কোরবানির গরুর নাগাল পাচ্ছে না মধ্যবিত্ত
রাজধানীর গাবতলীর পশুর হাট। বেড়িবাঁধ সড়কের একপাশ ঘেঁষে প্রায় ১ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম হলেও বিক্রি কম। অধিকাংশ ক্রেতা দরদামই করে যাচ্ছেন, কিনছেন না। হাতে সময় আছে আজকের দিন। আজ রোববার বিক্রি বাড়বে বলে ধারণা বিক্রেতাদের। তবে দাম নিয়ে খানিকটা বিপাকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি। ব্যাপারীরা অতিরিক্ত দাম হাঁকানোয় তারা পশুর লাগাম পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ। যদিও বিক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য বছরের থেকে দাম এবার কিছুটা কম। গতকাল শনিবার হাটটি ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। আগামীকাল সোমবার পবিত্র ঈদুল আজহা। এই উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার থেকে রাজধানীতে কোরবানির পশু কেনাবেচা শুরু হয়েছে। চলবে ঈদের দিন পর্যন্ত। হাটে পশু বেচাকেনা শুরুর পর থেকে দাম নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে আসছেন ক্রেতারা। তবে বিক্রেতা ও হাট পরিচালনা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দাম গড়পড়তা (এভারেজ) আছে। আমিনবাজারের বাসিন্দা কাওসার হোসেন। তিনি ১ লাখ ৫ হাজার টাকায় মাঝারি সাইজের একটি গরু কিনেছেন। হাসিল ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘গতকালের চেয়ে আজ দাম কিছুটা কম। ব্যাপারী দাম হাঁকিয়েছেন ১ লাগ ৪০ হাজার টাকা। পরে ১ লাখ ৫ হাজারে কিনে নিলাম।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাপারীরা একটু বেশি দাম চেয়ে বসেন। তবে দরদাম করে কিনতে হবে।’ গরু না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন মিরপুর ১ নম্বরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গরুর নাগাল পাচ্ছি না। ব্যাপারীরা এত দাম চান। দেখি, কাল (আজ) দাম কমে কি না। তাহলে কালকে কিনব।’ ৯ নম্বর হাসিল ঘরের সামনে কালো রঙের একটি মাঝারি সাইজের গরু নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন হাসান মিয়া। কত দিয়ে কিনেছেন জানতে চাইলে বলেন, ৯৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, এখানে টাকা বিষয় নয়। এই গরু পছন্দ হয়েছে, তাই কিনে নিলাম। তবে তুলনামূলক একটু বেশি দাম চেয়ে বসেন ব্যাপারীরা।’ গাবতলীর হাটে ঢুকেই বেড়িবাঁধ ঘেঁষে ত্রিপল টানানো একটি এগ্রো ফার্ম। সেখানে গিয়ে দেখা যায় কালো রঙের বড় সাইজের একটি গরু। পাশেই দাঁড়ানো এক ব্যক্তি বলেন, এটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এদিকে ক্রেতারা অধিক দামের অভিযোগ করলেও অস্বীকার করেছেন বিক্রেতারা। তাদের দাবি, গত বছরের থেকে এবার দাম অনেক কম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক বিক্রেতা কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ২০টি গরু নিয়ে এসেছি। মাত্র সাতটি বিক্রি হয়েছে। প্রতিটিতে অন্তত ১০ হাজার টাকা করে লোকসান হয়েছে। এখনো ১৩টি রয়ে গেছে। হাটে ক্রেতা নেই। সবাই দরদাম করে চলে যাচ্ছেন, কেউ কিনছেন না। শেষ দিন দাম একটু না বাড়লে এবার বিরাট লোকসান হয়ে যাবে।’ রাজবাড়ীর আরেক বিক্রেতা বলেন, ‘আমি তিন বছর ধরে এই ব্যবসা করি। এবার সাতটি গরু নিয়ে এসেছি। মাত্র তিনটি বিক্রি হয়েছে। অল্প কিছু টাকা লাভ হয়েছে। দাম অনেক কম বলেন ক্রেতারা।’ একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দুদিন পরই কোরবানি। এখন হাটে নিয়ে আসা গরু বিক্রি করেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছা। গরু ফিরিয়ে নিতে গেলে খরচ বেড়ে যায়। গরুর ওপর বাড়তি ধকলও পড়ে। সব মিলিয়ে মোটামুটি লাভ হলেই বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে গরু। গত বছরের তুলনায় দাম খুব বেশি নয়। গাবতলীর পশুর হাটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও স্বাভাবিক। র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেক কন্ট্রোল রুম বসানো হয়েছে। সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও কাজ করছেন। নির্মাণ করা হয়েছে একাধিক ওয়াচ টাওয়ার। এসব ওয়াচ টাওয়ার থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক নজরদারি করছেন। কারও গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলেই তার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। হাট কর্তৃপক্ষের নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবক দলও রয়েছে, যারা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে সার্বক্ষণিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গাবতলী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) খালিদ ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের পুলিশ সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা হাটে নজরদারি চালাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো মলম পার্টি, চুরি, ছিনতাই বা কোনো ধরনের অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আমাদের সদস্যরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছেন।
১৬ জুন, ২০২৪

সংসার চালাতে পেরেশান মধ্যবিত্ত
ডিসেম্বর মাস। সন্তানদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। অনেক আগেই সপরিবারে গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন আনোয়ার। কিন্তু বাড়ি ভাড়া আর সংসারের নিয়মিত খরচের সঙ্গে মেয়ের স্কুলে ভর্তির ফি যোগ হয়ে হাতে আর টাকা নেই তার। বাসায় ফিরলেই মেয়েটি দাদুর বাড়ি যাওয়ার দিনক্ষণ জানতে চায়। কিন্তু তাকে একথা বলতে পারছে না, এবারের ছুটি গ্রামে যাওয়া হচ্ছে না তাদের। ঢাকার মালিবাগ এলাকায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে দুই রুমের ফ্লাটের একটিতে সাবলেট থাকেন আনোয়ার। করোনার আগে নিয়মিত আয় থাকায় নিজেরাই বাসা নিয়ে থাকতেন। এখন মেয়ের স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই এলাকায় বাসা নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার সময় চাকরি হারিয়ে টানা ছয় মাস বেকার ছিলেন। প্রথমে সামান্য সঞ্চয়ের টাকা এবং পরে ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন। এখন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করছেন। কালবেলার সঙ্গে আলাপে আনোয়ার জানান, জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে নিজের সংসারের খরচ আর গ্রামে মা-বাবাকে টাকা পাঠানোর পর বিশেষ কিছুই হাতে থাকে না। বছর শেষে মেয়ের স্কুলের ফি কিংবা কারও অসুস্থতায় বাড়তি টাকার প্রয়োজন হলেই ঝামেলা পড়ে যান। শুধু আনোয়ার নন, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অধিকাংশ পরিবারের চিত্রই এমন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ব্যাপক মাত্রায় বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়েনি। ফলে সংসার চালাতে গিয়ে পেরেশান হয়ে যাচ্ছে সিংহভাগ মানুষ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি বছর মার্চে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ঢাকা শহরের চারজনের পরিবারে প্রতি মাসে শুধু খাবারের খরচ ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। তবে এ থেকে মাছ ও মাংস বাদ দিলে খরচ হবে ৭ হাজার ১৩১ টাকায়। জানা গেছে, এ বছর মার্চে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। পরে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে। তবে গত নভেম্বর মাসে এই হার কিছু কমে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে এসেছে, যা এখনো মার্চের তুলনায় শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে ধনীদের একটি অংশ মধ্যবিত্তের কাতারে এবং মধ্যবিত্তরা দারিদ্র্যসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি পেরেশানিতে পড়েছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। নিম্ন শ্রেণি বা দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় (পরিমাণে পর্যাপ্ত না হলেও) নিয়মিত ভর্তুকি মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি লোকলজ্জার কারণে রাস্তায় সেই লাইনেও দাঁড়াতে পারছে না। বাজারে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে তাদের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সবসময় নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের অনুকূলে থাকতে হবে। কারণ আয়ের বিকল্প কোনো মাধ্যম বা সঞ্চয় না থাকায় নির্ধারিত আয় দিয়ে তাদের চলতে হচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে যাদের সম্পদ থাকে বা স্টক থাকে, তাদের সম্পদ রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে তারা আরও ধনী হয়ে যায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে তারা সবসময় লাভবান হয়। দেশে এখন সেটিই চলমান। অসুবিধায় পড়ে যারা ভোক্তা বা ক্রেতা। এভাবে চলতে গেলে আমাদের আয় বৈষম্য আরও অনেক বেড়ে যাবে। অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি চলে যাবে। সুতরাং সামাজিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।’ তিনি বলেন, মধ্যবিত্তদের থেকে (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে) আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। কারণ হচ্ছে তাদের হাতে সঞ্চয় কম। বর্তমানে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কাজেই তাদের নতুন সঞ্চয় করাটা কঠিন। সেজন্য নতুন সঞ্চয় কমে যাচ্ছে।’ গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে চিকন চাল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের চাল ৫২ থেকে ৫৮ টাকা এবং মোটা চাল ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মসুর ডালের কেজি মানভেদে ১১০ থেকে ১৪০ টাকা, মুগ ডাল ৯৫ থেকে ১৪০ টাকা এবং ছোলার ডাল ৮০ থেকে ১০০ টাকা। খোলা আটার কেজি ৪৫ থেকে ৫০ টাকা, প্যাকেট আটা ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, খোলা ময়দা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং প্যাকেট ময়দা প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে খোলা তেলের লিটার ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, বোতলজাত ১ লিটার ১৬৮ থেকে ১৭০ টাকা। খোলা পাম অয়েলের কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, ডিমের হালি ৪২ থেকে ৪৩ টাকা, তেলাপিয়া ও পাঙাস মাছের কেজি আকার এবং মানভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, ছোট মাছের কেজি মানভেদে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, আকারভেদে রুই কাতল মাছের কেজি ২৩০ থেকে ৩৫০ টাকা। এদিকে বাজারে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে ১১০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে নতুন ও পুরাতন আলু একই দামে অর্থাৎ ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। শাকসবজির মধ্যে প্রতি পিস ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং লাউ ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সবজির মধ্যে প্রতি কেজি শালগম, মুলা ও পেঁপে ৪০ টাকা, শিম জাতভেদে ৪০ থেকে ৮০ টাকা, লম্বা বেগুন ৫০ টাকা এবং গোল বা তাল বেগুন ৭০ টাকা, পটোল, লতি ও কাঁচা টমেটো ৫০ টাকা, চিচিঙা-ঢ্যাঁড়স ৮০ টাকা, করলা ৭০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা এবং কচুমুখী ৯০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। বাজারের এ পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সাধারণ মানুষকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়ার একটাই উপায়, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে পরিবারের ব্যয়ে আরও কাটছাঁট করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো অতটা সম্ভব হবে না। এটিকে পরিকল্পনার মাধ্যমে করতে হবে। মুদ্রানীতি কঠোর করতে হবে। সেটি কার্যকর করা গেলে জিনিসপত্রের দামও কমতে পারে।’
১৫ ডিসেম্বর, ২০২৩

ডেঙ্গু চিকিৎসায় নিঃস্ব নিম্ন ও মধ্যবিত্ত
দিন যত যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। চলতি বছর ২৬৭ দিনে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯০৯ জন। সর্বশেষ গতকাল রোববার মারা গেছেন ১৬ জন। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৮ জন। মৃতদের মধ্যে ৪৯ শতাংশের বয়স ২১ থেকে ৫০ বছর। ডেঙ্গুতে শুধু চলতি মাসে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৩১৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ উপার্জনক্ষম, যাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবার। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শোলক ইউনিয়নের ছেলে সুজন (২৯) পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। মাঝেমধ্যে মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করতেন। দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। বড় মেয়ের বয়স পাঁচ বছর ও ছোট মেয়ের বয়স ১৮ মাস। চলতি মাসের শুরুতে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। পাঁচ দিন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু ডেঙ্গুর কাছে হার মানতে হয়। এতে সুজনের পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। দুই শিশুকন্যা নিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম তার পরিবারের সদস্যদের। স্বজনরা জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর জ্বরে আক্রান্ত হন সুজন। স্থানীয় ধামুরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষায় ধরা পড়ে ডেঙ্গু। সেখানে চিকিৎসাধীন থেকে তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। সুজনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সুমী বলেন, সুজনের পরিবারে আয় করার মতো আর কেউ রইল না। শুধু সুজনের পরিবার নয়, স্বজন হারা শোকে মুহ্যমান এমন সহস্রাধিক পরিবার। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেসরকারি অসংখ্য হাসপাতালের তথ্য এখনো আসে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্ভারে। তাই পুরোপুরি হিসাব দেওয়া সম্ভব হয় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে চলতি বছর এ পর্যন্ত ৯০৯ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে অন্তত অর্ধেক মানুষ ছিল উপার্জনক্ষম, যাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল পরিবার। ডেঙ্গু তাদের পরিবার তছনছ করে দিয়েছে। একশরও বেশি শিশুর মৃত্যুতে বাবা-মা পাগলপ্রায়। সন্তান হারা পরিবার মানসিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমাদের দেশে ডেঙ্গু বিস্তারের ইতিহাস ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঘরে ঘরে জ্বরের প্রকোপ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষকে ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মশক নিধনের কয়েল, অ্যারোসল, মশারিসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়েছে। জ্বর-সর্দি তথা ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে মানুষের ভিড় লেগেই রয়েছে। এদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় দেশজুড়ে ব্যবহৃত আইভি ফ্লুয়েড স্যালাইনের রয়েছে তীব্র সংকট। রোগীর পরিবারকে চড়া মূল্যে স্যালাইন কিনতে হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ নিঃস্ব প্রায়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাত দিন ভর্তি থাকার পর ছাড়পত্র নিয়েছেন গৃহকর্মী সালেহা বেগম (৫০)। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ভাড়া বাসায় সংসার। স্বামী দিনমজুর আয়নাল মিয়া দুই বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান। ছেলে ইদ্রিস ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান আর মেয়ে শারমিন এইচএসসি পাস করেছে। মায়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ইদ্রিস নিয়মিত রিকশা চালাতে পারেননি। ওষুধ, স্যালাইন, খাবার ও অন্যান্য জিনিপত্র কিনতে গিয়ে পরিবারটি এখন ঋণী। সালেহা বেগম কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হয়েছি, কিন্তু ১৫ হাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য এই টাকা অনেক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৯০৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫২০ জন নারী আর ৩৮৯ জন পুরুষ। ১৫ বছরের নিচে ১০৫ শিশুর মৃত্যু হয়। ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সী ৫৯ কিশোর-যুবকের মৃত্যু হয়। ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৪৪৪ জন প্রাণ হারান। ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী ১৩০ জন। ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সী ১০৬ জন। ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সী ৪৫ আর ৮০ তদূর্ধ্ব ২০ জন। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির হিসাবেও কর্মক্ষম মানুষ সবচেয়ে বেশি। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের ৫৬ শতাংশ ২১ থেকে ৫০ বছর বয়সী। জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬ এবং চলতি মাসের গত ২৪ দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৩ হাজার ৯১৭ জন। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। এর আগের বছর ২৮ হাজার ৪২৯, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫ জন। ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। আর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন। ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদার বলেন, ডেঙ্গুতে এ বছর মধ্যবয়সীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা সিটিতে। এর বাইরে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী এসব জেলায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম এবং লক্ষ্মীপুর জেলা এবং বরিশাল বিভাগের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক বেশ কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। কিন্তু কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। পাঁচ শতাধিক কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু মানে তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো নিঃস্ব। এ বছর কেন যুবক ও কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্ত বেশি হচ্ছে, সেটি জানতে হলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা (ডেথ রিভিউ) জরুরি। কিন্তু ডেঙ্গুর উচ্চ সংক্রমণ ঘটলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজটি এখনো শুরু করতে পারেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। ডেথ রিভিউ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন, পরে ফোন করবেন বলে খুদে বার্তায় জানান। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামের ব্যক্তিগত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
X