দেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি
বর্তমানে দেশে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি। মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৪ জন। আর পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৩ জন। এ হিসাবে দেশে পুরুষের তুলনায় নারী বেশি ১৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৮১ জন। এ ছাড়া বর্তমান তৃতীয় লিঙ্গের সংখ্যা ৮ হাজার ৭২৪ জন। গতকাল মঙ্গলবার জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিএস। এতে এই চিত্র উঠে এসেছে। এর আগে ২০২২ সালে জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলেও সেখানে জাতীয় পর্যায়ের বিস্তারিত কোনো তথ্য ছিল না। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন।
কর্মসংস্থান কমেছে কৃষি খাতে: গত এক দশকে দেশে কৃষিতে কর্মসংস্থান কমেছে ৯ শতাংশের বেশি। একই সময়ে শিল্প ও সেবা খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। শিল্প খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ আর সেবা খাতে বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কৃষি খাতে বর্তমানে ১০ বছরের বেশি বয়সের ৩৭ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ যুক্ত রয়েছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত আদমশুমারিতে কৃষিতে ৪৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ মানুষের কর্মরত থাকার কথা বলা হয়েছিল। সে হিসাবে কৃষিতে কর্মসংস্থান কমেছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে, শিল্প খাতে ১০ বছরের বেশি বয়সের মানুষের কাজের সুযোগ বেড়েছে। একই সময়ে শিল্পে কর্মরত রয়েছেন ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ। ২০১১ সালে এটি ছিল ১৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ শিল্পে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গত ১০ বছরে সেবা খাতেও কাজের সুযোগ বেড়েছে। এ সময়ে সেবা খাতে ১০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ কাজ করছে ৪৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। অথচ এক দশক আগে এ খাতে কাজ করত ৩৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ মানুষ। এ খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গত ১০ বছরে গৃহস্থালি কাজে মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ কমেছে। ১০ বছর আগে যেটা ছিল ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, তা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ২৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে স্নাতক ডিগ্রিধারী: দেশে বেড়েছে সাক্ষরতার হার। ২০১১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ দশমিক ৮০ শতাংশে। অর্থাৎ সাক্ষরতা হার বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এ সময়ে দেশে ১০ বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে স্নাতক ডিগ্রিধারী। গত এক দশকে ডিগ্রি বা স্নাতক পাস করেছে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০১১ সালে স্নাতক ডিগ্রিধারী ছিল ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। মাস্টার্স ডিগ্রি বা স্নাতকোত্তর অর্জন করেছে এক দশমিক ৭২ শতাংশ, যেখানে ২০১১ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০.৭৭ শতাংশ কখনো স্কুলে যায়নি। স্কুলে গেলেও প্রথম শ্রেণী শেষ করেনি ১ দশমিক ১৭ শতাংশ। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ২৫. ৯১ শতাংশ। এসএসসি পাশ করেনি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এসএসসি পাশ করেছে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। এইচএসসি পাশ করেছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ।
শিক্ষা ব্যবস্থা: পাঁচ বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সীদের সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ কমলেও বেড়েছে কারিগরি শিক্ষায়। ২০১১ সালে সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছিল ৯৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। সবশেষ তথ্য বলছে, সাধারণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ কমে হয়েছে ৮৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ কমেছে ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে বেড়েছ কারিগরি শিক্ষায় অংশগ্রহণ। কারিগরিতে এ হার ২০১১ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ আর ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ধর্মীয় শিক্ষায় অংশগ্রহণ। ২০১১ সালের ধর্মীয় শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছিল ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ২০২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এমনকি ট্রেনিংয়েও নেই দেশে এমন জনসংখ্যা ৩৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।
বেড়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীর হার: দেশের বর্তমান মোট জনসংখ্যায় বেড়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর হার। বাড়েনি সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের হার। মোট জনসংখ্যার তুলনায় কমছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা। গত এক দশকে সংখ্যায় বাড়লেও কমেছে মোট জনসংখ্যার হারে। জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে মুসলমান ধর্মাবলম্বী ১৫ কোটি ৪ লাখ ২২ হাজার ৬০০, হিন্দু ১ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ২০৪, খ্রিষ্টান ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮৩, বৌদ্ধ ১০ লাখ ১ হাজার ৯৭৪ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী রয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৫৫ জন। এ হিসাবে বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার ৯১ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এই হার ছিল ৯০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক দশকে মুসলিম জনগোষ্ঠী বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ।
অন্যদিকে, মোট জনসংখ্যার তুলনায় কমেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা। ২০১১ সালে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশে। এ ছাড়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশে। আর অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা আগে ছিল শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ। এখন তা কমে হয়েছে শূন্য দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জনসংখ্যা আছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন।
বিভাগভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবগুলোতে মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা বেশি। সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস ময়মনসিংহ বিভাগে। এ বিভাগের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৯৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ মুসলিম। অন্যদিকে, সিলেট বিভাগে মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যা বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
২০১১ সালে দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৭৬ জন বসবাস করলেও ২০২২ সালে এসে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করেন ১ হাজার ১১৯ জন।
প্রবাসী জনসংখ্যা: বিভিন্ন দেশে বর্তমানে ৫০ লাখ ৫৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক বসবাস করছেন। সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রবাসে গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে। সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে। তবে বিবিএসের এই প্রতিবেদনের ফলে প্রবাসীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্ঠি হয়েছে। কারণ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশে এখন ১ কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। দুটি প্রতিষ্ঠানের দুই ধরনের তথ্যের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায় বলেন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিবিএসের এ তথ্য তুলনা করা ঠিক হবে না। বিবিএসের এ তথ্য শুধু শুমারিকালে যারা বিদেশে অবস্থান করছিলো তাদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে তালিকায়। আর বিএমইটির তথ্য হচ্ছে ১৯৭৪ সাল থেকে যাঁরা বিদেশে গেছেন তাদের নিয়ে। তাদের সংখ্যা বেশি হবেই। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রবাসীর সংখ্যা নিয়ে আমার কোনো জবাব নেই। গত বছরের জুনে যখন শুমারি হয়, তার ছয় মাস আগে যারা প্রবাসে গেছেন, শুধু তাদের তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর আগে যারা বিদেশে গেছেন, তাদের তথ্য আসেনি। প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বিতর্কমুক্ত থাকুক। এসময় তিনি বলেন, জনশুমারি করার ব্যবধান ১০ বছর থেকে কমিয়ে আনা উচিত। বিবিএসকে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া দরকার। পাশাপাশি প্রতিটি কাজে অপচয় কমিয়ে আনতে হবে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে বেশি নাগরিক বিদেশে অবস্থান করছেন। এই সংখ্যা ২০ লাখ ৫১ হাজার ৯৫২ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন ঢাকা বিভাগের ১৪ লাখ ৩১ হাজার। সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগের মানুষÑ মাত্র ১ লাখ ১৫ হাজার। গত দুই বছরে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসেছেন ৪ লাখ ৬৬ হাজার মানুষ। ফেরার তালিকায় প্রথমেই আছেন চট্টগ্রাম বিভাগের বাসিন্দারা।
কোন বিভাগে কত মানুষের বসবাস: দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে গ্রামে বসবাস করে ১১ কোটি ৬০ লাখ ৬৫ হাজার ৮০৪ জন। শহরে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ৬৩ হাজার ১০৭ জন। বিভাগভিত্তিক বিভাজনে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম মানুষ বাসবাস করে। আর সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে। বরিশাল বিভাগে ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ৮২০ জনের বসবাস, ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ চার কোটি ৫৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৬ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে তিন কোটি ৪১ লাখ ৭৮ হাজার ৬১২ জন। খুলনা বিভাগে এক কোটি ৭৮ লাখ ১৩ হাজার ২১৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১ কোটি ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ৪৭২ জন, রাজশাহী বিভাগে দুই কোটি সাত লাখ ৯৪ হাজার ১৯ জন, রংপুর বিভাগে এক কোটি ৮০ লাখ ২০ হাজার ৭১ জন এবং সিলেট বিভাগে এক কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার ১১৩ জন বসবাস করছেন। এছাড়া বস্তিতে বসবাস করে ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ৩০২ জন। ভসমান জনসংখ্যা ২২ হাজার ১৮৫ জন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনসংখ্যা ১৯৮১ সালে ছিল ৮ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৮জন। ৪১ বছর বছর পর অর্থাৎ ২০২২ সালে দ্বিগুণ হয়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৪৭৮ জন।
উল্লেখ্য, দেশে ষষ্ঠ জনশুমারি হয় গত বছর ১৫ জুন থেকে ২১ জুন। গত জুলাইয়ে বিবিএস প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছিল দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। চুড়ান্ত প্রতিবেদনে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরও প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ। প্রাথমিক হিসাবে বিভিন্ন কারণে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষ বাদ পড়েছিল। ২০১১ সালে মোট জনসংখ্যা ছিলো ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭২ হাজার ৬৯৭ জন। ২০০১ সালে ছিল ১৩ কোটি ৫ লাখ ২২ হাজার ৫৯৮ জন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রথম জনশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৯৮ হাজার। ১৯৮১ সালে ৮ কোটি ৯৯ লাখ ১২ হাজার, ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১৮৫ জন।
চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলন, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. কাউসার আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
২৯ নভেম্বর, ২০২৩