দালালেই ভরসা বিদেশযাত্রা
সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের কয়েক গুণ বেশি টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে অনেকে চাকরি পাচ্ছেন না। আবার দালালদের বিভিন্ন প্রলোভনে অনেকে বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেন। অনেককে আবার শূন্যহাতে ফিরতে হয়। দালালের খপ্পরে পড়ে টাকা দিয়ে অনেকে বিদেশ যেতে পারেন না। প্রতিনিয়ত এমন অহরহ খবর শোনা গেলেও বিদেশযাত্রায় কমছে না দালালনির্ভরতা। অর্থাৎ এখনো দালালই ভরসা বিদেশযাত্রায়। এতে খরচও বেশি হয়। শহরের তুলনায় এ ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চলে। বিদেশ যেতে সবচেয়ে বেশি দালালনির্ভর সিলেট বিভাগের মানুষ। বিদেশ যেতে অধিকাংশ মানুষ ঋণ করেন। ঋণ করে বিদেশ যান বেশি বরিশালের মানুষ। অন্যদিকে সৌদি আরব থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ ফেরত আসছেন। সবচেয়ে বেশি ফেরত আসছেন চট্টগ্রামের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি দালালকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন। রংপুর ছাড়া বেশিরভাগ বিভাগে অভিবাসন খরচের জন্য দালালদের ওপর ব্যাপক নির্ভর করতে হয়। জরিপে চাকরি বা বসবাসের জন্য বিদেশে যাওয়াকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি নিজ দেশ ছেড়ে গন্তব্য দেশে ন্যূনতম ছয় মাসের জন্য থাকেন, তাদের আন্তর্জাতিক অভিবাসী বলা হয়। জরিপে দেখা যায়, যারা বিদেশ গেছেন তাদের ৫২ দশমিক ০৩ শতাংশ মানুষ দালালকে টাকা দিয়েছেন। এই হার শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। যেখানে বিদেশ যেতে দালালকে টাকা দিয়েছেন শহরের ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ মানুষ, সেখানে দালালকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন ৫৩ দশমিক ১০ শতাংশ গ্রামের মানুষ। বিদেশযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও সরকারিভাবে খুব বেশি মানুষ বিদেশ যাচ্ছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গেছেন মাত্র ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ মানুষ। আর দালারের বাইরে বেসরকারি কোম্পানি বা এজেন্সিগুলোকে টাকা দিয়ে বিদেশ গেছেন ৪২ দশমিক ০৯ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্যভাবে বিদেশ গেছেন ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিদেশ গমনে সবচেয়ে বেশি দালালনির্ভর সিলেট বিভাগের মানুষ। এই বিভাগের ৫৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ বিদেশে গেছেন দালালের মাধ্যমে। এর পরই ময়মনসিংহ (৫৭.৪৪ শতাংশ) বিভাগের অবস্থান। শুধু বরিশাল ও খুলনা বিভাগে এ হার ৫০ শতাংশের কম। বরিশালে দালাল ব্যবহার করেছেন ২৮ দশমিক ৮২ শতাংশ অভিবাসী এবং খুলনায় এ হার ৪৫.৩৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিবাসনের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা। শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের সম্পৃক্ততা দরিদ্র কর্মীদের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান কালবেলাকে বলেন, সাধারণত আমাদের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ঢাকানির্ভর। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের কোনো মানুষ যখন চিন্তা করেন বিদেশ যাবেন; তখন তাকে কোন দেশে যাবেন, চাহিদা কেমন, কী কাজ করবেন এসব বিষয়ে সেবা দেওয়ার কেউ থাকেন না। এই সুযোগটা কাজে লাগায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। বিদেশ থেকে আনার ক্ষেত্রেও মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠেছে। এদের কারণে আমাদের দেশ থেকে বিদেশ যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি এবং আয় সবচেয়ে কম। তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানে সচেতনতা জরুরি। পাশাপাশি বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি সেবাগুলোকে আরও সহজ করতে হবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জটিলতা এবং সব জায়গায় রিক্রুটিং এজেন্সি না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদেশ যাওয়ার আগে পাসপোর্ট, মেডিকেলসহ যাবতীয় কাজে মানুষ দালারনির্ভর হয়ে যায়। তাই সেবার পরিধি বাড়ানোর পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ ঋণ করে বিদেশে যান। ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ বিদেশ যেতে ঋণের ওপর নির্ভর করেন। শহরের তুলনায় ঋণ করে বিদেশ যান বেশি গ্রামের মানুষ। শহরে যেখানে ৫১ দশমিক ৮৩ শতাংশ মানুষ ঋণের ওপর নির্ভর করেন, সেখানে ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ গ্রামের মানুষ বিদেশ যেতে ঋণ নিয়েছেন। নারীদের তুলনায় পুরুষরা অনেক বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। ৩৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ নারী বিদেশ যেতে ঋণ নেন। সেখানে পুরুষের ঋণ নেওয়ার হার ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিদেশ যেতে সবচেয়ে বেশি ঋণনির্ভর বরিশাল বিভাগের মানুষ। বিদেশ যেতে এই বিভাগের ৬৮ দশমিক ৫১ শতাংশ মানুষ ঋণ নেন। ঋণ নেওয়ার হার সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। এই বিভাগের ৪৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে বিদেশ যান। ব্রিটেন ও কানাডা বাদে বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীরা শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন। শ্রমিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি গেছেন মালদ্বীপে ৯৮.০৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৯৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ ও সৌদি আরবে ৯৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এই দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা বেশি। এসব দেশে পুরুষ বেশি গেছেন। নারীরা বেশি গেছেন কুয়েতে ৭২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, ওমানে ৫৫ দশমিক ২২ শতাংশ ও সৌদিতে ৫০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বিদেশ যাওয়ার পাশাপাশি স্থায়ীভাবে ফিরেও আসছেন অনেকে। সবচেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সবচেয়ে বেশি মানুষ ফেরত আসছেন সৌদি থেকে ৩৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর পরও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১৪ দশমিক ০২ এবং মালয়েশিয়া থেকে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ মানুষ ফেরত এসেছেন। বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ফেরত এসেছেন চট্টগ্রামের মানুষ। ফেরত আসাদের মধ্যে ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগের ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। সবচেয়ে কম ফেরত এসেছেন রংপুর বিভাগের মানুষ, ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। দেশে ফেরত আসাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি। জরিপে গত ৫ বছরের মধ্যে বিদেশ থেকে যারা স্থায়ীভাবে দেশে ফেরত এসেছেন, তাদের বিদেশফেরত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফিরে আসার কারণ সংক্রান্ত উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিদেশফেরতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭.২৮ শতাংশ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২.৮০ শতাংশ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফেরত পাঠানো হয়েছে ১১.৬৭ শতাংশ, স্বাস্থ্যগত কারণে ৯.২৪ শতাংশ, করোনার কারণে ৯.২১ শতাংশ, পরিবারের সঙ্গে বসবাসের জন্য ৭.৯৬ শতাংশ এবং কাজ হারানোর কারণে ৭.১৮ শতাংশ ব্যক্তি স্থায়ীভাবে ফেরত এসেছেন। বিদেশ গমনকারীদের বেশিরভাগ পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এই হার ৫৩.৯১ শতাংশ। এসএসসি বা সমমান পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ গেছেন ১০.৭৫ শতাংশ এবং এইচএসসি বা সমমান পর্যন্ত পড়াশোনা করে বিদেশ গেছেন ১৮.৯৬ শতাংশ। যারা কখনো স্কুলে যাননি, এমন অভিবাসী ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। অধিকাংশ মানুষ বিদেশ যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন না। জরিপে বলা হচ্ছে, বিদেশ যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ। প্রশিক্ষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি যান রংপুর বিভাগের মানুষ, এই হার ৪০.৮৩ শতাংশ। সিলেট বিভাগে সর্বনিম্ন ৫.৪০ শতাংশ মানুষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। এ বিষয়ে শরিফুল হাসান বলেন, দেশের মানুষের প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রতি অনীহা রয়েছে। তারা ৫ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যেতে চান, কিন্তু ১০ হাজার টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ নিতে চান না। যে কারণে বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের সংকট এবং বিপদের সম্মুখীন হন। ভালো কাজ এবং ভালো বেতনের জন্য দক্ষতার বিকল্প নেই। অভিবাসীদের দক্ষতা বাড়িয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা গুরুত্বপূর্ণ।
১৪ জুন, ২০২৪

খালেদার বিদেশযাত্রা অনিশ্চিত
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গতকাল রোববার তার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে আইন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিদেশ যেতে হলে খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে। কিন্তু বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি। বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দাবি, সরকার চাইলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারে। এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার কথা বলা হলেও খালেদা জিয়ার আবেদন বাতিল হওয়ার পেছনে অন্য কারণের কথা বলছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত না মানায় খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছিল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা বলে তার পরিবার আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তাদের ধারণা ছিল, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে এবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। সরকারের তরফ থেকেও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল, খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য করা পরিবারের আবেদন ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই আবেদন নাকচ করে আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিদেশে যেতে হলে খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে আবার আদালতে আবেদন করতে হবে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এর আগে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মতামত দিয়েছেন, তা-ই আইনের অবস্থান এবং সেটিই সঠিক।’ পরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত আইনি ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘প্রথম যে আবেদনটি ছিল, যা ২০২০ সালের মার্চে নিষ্পত্তি হয়। সেই আবেদনে বলা ছিল, খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ, তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা যেন করা হয়। তখন দুটি শর্তে তার দণ্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা-১-এর ক্ষমতাবলে দেওয়া হয়েছিল। শর্তগুলো হলো প্রথমত, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। সেই শর্তগুলো মেনে খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত হন এবং বাসায় ফিরে যান। সেভাবেই সেই দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়। তবে প্রতি ছয় মাস বৃদ্ধি করা যাবে কি না, বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল। এরপর সেই সময়সীমা ছয় মাস করে মোট আটবার বাড়ানো হয়েছে। চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশে যেতে আইনে কেন সুযোগ নেই, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই মতামত হচ্ছে, ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটি অতীত ও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার কোনো উপায় নেই।’ এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার পরিবার তাকে বিদেশে পাঠাতে চাইলে তাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে জান একজন সাংবাদিক। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তাকে ফৌজদারি ৪০১ ধারায় দুটি শর্তযুক্তভাবে যে আদেশবলে সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি বাতিল করে তারপর আবার ফের বিবেচনা করার সুযোগ থাকলে তা করা হবে।’ এর আগে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হলে তাকে আদালতে গিয়ে আবেদন করতে হবে। আদালত যদি অনুমতি দেন, তাহলে তিনি বিদেশে যেতে পারবেন।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটি হচ্ছে এখন যে আদেশ আছে, যদি সেটি বাতিল করে তাকে আবার কারাগারে নেওয়া হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। এ অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে পারেন বলে এ রকম সুযোগ নেই।’ এরপর একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, তাহলে সেই আদেশ বাতিল করা হবে কি না? জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বাতিল করাটা অমানবিক হবে, বাতিল করব না।’ খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন বাতিল হওয়ার পর গতকাল রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দাবি করেন, খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল—তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’ এদিকে চিকিৎসার জন্য ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে না দেওয়ার সরকারি এই সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ বলে মনে করছে বিএনপি। খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের অভিযোগ, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে, দেশে আইনের শাসন নেই। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারত এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারত।’ জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে পরিবারের করা আবেদন নাকচ হওয়ায় একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে এই ইস্যুকে জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করবে বিএনপি। একদফা দাবি আদায়ে জোটগত কর্মসূচির পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে দলীয়ভাবে কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। আজ সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকার নতুন করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাতে দেখা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমে সুরাহার পথ বের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে কারাবন্দি থাকা অবস্থায় আ স ম আবদুর রব এবং প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন কেন পাবেন না? খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সরকার যা করছে তাতে মনে হয়, তাদের কাছে আইন ও বিধিবিধান কিছুই নয়। সরকার পরিকল্পিতভাবে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নেত্রীর যদি কিছু হয়, তাহলে এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’ এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বোনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ আবেদন মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৫৩ দিন ধরে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উনার লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে পাঠানো দরকার।’ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে সরকার তাকে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্তি দেয়। এরপর পরিবারের আবেদনে ছয় মাস পরপর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে সরকার। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর এই মেয়াদ আরও ছয় মাসের জন্য বাড়ানো হয়।
০২ অক্টোবর, ২০২৩

সম্রাটের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে দুদকের আবেদন খারিজ
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলার আসামি যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে দুদকের আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সম্রাট আদালতের আদেশ অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এসে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার পর এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে গতকাল বুধবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। সম্রাটের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী। এর আগে সম্রাটের আইনজীবী লিখিতভাবে আদালতকে জানান, গত ১৫ জুলাই মেডিকেল চেকআপের জন্য সম্রাট কলকাতায় যান। চিকিৎসা শেষে ২৪ জুলাই তিনি দেশে ফিরে এসেছেন। গত ১ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক মঞ্জুরুল ইমাম চিকিৎসার জন্য সম্রাটকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেন। তার বিদেশ যাওয়ার অনুমতির আদেশ স্থগিত চেয়ে গত ১৩ জুলাই হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। পরে গত ১৬ জুলাই এ আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার একদিন আগে ১৫ জুলাই রাতে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান সম্রাট। ১৬ জুলাই শুনানিতে সম্রাটের বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি দুদকের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের নজরে আনা হয়। পরে হাইকোর্ট দুদকের আবেদনের শুনানি ১ আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি (স্ট্যান্ডওভার) রাখেন। সে অনুযায়ী বুধবার দুদকের আবেদনের ওপর ফের শুনানি হয়। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০১৯ সালে সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর সম্রাটের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে তার বিরুদ্ধে ২২২ কোটি ৮৮ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৩ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া অভিযোগপত্রে ২১৯ কোটি ৪৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। এতে বলা হয়, এ টাকা তিনি পাচার করেছেন। গত বছরের ২২ মার্চ অভিযোগপত্র আমলে নেন আদালত। এ মামলা হওয়ার আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সম্রাট ও তার সহযোগী তৎকালীন যুবলীগ নেতা এনামুল হক ওরফে আরমানকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে সম্রাটকে নিয়ে তার কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান চালায় র্যাব। সেখানে বন্যপ্রাণীর চামড়া, মাদক ও অস্ত্র পাওয়ার কথা বলা হয়। বন্যপ্রাণীর চামড়া রাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এরপর বেশ কিছুদিন কারাভোগের পর সম্রাট জামিন পান।
০৩ আগস্ট, ২০২৩

বিএনপির বিদেশযাত্রা
মোহাম্মাদ জুয়েল হোসেন গাজী নামে ঢাকার মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। আবেদন গ্রহণ করে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তাকে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৬ মে তাকে কানাডায় প্রবেশের অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আবেদন নাকচ হওয়ার পর ফেডারেল কোর্টে জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন করেছিলেন জুয়েল হোসেন গাজী। বিএনপির সদস্য হওয়ায় তাকে কানাডায় প্রবেশের অনুপযুক্ত ঘোষণা করে বলা হয়, ‘বিএনপি সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত ছিল, লিপ্ত আছে বা লিপ্ত থাকবে—এটি বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে’। এ সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে কানাডার ক্রিমিনাল কোডের ধারা তুলে ধরে সংশ্লিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিএনপির ডাকা হরতাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিএনপি কর্মীদের হাতে মালামালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও মৃত্যু এবং আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আমি লক্ষ করেছি, অতীতে কোনো কোনো ঘটনায় বিএনপির নেতৃত্ব নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে এবং সন্ত্রাসী তৎপরতার নিন্দা করেছে। কিন্তু বিএনপির দাবি-দাওয়া সরকারকে মানতে বাধ্য করতে লাগাতার হরতালের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা প্রমাণ করে, এটি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বাইরে চলে গেছে।’ বিএনপি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকে তখন বিরোধী দল নিধনে যা যা করেছে তা পাঠক মাত্রই জেনে থাকবেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো সন্ত্রাসী হামলা বিশ্ববাসীর জানা নেই। নৃশংস ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৩০০ লোক আহত হন। হামলায় নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী আইভি রহমান অন্যতম, যিনি বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী। বিএনপির সন্ত্রাসের নজির আগেও দেখা গেছে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনায় দায়িত্বে আসে। তার তিন মাসে আগেও ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর জনসভায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল। সে সময়কার সব দৈনিকে সেই সংবাদ ছাপা হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ভাষ্যমতে, ‘‘গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর অকস্মাৎ একটি মাইক্রোবাস হইতে সভামঞ্চ লক্ষ্য করিয়া গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হইলে অন্তত ২০ জন আহত হন। এদের মধ্যে তিনজনকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মাথায় গুলিবিদ্ধ অজ্ঞাতপরিচয় একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সমাবেশে সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হামলা চালানো হয়।’’ ওই দিনের হামলা শুধু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সীমাবদ্ধ ছিল না। হামলার রেশ চলছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও। সংবাদপত্র তথ্য অনুসারে, ‘‘একই মাইক্রোবাস থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও টিএসসি এলাকায় গুলিবর্ষণ করা হয়।’’ ওই ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো গুলিস্তান ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জনসভায় সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি ও ভাষণ প্রদানকে কেন্দ্র করে তার জীবননাশের ষড়যন্ত্র রচিত হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ সবকিছু মিলিয়ে এমন একটি ভীতিকর ও ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয় যা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। ওই মিছিলে ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহজাহান আলম বক্তৃতা করেন। কিন্তু তার বক্তৃতা চলাকালীন পর পর কয়েকবার ফাঁকা গুলি বর্ষিত হয়। বিএনপি আমলের এই হামলা-মামলা, আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুলি করার প্রবণতা শুধু যে এতটুকুতে শেষ হয়েছে, তা নয়। এর পরও পেট্রোল বোমা, হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারাসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অগণিত উদাহরণ তারা স্থাপন করেছে। দলটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান; যিনি বাংলাদেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও একজন দুর্নীতিপরায়ণ ও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত। বিদগ্ধ পাঠক নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন, ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট বেগম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের অপকর্ম উইকিলিকসে ফাঁস হয়; যেখানে তারেককে Symbol of violent politics বা ‘সহিংস রাজনীতির প্রতীক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ারটি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে পাঠানো এক বার্তায় উল্লেখ করেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও উগ্র এমন এক সরকার যে তার নিজের দেশের জনগণ ও সম্পদ লুণ্ঠন করে—তার প্রতিনিধিত্ব করেন তারেক। এ তথ্যই পরে (২০১১ সালের ৩০ আগস্ট) উইকিলিকস ফাঁস করে। বার্তায় আরও বলা হয়, ‘তারেক রহমান সরকারি তহবিল থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যমপন্থি (মডারেট) এই দেশটিতে স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টা নষ্ট করে দিচ্ছে।’ মরিয়ারটির সুপারিশ ছিল, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। এর ছয় মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স গীতা পাসির পাঠানো বার্তায় বলা হয়, তারেক রহমানের ভিসা বাতিলের কথা চিন্তা করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। সবকিছু বুঝতে পেরেই চিকিৎসার নামে ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। যিনি দুটি মামলা তথা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও মুদ্রাপাচার মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। পাঠকদের সামনে ২০১১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’ এর প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতি দৃষ্টি আর্কষণ করব। শিরোনামের কথা আগেই উল্লেখ করেছি—‘ Tarique symbol of violent politics’ (Portraying Tarique Rahman as a symbol of “kleptocratic government and violent politics” in Bangladesh, the US embassy in Dhaka even recommended blocking his entry into the United States. The embassy believed Tarique was “guilty of egregious political corruption that has had a serious adverse effect on US national interests”, namely the stability of democratic institutions and US foreign assistance goals, a leaked US embassy cable says.) ১৯৭৮ সালে বিএনপি যখন প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসে তখন এর গঠন ও দর্শন নিয়ে পাকিস্তানের দি হেরাল্ড পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। যার ভাষ্য ছিল এমন, ‘বিএনপির জন্ম ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নীলনকশার ফলশ্রুতি।... এই দলের জন্য যে দর্শন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা হলো আওয়ামী লীগের দুর্বল স্থানে আঘাত করা এবং জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব জাগ্রত করা।’ বিএনপির বয়স একেবারে কম নয়; দেখতে দেখতে ৪৪ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এ দল এখন পর্যন্ত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন হলো না। বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিবের কাছে দুর্নীতিবিষয়ক দুটো প্রমাণপত্র দিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানে কথোপকথন। সেখানে অডিও তে সরকারের দুজন ব্যক্তি ‘ইনফোসরকার’ বিষয়ক কথা বলছিলেন এবং ‘এলটিএম’ বিষয়ক অগ্রগতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। এটা নিয়ে দু-চারটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হয়েছিল ‘এলটিএম’ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কোম্পানি। এই হচ্ছে বিএনপির অবস্থা। ‘এলটিএম’ মানে হচ্ছে ‘লিমেটেড টেন্ডারিং মেথট’। বিএনপি বারবার ভ্রান্তির রাজনীতি করেছে ; দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। দীর্ঘ সময়ের রাজনীতিতে বিএনপির এমন বহু অনিয়ম-অপকর্ম রয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষ বারবার বিশ্বাস করেছে, তাদের বিশ্বাস করতে হয়েছে। আর এ কারণেই তারা বারবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপাঙক্তেয় হয়েছে। অনেকেরই মনে থাকবে বিএনপি ২০১৯ সালে একবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের গেটে আরেকটি বিষয় নিয়ে হাজির হয়েছিল। বিষয়টা ছিল সরকার সংবিধানের ১৪৫ক ধারা লঙ্ঘন করেছে। এবার দেখা যাক সংবিধানের ১৪৫ ক ধারায় কী বলা হয়েছে। শিরোনাম হচ্ছে আন্তর্জাতিক চুক্তি।—“বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন।’ বিএনপির অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের সময়ে ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এবং তা সংসদে উপস্থাপিত হয়নি । অথচ সে সময়কার কথা সবারই মনে থাকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো পানি চুক্তি হয়নি। আন্তর্জাতিক চুক্তি আর সমঝোতা স্মারক এ দুয়ের পার্থক্য বুঝতে বিএনপির অনেক সময় লাগে। এখন তারা সবকিছু হারিয়ে বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে আছে। লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
০২ জুলাই, ২০২৩
X