বিশ্ব পানি দিবস আজ / পানির অভাবে চলনবিলের সব নৌরুট বন্ধ
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের চলনবিল এলাকার নদনদীগুলোতে পানি নেই। এতে চলনবিলের সব নৌরুট বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুন মাস আসতে না আসতেই পানিশূন্য হয়ে পড়ছে এ এলাকার নদনদী, খাল-বিল। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সেচ ব্যবস্থা। বিলুপ্ত হচ্ছে নানান প্রজাতির দেশীয় মাছ। পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম ও সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়ার আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত চলনবিল। এ এলাকার অধিকাংশ নদনদীই দীর্ঘদিন খনন করা হয়নি। ফলে নাব্য সংকট বাড়ছেই। অপরিকল্পিতভাবে আত্রাই, গুমানীসহ দু-একটি নদী খনন করা হলেও তার সুফল পাচ্ছেন না এলাকার মানুষ। নদীরক্ষা আন্দোলনে যুক্ত, স্থানীয় বাসিন্দাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দখল, লিজ নিয়ে মাছচাষ, অপরিকল্পিত খনন, ক্রসবাঁধ, মাটি বিক্রিসহ নানা কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে চলনবিল। বড়াল নদীও লিজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। পদ্মার চারঘাট মোহনা থেকে নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম হয়ে চাটমোহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নূরনগরে গুমানীর সঙ্গে মিশে বড়াল নামেই ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর বাঘাবাড়ী হয়ে হুরাসাগরে মিশে নাকালিয়া এলাকায় গিয়ে যমুনার সঙ্গে মিশেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝিও নদীটি স্রোতস্বীনি থাকলেও একেবারে শেষের দিকে রাজশাহী থেকে নূরনগর পর্যন্ত নদীটির অনেক স্থানে ক্রসবাঁধ দেওয়া হয়। মাছচাষের নামে নদীটি লিজ দেওয়া হতো। লিজ গ্রহীতারা নদীকে একাধিক খণ্ডে ভাগ করে মাছ চাষ করত। পরে সরকারের সিদ্ধান্তে লিজ বন্ধ রয়েছে। নদী উদ্ধারে বড়াল রক্ষা কমিটি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসার ফলে চাটমোহর নতুন বাজার, বোঁথর ঘাট ও রামনগর ঘাটের তিনটি ক্রসবাঁধ অপসারণ করা হয়। উজান অংশে অবৈধ দখলদাররা নদী বন্ধ করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করায় এবং উৎসমুখ চারঘাটে পানি না থাকায় এ নদীটি মরে যাচ্ছে। নদীটি মরে যাওয়ায় পদ্মার সঙ্গে যমুনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। চাটমোহর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত বর্ষায় অল্প কিছুদিনের জন্য এ নদীটি প্রাণ ফিরে পায়। চেঁচুয়া নদী নাটোরের ধারাবারিষার দক্ষিণ পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের চরসেন গ্রামের পশ্চিমে গুমানী নদীতে মিশেছে। এ নদীটিও প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ চলনবিলের বড়াইগ্রামের চিনাডাঙ্গা বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাটমোহরের মূলগ্রাম ফৈলজানা হয়ে ফরিদপুরের ডেমরার কাছে চিকনাই নদী বড়াল নদীতে মিশেছে। ডেমরা এলাকায় স্লুইসগেট থাকায় ফরিদপুর থেকে নদীটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বর্ষা মৌসুমে মাস চারেক এ নদীতে পানি থাকলেও বাকি আট মাস থাকে পানিশূন্য। এগুলো ছাড়াও বানগঙ্গা, তুলশী নদী, ভাদাই নদীসহ চলনবিলের অন্তত দশ-বারোটি নদী এবং প্রায় দুইশ খাল-বিল-খাড়ি এখন পানিশূন্য। আত্রাইসহ দু-একটি নদী খনন করা হলেও শুরু থেকেই খননকাজে অনিয়ম হওয়ায় চলনবিলের মানুষ খুব একটা উপকার পাচ্ছেন না। খননের নামে নদীর মাটি বালু বিক্রির মহোৎসব শুরু হয়েছিল। অনেক স্থানে নদীর মাটি অন্যত্র সরিয়ে না নিয়ে নদীর মধ্যেই রাখা হয়েছিল। বর্ষায় সেসব মাটি ফের নদীর তলদেশে চলে গিয়ে খনন করা অংশে পড়ছে। ফলে নাব্য সংকট রয়েই গেছে। চাটমোহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোখলেছুর রহমান বিদ্যুৎ জানান, চলনবিল এলাকায় পানি না থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ কম। সড়কপথে বেশি খরচে পণ্য পরিবহন করতে হচ্ছে চলনবিল এলাকার ব্যবসায়ীদের। চলনবিল রক্ষায় আমরা সংগঠনের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম জানান, একসময় ব্যবসায়ীরা নৌকায় পণ্য নিয়ে চলনবিল এলাকার বিভিন্ন হাট-বাজারে যেতেন। নদনদী শুকিয়ে নৌপথ বন্ধ হওয়ায় এখন আর সেটি হচ্ছে না। বেকার হয়ে পড়েছেন হাজারো নৌ শ্রমিক ও মৎস্যজীবী। অনেক মৎস্যজীবী পেশা বদলেছেন। তিনি আরও বলেন, আগে কৃষক নদী থেকে অগভীর নলকূপের সাহায্যে বোরোক্ষেতে সেচ দিতে পারতেন। এখন আর পারছেন না। চাটমোহর সরকারি কলেজের ভূগোল বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান ড. এস এম মুক্তি মাহমুদ বলেন, ভৌগোলিকভাবে এ এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ বার্ধক্য অবস্থায় পরিণত হয়েছে। চলনবিল এলাকার নদীর তলদেশের ঢালের পরিমাণ কম, নদীর প্রবহমান পানির পরিমাণ কম, স্রোতের বেগও কম। উৎসস্থান থেকে নদীগুলোর দূরত্ব অধিক হওয়ায়, পানির সঙ্গে প্রবাহিত মৃত্তিকা কণা, বালুকণা, নূড়িকণা এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনার পরিমাণ বেশি ও নদীর তলদেশে তা সঞ্চয়নের পরিমাণ অধিক হওয়ায় ক্রমেই নদী উপত্যকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে আসছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বড়াল নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে, কোনো নদী লিজ দেওয়া যাবে না। কিন্তু তারপর বড়াল নদী লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। গুমানী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে তলদেশের মাটি অপরিকল্পিতভাবে কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। দখলদারদের কাছ থেকে নদী উদ্ধার করে খননের মাধ্যমে সচল করার দাবি জানান তিনি।
২২ মার্চ, ২০২৪
X