বিলুপ্তির আশঙ্কায় বাঘাইড় মাছ
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মায় নির্বিচারে শিকার ও বিক্রি করা হচ্ছে নিষিদ্ধ মহাবিপন্ন প্রজাতির বাঘাইড় মাছ। রীতিমতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে চড়া দামে এই মাছ বিক্রি করা হচ্ছে। বাঘাইড় মাছ শিকার ও বিক্রয় বন্ধে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই সংশিষ্টদের।এভাবে অবাধে বাঘাইড় মাছ নিধন অব্যাহত থাকলে অচিরেই বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  জানা যায়, পদ্মা-যমুনা মিলিত হয়েছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটরের অদূরে। পদ্মা-যমুনার এই মোহনায় জেলেদের জালে ধরা পড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এ সকল মাছের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ কর্তৃক চিহ্নিত মহাবিপন্ন প্রজাতির বাঘাইড় মাছ। সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এই মাছের ব্যাপক চাহিদা। তাই শিকার করা ওই সকল বাঘাইড় মাছ প্রকাশ্যে উচ্চ মূল্যে বিক্রিও করা হচ্ছে।  ধরা পড়া বাঘাইড় মাছের ছবি ও মাছ ব্যবসায়ীর মুঠোফোন নম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিলে মুহূর্তের মধ্যেই তা ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এই মাছ বিক্রির জন্য এরইমধ্যে দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ীরা সারাদেশে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। অথচ মহাবিপন্ন প্রজাতির এই মাছ ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহন আইনত নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযাগ্য অপরাধ। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই চলছে বেচাকেনা।  বাঘাইড় মাছ বাংলাদশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ২নং তপশিলভুক্ত একটি সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী।এই আইন অনুযায়ী বাঘাইড় মাছ শিকার, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন কিংবা দখল রাখার অপরাধ সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড-ই হতে পারে। স্থানীয়রা জানান, পদ্মা নদী থেকে শিকার করা বাঘাইড় মাছ প্রায় প্রতিদিনই দৌলতদিয়া ঘাটে মাছের আড়তে বেচাকেনা হয়ে থাকে। ৫ থেকে ২০ কজি পর্যন্ত বাঘাইড় মাছ এ এলাকায় বেশি ধরা পড়ে। আর মাঝে মাঝে বিশাল আকৃতির দুই একটা ধরা পড়লে ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে মাছ ব্যবসায়ীরা। এরপর সারা দেশের ভোজন রসিকরা বড় আকৃতির ওই সকল বাঘাইড় মাছ কিনতে যোগাযোগ শুরু করে দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। এভাবে উচ্চ মূল্যে বাঘাইড় মাছ বিক্রি হয়ে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করা জেলেরা জানান, ৫-১০ কেজির বাঘাইড় মাছ পদ্মা নদীতে প্রায় প্রতিদিনই পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে বড় আকারের বাঘাইড় মাছও জালে ধরা পড়ে। বিক্রিতে কোন সমস্যা হয় না। কারণ বাঘাইড় মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে ভালো দামে বিক্রি হয়। আর যদি বড় সাইজের বাঘাইড় মাছ ধরা পড়ে, তাহলে মাছ ব্যবসায়ীরা নদীতেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিনে নেয়। তারা এখনো পর্যন্ত কোনদিন বাঘাইড় মাছ শিকার করার দায়ে দণ্ডিত হননি বলে জানান। দৌলতদিয়া ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী করিম চাদনী আড়ৎদার জানান, পদ্মা নদীতে প্রায় সব সময়ই বাঘাইড় মাছ ধরা পড়ে। সারা দেশ থেকেই তাদের কাছে ক্রেতারা বাঘাইড় মাছ কিনে থাকেন। বেশিরভাগ বাঘাইড় মাছ ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে বিক্রি করা হয়। এছাড়া বড় আকারের বাঘাইড় মাছের জন্য আগে থেকেই ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে বলে রাখেন। তাদের চাহিদা মতো বাঘাইড় মাছ পাওয়া গেলে পৌঁছে দেওয়া হয়। গোয়ালন্দ মোড়ের আরেক মাছ ব্যবসায়ী মো. সোহেল মোল্লা বলেন, আমরা শুনেছি যে বাঘাইড় মাছ শিকার করা বা বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এ বিষয়ে প্রশাসন থেকে তাদেরকে কখনো কিছু জানানো হয়নি এবং কোন প্রকার অভিযানও চালানো হয়নি।  বাংলাদেশ সুপ্রিম কার্টের আইনজীবী অ্যাডভাকেট অভিজিৎ সোম বলেন, বাঘাইড় মাছ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে শিকার, পরিবহন ও বিপনন দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে মৎস্য আইনে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এখানে আইনের কিছুটা অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান। অথচ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মাছের সঙ্গে মারা পড়ছে বাঘাইড় মাছ। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এই মাছের অস্তিত্ব থাকবে না। বিপন্ন প্রজাতির এই বাঘাইড় মাছ রক্ষায় আইনের অসামঞ্জস্যতা দুর করে সময়োপযাগী ও বাস্তবতার নিরীক্ষে মৎস্য বিভাগ ও বন বিভাগের সম্বয়ে আইনটি সংস্কার করা প্রয়োজন। রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.মশিউর রহমান বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে বাঘাইড় মাছ শিকার বা বিক্রি শাস্তিযাগ্য অপরাধ হলেও মৎস্য আইনে এ ধরনের কিছু নেই। তাই মৎস্য আইন এ সকল জেলে বা মাছ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাদের কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে তারা এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করে থাকেন। স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন বলে তিনি জানান।  গোয়ালন্দ উপজলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো.জাকির হোসেন জানান, পদ্মা-যমুনার মোহনায় প্রতিনিয়ত জেলেদের জালে বাঘাইড় মাছ ধরা পড়ার বিষয়টি এরইমধ্যে নজরে এসেছে। এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২ যাচাই-বাছাই করে নির্দেশনা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৩ নভেম্বর, ২০২৩
X