বেনজীর আহমেদ সিঙ্গাপুরে
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদকে আগামী বৃহস্পতিবার হাজিরা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নোটিশ দিলেও তিনি দেশে নেই। স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে তিনি দেশ ছেড়েছেন আগেই।
সূত্র বলছে, বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশটির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। সঙ্গে স্ত্রী জিশান মির্জা ও দুই কন্যাকেও নিয়ে যান। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তিনি স্ত্রীর চিকিৎসার কথা বলে সিঙ্গাপুরে গেছেন এবং সেখানে অবস্থান করছেন।
পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে সিঙ্গাপুর গেছেন, তা পুলিশের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত। তবে কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খুলছেন না।
দায়িত্বশীল এক পুলিশ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, বেনজীর যখন সপরিবারে সিঙ্গাপুর যান, তখন দুদক তাকে নোটিশ দেয়নি, তার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা নেই। এজন্য স্বাভাবিকভাবেই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকায়নি, বরং সাবেক আইজিপি হওয়ায় অনেকটা সুবিধা নিয়েই ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন তিনি।
আলোচনায় থাকা বেনজীর আহমেদ সিঙ্গাপুরেই অবস্থান করছেন, নাকি সেখান থেকে অন্য কোনো দেশে চলে গেছেন, তা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা। অসমর্থিত সূত্র বলছে, তিনি এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে দুবাই চলে গেছেন। সেখানেই তিনি সপরিবারে থিতু হওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন।
অবশ্য গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমি এখনো সঠিক জানি না, তিনি (বেনজীর আহমেদ) আছেন নাকি চলে গেছেন। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে আমরা এখনো নিষেধাজ্ঞা দিইনি। সে যদি নিষেধাজ্ঞার আগে চলে গিয়ে থাকে...। আমি এখনো কিন্তু সঠিক জানি না, সে আছে নাকি চলে গেছে। আমাকে জেনে কথা বলতে হবে। তিনি আছেন কি না, সেটা আমি এখনো সুনিশ্চিত নই। আমার পুলিশ বাহিনী অনেক ভালো কাজ করছে, অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। কোনো ব্যক্তি যদি কিছু করে থাকে, তার দায় প্রতিষ্ঠান নেয় না।’
আরেক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন, অন্যায়ভাবে ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে থাকেন, আমাদের দেশে সেই অনুযায়ী বিধান রয়েছে, বিচার হবে। সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। সে কী দোষ করেছে, সেগুলো আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য নেই। এগুলোর তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের পর জানা যাবে তিনি দোষী, না নির্দোষ কিংবা কত পরিমাণ অর্থ বানিয়েছেন, কর ফাঁকি দিয়েছেন বা সম্পদ বানিয়ে তার তথ্য দেননি। এগুলো আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধানের আগে আমার মুখ দিয়ে বলা সঠিক নয়।’
অবশ্য গত শুক্রবার কালবেলার প্রতিবেদক রাজধানীর গুলশানে বেনজীর আহমেদের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে সাবেক পুলিশপ্রধান বা তার স্ত্রী-সন্তানরা সেখানে আসেন না।
তিনি কোথায় আছেন এবং ৬ জুন বৃহস্পতিবার দুদকে হাজিরা দেবেন কি না, জানতে বেনজীরের মোবাইল ফোন নম্বরে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে সেটি সক্রিয় পাওয়া যায়। তাতে রিং হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। তার বক্তব্য চেয়ে মেসেজ পাঠালেও কোনো সাড়া দেননি সাবেক এই পুলিশপ্রধান।
বেনজীরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর তিনি দেশে যোগাযোগ রেখেছিলেন। গত ২৬ মে আদালত তার ও স্ত্রী সন্তানদের স্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেওয়ার পরও তিনি যোগাযোগ করেন ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে। সম্প্রতি তার সেই যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কাউকে ফোনো দেন না, হোয়াটসঅ্যাপে কল করলেও তিনি ধরেন না।
ঘনিষ্ঠ ওই সূত্রটি জানায়, তিনি (বেনজীর) কি দুদকে হাজিরা দিয়ে তার সম্পত্তির স্বপক্ষে দলিলপত্র উপস্থাপন করবেন, নাকি তা এড়িয়ে বিদেশেই স্থায়ী হবেন—তা জানতে ৬ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এমনও আলোচনা রয়েছে, আইনজীবীর মাধ্যমে স্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানিয়ে সেদিন সময়ের আবেদন করতে পারেন। তা ছাড়া তার ঠিকানায় দুদকের নোটিশ গেলেও তিনি তখন উপস্থিত না থাকায় সেটি অবগত নন বলে পরে আইনি সুযোগও নিতে পারেন।
বেনজীরকে ৬ জুন দুদকে হাজির থাকার জন্য বলা হলেও ৯ জুন তার স্ত্রী জিশান মির্জাসহ সন্তানদের হাজির হতে বলা হয় নোটিশে।
আদালত বেনজীরসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব এবং বিভিন্ন কোম্পানিতে তাদের নামে থাকা শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন। তবে সূত্র বলছে, এসব ঘটতে পারে বলে তিনি হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন। এজন্য ব্যাংকের অনেক ফিক্সড ডিপোজিট বা এফডিআরসহ বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নেন। তবে বিষয়টি অতি ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কাউকে বুঝতে দেননি।
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পায় দুদক। এরপর দুদক এসব সম্পদ জব্দ (ফ্রিজ) করার আবেদন করলে আদালত তা আমলে নেন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ। অবশ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের আগস্টে তিনি জাতিসংঘের পুলিশপ্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। তবে সম্মেলনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বাইরে ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও তিনি যেতে পারেননি।
চাকরি জীবনে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা স্মার্ট কথাবার্তা ও চলাফেরার জন্য সব সময়েই আলোচনায় ছিলেন। শুদ্ধাচার ও বাহিনীর পদকও পেয়েছেন বারবার। কিন্তু তার অঢেল সম্পত্তি ও দুর্নীতির চিত্র সামনে আসার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে।
০২ জুন, ২০২৪