ডেঙ্গু ভ্যাকসিন ও আমাদের করণীয়
দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে ভেঙেছে মৃত্যুর সব রেকর্ড। ২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু হয়েছে তবে এ বছর আক্রান্ত এবং মৃত্যুসংখ্যা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। আগস্টে এসেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু রোগের সংখ্যা আরও বাড়বে। বিশেষ করে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের পরিস্থিতি খারাপ হবে।
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এবার ডেঙ্গু ঝুঁকিতে থাকবে। ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণ অনুযায়ী এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। পৃথিবীতে প্রতিবছর গড়ে ৫ লাখ মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং এর মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। তবে কোনোভাবেই যেন মশার সঙ্গে পেরে উঠছে না মানুষ। তাই পৃথিবীর বড় বড় গবেষণা সংস্থা নজর দিয়েছে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরিতে।
নানা সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরিতে সফল হয়েছে এবং কয়েকটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিনের ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে।
এখন পর্যন্ত সানোফি পাস্তুর দ্বারা তৈরি ডেনভ্যাক্সিয়া হলো একমাত্র ভ্যাকসিন, যা ২০১৫ সাল থেকে বিশ্বের অনেক দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। সানোফির তথ্য মতে, এটি আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এমন ৯ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিরা গ্রহণ করতে পারবে।
সানোফি পাস্তুর ৯ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ডেনভ্যাক্সিয়া গ্রহণের কথা বললেও আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ৯ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য এটি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এটি শুধু তাদের জন্য, যারা আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল এবং যে এলাকায় ডেঙ্গু হয় সেখানে বসবাস করে। ডেঙ্গু ভ্যাকসিন দেওয়ার আগে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, এই ব্যক্তি আগে ডেঙ্গু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল। কারণ, যেসব শিশু আগে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়নি তাদের এই ভ্যাকসিন দেওয়ার পরে ডেঙ্গু হলে রোগটি গুরুতর হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমন প্রমাণ ইতিমধ্যে মিলেছে। তাই, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের টিকা দেওয়ার আগে পরীক্ষাগার-নিশ্চিত পূর্ববর্তী ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রমাণ পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
ডেনভ্যাক্সিয়ার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তাই এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য ও উপাত্ত নেই। যদিও তারা বলছে, অন্তঃসত্ত্বাদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই। গর্ভাবস্থায় ডেনভ্যাক্সিয়ার প্রভাব নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। অন্তঃসত্ত্বারা যেহেতু যে কোনো ভাইরাসজনিত রোগের জটিলতার ঝুঁকিতে থাকে, তাই ভ্যাকসিন প্রদানকারী অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য টিকা দেওয়ার সুপারিশ করার সময় ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বিবেচনা করা উচিত।
বুকের দুধ পান করানো মায়েরা যদি ডেনভ্যাক্সিয়া ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন, তাহলে তা বুকের দুধ পানকারী সন্তানদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, সে বিষয়েও পরিপূর্ণ গবেষণা হয়নি। নবজাতকের মায়েদের এই ভ্যাকসিন প্রদান করার আগে বুকের দুধ পানকারী সন্তানদের মধ্যে ডেঙ্গু ভাইরাসের ঝুঁকি বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের আগে ডেঙ্গু সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ কারণে ৯ বছরের কম বয়সীরা ডেনভ্যাক্সিয়া ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য যোগ্য নয়। যারা ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বসবাস করেন না অথবা ভ্রমণকারী, তাদের জন্যও এই ভ্যাকসিন অনুমোদিত নয়। ডেঙ্গু থেকে পূর্ণ সুরক্ষার জন্য ডেনভ্যাক্সিয়া ভ্যাকসিনের তিনটি ডোজ এবং প্রতিটি ডোজ ছয় মাসের ব্যবধানে (০, ৬ এবং ১২ মাসে) দিতে হবে।
শিশুদের মধ্যে যাদের টিকা দেওয়ার আগে ডেঙ্গু হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু রোগ, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং গুরুতর ডেঙ্গু থেকে ৮০ ভাগ (১০০ জনের মধ্যে ৮০ জন) রক্ষা করে। ভ্যাকসিনটি চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের (ডেঙ্গু ১, ২, ৩ এবং ৪) বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দেয়।
ডেনভ্যাক্সিয়া ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কত বছর ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা দেয়, সেটি নিয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ গবেষণা এখনো হয়নি। তবে কোম্পানির তথ্য মতে, ভ্যাকসিনটি কমপক্ষে ছয় বছরের জন্য ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে। যদিও ভ্যাকসিনটি অত্যন্ত কার্যকর, তবে টিকাপ্রাপ্ত স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির প্রমাণও পাওয়া গেছে।
ডেনভ্যাক্সিয়া ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে—ব্যথা, চুলকানি বা ইনজেকশন সাইটে ব্যথা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা এবং সাধারণ অস্বস্তি। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো থেকে বোঝা যায়, এটি শরীরে সুরক্ষা তৈরি করছে। অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো এই ভ্যাকসিনেও কারও কারও ক্ষেত্রে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে।
জাপানের তাকেদা ফাউন্ডেশন QDENGA® (TAK-003) নামে একটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এটি ২০২২ সালের আগস্টে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য ইন্দোনেশিয়া জাতীয় ওষুধ ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। ছয় বছর থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে যে কোনো সেরোটাইপের ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা দেবে বলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর প্রায় ১২টি দেশে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ফেজ-১, ২ ও ৩ পর্যায়ের ট্রায়ালে এই ভ্যাকসিন কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয়েছে। এ টিকাটি ছয় বছরের বেশি সবাইকে দেওয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই দুটি ডোজ দিতে হবে। প্রথম ডোজ দেওয়ার তিন মাস পরে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হয়। এতে শরীরে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় বলে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে গবেষণালব্ধ নিশ্চিত প্রমাণ নেই। চার থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষকে এ টিকা দেওয়া যাবে। QDENGA® প্রয়োগের ক্ষেত্রে আগে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছিল কি না, তা পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। এটি DENV-2 ধরনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। তবে অন্য তিনটি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট ডেঙ্গু জ্বর থেকেও সুরক্ষা দেবে বলে জানানো হয়েছে। এরই মধ্যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউকে, আইসল্যান্ড, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশ জাপানের তৈরি এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে।
ভারতের প্যানেসিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেরাম ইনস্টিটিউট যৌথভাবে ডেঙ্গু ভ্যাকসিন তৈরির প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। এই কোম্পানির ভ্যাকসিনটির তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরও ৭টি কোম্পানি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিভি১-ডিভি ৪, টেট্রাভেক্স-ডিভি-টিভি ০০৩, আভিদা বায়োটেকস, কে. এম. বায়োলিক্স কেডি ৩৮২/ টেট্রাভ্যালেন্ট, ইমার্জেক্স পেপজিএনপি-ডেঙ্গু, কোডাভ্যাক্স-ডেনভি, প্যানাসিয়া বায়োটেক ইত্যাদি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন আমদানি এবং প্রয়োগ করবে কি না সেটি নানা মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। তবে এটির আমদানি এবং প্রয়োগের পূর্বে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যারা এটি প্রয়োগ শুরু করেছে তাদের কাছ থেকে এর ফলাফল এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ, গবেষক
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: [email protected]
০৮ আগস্ট, ২০২৩