিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে ১১০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন ও পুরাতন আলু একই দামে অর্থাৎ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। শাকসবজির মধ্যে প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবজির মধ্যে প্রতি কেজি শালগম, মুলা ও পেঁপে ৪০ টাকা, শিম জাতভেদে ৪০ থেকে ৮০ টাকা, লম্বা বেগুন ৫০ টাকা এবং গোল বা তাল বেগুন ৭০ টাকা, পটোল, লতি ও কাঁচা টমেটো ৫০ টাকা, চিচিঙা-ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা এবং কচুমুখী ৯০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজারের এ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাধারণ মানুষকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার একটাই উপায়, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে পরিবারের ব্যয়ে আরও কাটছাঁট করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো অতটা সম্ভব হবে না। এটিকে পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে। মুদ্রানীতি কঠোর করতে হবে। সেটি কার্যকর করা গেলে জিনিসপত্রের দামও কমতে পারে।’
১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩