পরীক্ষার দাবিতে রাবিতে দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীদের অনশন
মাস্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষার দাবিতে অনশনে বসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দর্শন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা। বুধবার (২৯ মে) দুপুর ১২টার দিকে বিভাগের অফিস কক্ষের সামনে অবস্থান নেয় ৩৫ শিক্ষার্থী।  এ সময় তারা হাতে ‘পরীক্ষার সুযোগ চাই’, ‘জীবনের শেষ এম এ এটাই’, ‘year সিস্টেমের আমরাই শেষ বর্ষ’, ‘পরীক্ষা দিতে না দিলে পিকনিকে নিল কেন’- ইত্যাদি লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন। অনশনরত শিক্ষার্থীরা জানান, ইয়ার সিস্টেম হওয়ায় করোনার কারণে এমনিতেই অনেক জটে আমাদের ব্যাচ। আমাদের পরীক্ষা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে বিভাগ যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই থাকবে।  তা ছাড়া যাদের নন কলেজিয়েট করা হয়েছে তাদের মধ্যেও অনেকেরই উপস্থিতি কম ছিল। এর আগেও অন্যান্য ব্যাচে ডিস কলেজিয়েট হয়েও পরীক্ষা দিয়েছে বলেও জানান তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষার্থী বলেন, কয়েক দিন আগেও আমাদের বলা হয়েছে পরীক্ষা দিতে পারবো। এই আশ্বাস দিয়ে আমাদের ট্যুরেও নিয়ে গেছে। আমাদের এটেনডেন্স কম আছে, এটা জানানো হয়নি আগে। শিক্ষকদের মধ্যেও অনেকেই চান আমরা পরীক্ষা দেই। কিন্তু চেয়ারম্যানসহ আর কিছু শিক্ষক চাচ্ছেন না। অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, বিভাগ থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে যেতে বলা হয়েছে। আমরা ভিসি, প্রো ভিসি, ছাত্র উপদেষ্টা সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেন এটা বিভাগের বিষয় বিভাগ দেখবে। আমরা তাহলে এখন যাব কার কাছে। ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সউদ বলেন, গতকাল কয়েকজন আমার কাছে এসেছিল। আমি বিষয়টা উপ-উপাচার্য স্যারকে জানিয়েছি। তবে অনশনের বিষয়ে কিছু জানি না। এ বিষয়ে দর্শন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. নিলুফার আহমেদ বলেন, ওরা ক্লাস করেনি তাই ডিস কলেজিয়েট হয়েছে। এ বিষয়ে বিভাগ যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই থাকবে।
২৯ মে, ২০২৪

ঢাবির দর্শন বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দর্শন বিভাগের এক শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরীক্ষার হলে রোল নম্বর টুকে নেওয়ার মতো অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে ওই শিক্ষক অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, এর আগে পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দিতে হুমকি দেওয়া ও এক নারী শিক্ষার্থীকে হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।  অভিযোগকারী এ শিক্ষার্থী দর্শন বিভাগের ১৪তম ব্যাচের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. দিলওয়ার হোসেন। অন্যদিকে অভিযুক্ত শিক্ষক ওই বিভাগেরই লেকচারার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতা। বৃহস্পতিবার (২৩ মে) দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তফা আবুল উলায়ী বরাবর পরীক্ষার হলে শিক্ষকের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে একটি অভিযোগপত্র জমা দেন এ শিক্ষার্থী। অভিযোগপত্রে বলা হয়, তৃতীয় বর্ষের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ৩০৭ কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা কলাবভন ৫ম তলা কেন্দ্রে পরীক্ষা চলাকালীন জান্নাতুল ফেরদৌস মিতা ম্যাম আকস্মিকভাবে টেবিলের সামনে এসে আমার প্রবেশপত্র টেনে পরীক্ষার রোল কলম দিয়ে উনার হাতের তালুতে টুকে নিয়ে যান। একইভাবে, পূর্ববর্তী ষষ্ঠ ও সপ্তম সেমিস্টারের ৪০৪ কোর্সেও তিনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। ফলে, ওই দুটি সেমিস্টারেই ম্যামের কোর্সে অভূতপূর্ব সিজি ড্রপ হয়, যার কারণ হিসেবে প্রবেশপত্রে ম্যামের এ রকম অশোভন হস্তক্ষেপকে দায়ী করছি। তিনি বলেন, বিভাগের শিক্ষক কর্তৃক পরীক্ষার হলে এ রকম অবস্থার শিকার হওয়ায় প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি ম্যামের এরূপ আচরণের সম্ভাব্য প্রতিফলনের শঙ্কা এবং পরীক্ষায় অনিরাপত্তা নিয়ে অদ্যাবধি ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। দিলওয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ম্যাডামের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো যোগাযোগ নেই। আমার জানামতে তার সঙ্গে ওই রকম কোনো সমস্যাও হয়নি। তবে ওনার ক্লাস চলাকালে মাঝেমধ্যে আমি ওনাকে প্রশ্ন করি। সে জন্য উনার ক্ষোভ থাকতে পারে। বিগত ষষ্ঠ এবং সপ্তম সেমিস্টারের পরীক্ষা চলাকালেও উনি আমার প্রবেশপত্র থেকে রোল নম্বর নিয়েছেন এবং পরীক্ষার খাতায় নম্বর কমিয়ে দিয়েছেন। অভিযুক্ত শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসে মিতা কালবেলাকে বলেন, এই অভিযোগটা একেবারেই ভিত্তিহীন। আমার যদি তার রোল নম্বর টুকে নেওয়ারই দরকার হতো, এটা নেওয়ার অনেক পথ খোলা ছিল। হাজিরা শিট থেকেও আমি তার রোল নম্বর নিতে পারতাম, কেন তার সামনে থেকে  নেব? এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।  তিনি বলেন, যিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তার আগে থেকেই একটা আক্রোশ ছিল। গত মিডটার্ম পরীক্ষার পরে পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে, আপনি আমার ছাত্র হিসেবে আমাকে এভাবে হুমকি দিতে পারেন না এবং আপনি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বজায় রাখুন।  তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালে এই ছেলেটা এক মেয়েকে হয়রানি করেছিল, তখন মেয়েটা বিচার নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। ওই সময় আমি বিষয়টা আরেকজনের কাছে রেফার করে দিয়েছিলাম। সেই জায়গা থেকে তার একটা আক্রোশ ছিল। এ জন্য এসব অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে জানতে দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তফা আবুল উলায়ীকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
২৪ মে, ২০২৪

শিক্ষায়ও ছেলেখেলার হাইকোর্ট দর্শন
বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো মর্মে একটা প্রবাদ আছে। এর সাধারণ অর্থ হচ্ছে—বোকা বানানো বা ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা। এর পেছনে নানা গল্প। একটি হচ্ছে এমন—এক বাঙালি ছেলে ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে গিয়ে ওখানকার এক মেয়ের সঙ্গে বেশ সম্পর্ক পাতে। মেয়েটিকে পটাতে বাংলাদেশ হাইকোর্টের ছবি দেখিয়ে বলে এটা তার বিশাল বাড়ি। পটিয়ে-পাটিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করে দেশে নিয়ে আসে। একদিন হাইকোর্টের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটি হাইকোর্ট দেখে চেঁচামেচি শুরু করে ও সবাইকে এ ঘটনা জানিয়ে দেয়। আরেকটি ভার্সন এমন—কলকাতার হাইকোর্টটি ছিল পরাধীন ভারতের বাঙাল প্রদেশের হাইকোর্ট। তখন বাংলা বলতে বোঝাত আজকের উভয় বঙ্গকেই। পূর্ববাংলার লোকেরা মামলাবাজি বেশি করত। মামলা-মোকদ্দমার তারিখে তারিখে তাদের কলকাতায় যেতে হতো। এ ওসিলায় কলকাতার আর কিছু চিনুক না চিনুক, হাইকোর্টটি ভালোমতো চিনত তারা। সত্য-বানোয়াট বা কল্পকাহিনি যাই হোক, ঘটনে-অঘটনে ‘বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো’ প্রবাদ বাক্যের রূপ নিয়েছে পাকাপোক্তভাবে। রমজানে বা গরমে ক্লাস কতদিন চলবে, ছাত্ররাজনীতি চলবে কি না, এ ধরনের বিষয়েও শিক্ষার্থীদের হাইকোর্ট দেখতে হচ্ছে। হলে সিট ফেরত দেওয়া নিয়েও হাইকোর্টের নির্দেশনা। তা বহিষ্কারাদেশের বৈধতা, একাডেমিক পরীক্ষার ফল, শিক্ষা শেষে পরীক্ষা বা নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েও। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, পরিচালনা কমিটি নিয়ে তো আছেই। তা দুভাবেই হচ্ছে। হয় কোনো না কোনো পক্ষ ছুটে যাচ্ছে হাইকোর্টে, নইলে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়েও করছেন। আদালতের ভাষায় যাকে বলে সুয়োমুটো। ওই স্বপ্রণোদনা বা বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনার পেছনেও থাকছে কারও না কারও মেহনত। এসব কসরত-মেহনত বিফলে যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের হাইকোর্ট দেখিয়ে ছাড়া হচ্ছে। সদ্য বিদায়ী রমজানে হাইকোর্ট দেখতে হয়েছে খুদে বা শিশু শিক্ষার্থীদেরও। যে বয়সে ও সময়ে তাদের দেখানো যেত অন্য কিছু। কিন্তু দেখল হাইকোর্ট। গরমে তাদের আবারও হাইকোর্ট দর্শন। নতুনত্ব হলো, গরমের তীব্রতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষামন্ত্রী। শুধু চটেনইনি, হাইকোর্টের আদেশ আপিল বিভাগে নিয়ে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। এ বয়সেই কী জানল-বুঝল কোমলমতি শিক্ষার্থীরা? শুধু হাইকোর্ট নয়, জানল পরের ধাপ আপিল সম্পর্কেও। বোনাসের মতো এর বাইরে বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের বিরোধের এক ঝলক দেখল। সবকিছুতে হাইকোর্ট দেখানোর ভালোমন্দ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘটনাদৃষ্টে কথা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত মহল তখন জ্ঞানী কথা বেশি বলেন। সৌজন্যতার নমুনা দেখিয়ে বলেন, সবকিছুতে আদালতে ছুটে যাওয়া ঠিক নয়। আর প্রতিপক্ষ দেখান আইনের যুক্তি। প্রশ্ন ছোড়েন—আদালত কি দেশের বাইরের কেউ? কখনো কখনো হাইকোর্টকেও এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করতে শোনা যায়। বিব্রত হতেও দেখা যায়। কিছু নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, নিজেরা নিজেরা মিটমাট বা ঠিকঠাক করে নিতে। তা ক্রমেই শিক্ষা খাতেও বাড়বাড়ন্ত। বলার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষা বিষয়টি ভিন্ন ও স্পর্শকাতর। এ নিয়ে ছেলেখেলা মানায় না। কিন্তু মানিয়ে ছাড়ানোর এক প্রবণতা লক্ষণীয়। শিক্ষা শুধু কিছু বই-খাতা আর চুল-টেবিল নয়। এটি বিশালত্ব অনেক। মোটা দাগে শিক্ষার তিনটি পক্ষ—ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক। এর বাইরে একটা ব্যবস্থা বা কর্তৃপক্ষ। শিক্ষা কী—তার পুরোটা ছাত্রের বোঝার কথা নয়। অভিভাবকেরও নয় সেভাবে, কারণ শিক্ষা বুঝে কেউ সন্তান জন্ম দেন না। শিক্ষার একটা বড় অংশ বোঝেন শিক্ষকরা। কিন্তু তাদের কেউ হয়ে গেছেন চাকুরে। কেউ মত্ত সরাসরি রাজনীতিতে। শিক্ষা রেখে জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পরিবেশ, পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত তারা। নিজের ঘর শিক্ষার বিষয়ে তাদের ভাবার সময়ইবা কই? রাজনীতির মাঠের বড় দু’দলের ঘুঁটি হতে গিয়ে দুটি উচিত কথা বলার অবস্থান তারা বরবাদ করে দিয়েছেন। তা শিশুশ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষার স্তরে স্তরেও। এর মাঝ দিয়েই শিক্ষার মান পৃথিবীর মধ্যে তলানিতে পৌঁছে যায়। আর তখন সেখানকার আউটপুট নিয়ে জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, পরিবেশ, পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, যুদ্ধ কোনো আলাপই করা যায় না। দগদগে পুঁজ-রক্ত-বমি গায়ে-পায়ে মাড়িয়েও তারা তা দেখেন না। এসবের অনিবার্য পরিণতিতে শিক্ষা নিয়ে নানা উৎকট-বীভৎস কর্মকাণ্ড নাগরিক শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করতে তেমন বাকি নেই। এবারের গরমের ব্যাপকতা রেকর্ড ভাঙা। তাপমাত্রা কোথাও কোথাও ৪৩ ডিগ্রিতে উঠেছে। তাপপ্রবাহে পুড়ছে মাঠঘাট, পথপ্রান্তর। তার ওপর বিদ্যুতের লোডশেডিং। হিটস্ট্রোকে একাধিক শিক্ষকের মৃত্যু। বহু শিক্ষার্থী আক্রান্ত। রাজধানীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাকা বিল্ডিংয়ে হলেও মফস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার বেশিরভাগ বিল্ডিং সেমিপাকা ঘর। ওপরে টিনের প্রচণ্ড গরমে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অস্থির অবস্থা। এ তাপপ্রবাহের মধ্যেই খুলে দেওয়া হয় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা। এমন পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনা। এর জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে এক ধরনের মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। সবকিছুতেই কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর আদালতের নির্দেশনা নিয়ে আসতে হবে—এ প্রশ্নও করেন তিনি? জেদাজেদি বা ছেলেখেলার বিষয় নয় এটি। হাইকোর্ট আর মন্ত্রণালয়ও ঠুনকা বিষয় নয়। কোনোটাকেই অমান্য করার জো নেই। আবার মান্য করার বাস্তবতাও নেই। কী এক বিতিকিচ্ছিরি দশা। নানান ফের। একেক জায়গার একেক নির্দেশ। রোদ-গরমের তীব্রতায় বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে বিটুমিন গলতে থাকায় এখন বলা হচ্ছে, এগুলোতে ব্যবহার করা বিটুমিনে গোলমাল ছিল, যা তীব্র গরম সহ্য করার উপযোগী নয়। তার আগপর্যন্ত এগুলোর গুণমানের প্রশংসা ছিল। উন্নয়নের তাল-তবলা তো বাজছিলই। তাপপ্রবাহ এখন একটা ভেজাল লাগিয়ে দিয়েছে। গরমের এ ভয়াবহতা না নামলে তা কোনো ব্যাপারই ছিল না। বিটুমিনের গলদও থেকে যেত অজানা। গরমের তোড়ে কয়েকজন শিক্ষকের মৃত্যু, শিক্ষার্থীর কাহিল দশার পর সার্কাসের মতো ধরা পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ-খোলার মতো সিদ্ধান্তে অসারতা ও চিন্তার দৈন্য। পুরোটাই এ সেক্টরের মহোদয়দের মনমর্জি। কেন বন্ধ, কেন খোলা, কেনইবা খুলে আবার আংশিক বন্ধ-খোলার কানামাছি? এত প্যাঁচ-প্যাঁচাল কি জরুরি ছিল? তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বন্ধ করে দেওয়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার শিডিউল তারিখ ২৮ এপ্রিল রোববার। এর আগের দিন শনিবার দুই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোর পক্ষ থেকে পৃথকভাবে এ শিডিউলের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে, বন্ধ ঘোষণার সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অ্যাসেমব্লি বন্ধের ঘোষণা দেয়। কিছুক্ষণ পর আলাদা বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানায়, চলমান তাপপ্রবাহে শিশুশিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিবেচনায় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুকল্যাণ ট্রাস্টের বিদ্যালয় ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টারগুলো বন্ধ থাকবে। যথারীতি ২৮ এপ্রিল শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। পরিবর্তিত রোটায় সকাল থেকে শিক্ষার্থীদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কারও হাতে পানির বোতল, কারও হাতে তরল খাবার। সেগুলো সঙ্গে নিয়েই তীব্র গরমের মধ্যে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার তোড়জোড় ছিল সবার। কিন্তু এক দিন ক্লাসের পর রাতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সোমবার বন্ধ ঘোষণা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকা ছাড়া বাকি জেলাগুলো হলো চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও রাজশাহী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের বিশেষ অংশে বলা হয়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ (এসি) ব্যবস্থা আছে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখা যাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপর রাতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেই। যেহেতু প্রাথমিকের সব ক্লাস সকালে হবে, তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলাই থাকবে। নির্দেশনার এমন রকমফের এবং আদালতের বাইরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, মাউশিসহ কত কী? স্থানীয় প্রশাসন তো আছেই। এত ফেরের জেরে মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পাঁচ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশনাটি কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেনেছে, কোনো কোনোটি মানেনি। অনেক প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শোকজও করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার মাঝেই আসে হাইকোর্টের রুলিং। শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরা এখানে আস্ত বলির পাঁঠা। তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ নেই—দেশে কয়টা স্কুলের ক্লাসরুমে এসি দূরে থাক, বৈদ্যুতিক পাখাও আছে? কয়টিতে ভবনের ওপর রড-সুরকিতে ঢালাই করা ছাদ আছে? সরকারের কি জানার বাইরে, দেশে টিনের চালের তলে বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন পাঠশালায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে? সেই টিনের চাল উত্তপ্ত হলে ক্লাসঘরগুলো যে আস্ত একেকটা লোহা গলানো রি-রোলিং মিল হয়ে ওঠে। কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষক হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থার প্রশ্ন করা তো গর্হিত। লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
০৪ মে, ২০২৪

সিকান্দারায় সম্রাট আকবর : সমাধিসৌধে নির্বাক দর্শন
নয়াদিল্লিতে মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ দেখার পরে অভিভূত হয়ে যাই। সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম উদ্যান-সমাধিসৌধ । যার সমাধি দেখেই আমরা অবাক! জানি না তার সাম্রাজ্য, তার শাসন কেমন ছিল! সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিসৌধ পর্যটক কর্তৃক সর্বোচ্চ দর্শিত হয়, অবস্থান রাজধানী নয়াদিল্লি হওয়ার কারণে। অন্যান্য মোঘল সম্রাটদের সমাধিসৌধ দেখার প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। প্রসঙ্গত: নয়াদিল্লির কাছাকাছি আগ্রায় সম্রাট আকবর ও সম্রাট শাহজাহানের সমাধিসৌধ অবস্থিত।  পরিকল্পনা মাফিক, আমি ফতেহপুর সিক্রি ভ্রমণ করার পরে টুরিস্ট বাসে সরাসরি আগ্রায় চলে এলাম। সেখান থেকে অটোরিকশাতে সিকান্দ্রায় নামলাম। উইকিতে ভ্রমণ করে সিকান্দ্রাবাদ সম্পর্কে আগেই ধারণা নিয়েছিলাম। কোন বাঙালি, কোন ভারতীয় মোঘল সম্রাট আকবরের নাম শোনেননি? আমার হাতে সময় কম ছিল, সম্রাট আকবরের রাজধানী ফতেহপুর সিক্রিতে বেশ সময় দিয়েছিলাম। অনেক বার ঘুরে ঘুরে ফতেহপুর সিক্রি দেখেছি। তবুও কি দেখার শেষ হয়? ঢাকার প্রথম সুবাদার ইসলাম খানের সমাধি ফতেহপুর সিক্রিতে অবস্থিত। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর, যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে মহান শাসকদের অন্যতম হিসেবে মহামতি আকবর নামেও পরিচিত। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, যিনি ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত মোট ৪৯ বছর ভারতবর্ষ শাসন করেন। পিতা সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আকবর ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। বৈরাম খানের তত্ত্বাবধানে তিনি ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানে তার সাম্রাজ্য বিস্তার চালিয়ে যান। সম্রাট আকবরের অধীনে মোঘল ভারত একটা স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা পায়। তখন ভারতের সম্পদ তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৬০৫ সালের অক্টোবর মাসে সম্রাট আকবর উদরাময় রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আকবরের মৃত্যুর পর তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন ও সাম্রাজ্য বিস্তার অব্যাহত রাখেন। শাসনকালের শেষদিকে সম্রাট আকবর আগ্রার লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রি, লাহোরের লালকেল্লা, এলাহাবাদের লালকেল্লা, সিকান্দ্রাবাদের সমাধি ভবন নির্মাণ করেন। সম্রাট আকবর সম্পর্কে বলতে গেলে আরও সময় প্রয়োজন। যাই হোক, দ্রুত টিকেট কেটে সমাধিসৌধের মূল ফটকে চলে এলাম। মূল ফটক (দক্ষিণ দ্বার) দেখে নয়ন ভরে গেল। চার শত বছরের বেশি সময় আগে নির্মিত হলেও এখনো যেন পুরোনো হয়নি। প্রধান গেট মোঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত হয়েছে। দ্বিতল ফটকে রয়েছে তাজমহলের মতো দেখতে শ্বেত পাথরের তৈরি চারটি বড় বড় মিনার। মিনারের উপরটা অনেকটা ছাতার মত। বাকিটা লাল পাথরের তৈরি সুন্দর ভাবে কারুকাজ করা। সূক্ষ্ম কারুকাজ করার জন্য কালো জেড পাথর আর শ্বেত পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। এই প্রধান প্রবেশপথ তৈরি করা হয়েছে অনেকটা ফতেহপুর সিক্রির বুলন্দ দরওয়াজার অনুকরণে। ফটক সামনে বা পেছনে এক রকম করে নির্মাণ করা হয়েছে। যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, মনে হবে সামনে থেকে দেখছি। প্রধান ফটক বা মূল ফটকের পরে ছোট একটা ফটক রয়েছে। ছোট ফটক দিয়ে ঢুকতেই সুবিশাল কম্পাউন্ড চোখে পড়ল। সামনে পানির ফোয়ারা, তারপর সম্রাটের সমাধি। পানির ফোয়ারা পুরাতন মনে হল, দীর্ঘদিন সংস্কারও করা হয়নি। সমাধিস্থলের চারদিকে চারটি গেট আছে। গেটগুলো সব একই আদলে তৈরি। তবে ঢোকা যায় শুধু দক্ষিণের গেট দিয়েই। প্রধান প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা হেঁটে সমাধিস্থলে যেতে হয়। এই রাস্তার দুধারে আছে বিশাল সবুজ মাঠ। এই মাঠে অনেক পোষা হরিণ ও ময়ূর রয়েছে শুনেছি। তবে তা' আমার চোখে পড়েনি। সমাধিসৌধটি বেশ বড় ও চারতলা বিশিষ্ট। প্রধানত লাল বেলে পাথরের তৈরি এই সৌধটি ধাপে ধাপে, পিরামিডের মতো, চার তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনের দরজার আশেপাশের জায়গাগুলো শ্বেত পাথরের কারুকার্য করা। সম্রাট হুমায়ূনের সমাধিসৌধ আকারে অনেক বড় এবং বিস্তর এলাকাজুড়ে। সে তুলনায় সম্রাট আকবরের সমাধির আকারেও ছোট, জৌলুস কম। তাজমহলে সম্রাট শাহজাহানের সমাধিসৌধ বিশ্বজনীন। তাজমহল বিশ্বের কে চেনেন না? সম্রাট আকবরের সমাধিতে পর্যটকদের ওপরের তলাগুলোতে উঠার সুযোগ নেই। সমাধি দেখেই ফিরে আসতে হয়। সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধে ঢুকেই দেখা যাবে সুন্দর করে আঁকা বিভিন্ন জ্যামিতিক আকার, ফুল ও অন্যান্য প্যাটার্ন। কোনটা ঘন নীলের ওপর সোনালি রং আবার, কোনটা হালকা রঙের ওপর ঘন লাল দিয়ে ফোটানো সুন্দর নকশা। দেয়ালে ফাটল ধরার জন্যে নকশা খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে। ফাটল গুলো সিমেন্ট-বালি দিয়ে পূরণ করা হলেও নকশাগুলোর সংস্কার করা হয়নি। সমাধিসৌধে দীর্ঘদিন যত্নের অভাব স্পষ্ট ! মোঘল সম্রাট আকবরের সমাধিসৌধ মুঘল স্থাপত্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। সমাধিসৌধ নির্মাণ করতে ব্যয় হয় আনুমানিক ১৫ লক্ষ টাকা। ১১৯ একর জমির ওপর স্থাপিত সমাধিসৌধটির নির্মাণ কাজ ১৬০৫ সালে শুরু হয় এবং ১৬১৩ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সমাধিসৌধ নির্মাণ শুরুটা সম্রাট আকবর করলেও, সমাপ্ত করেন তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর।  সিকান্দ্রাবাদ সমাধিফলকে প্রচুর বানরের উপদ্রব রয়েছে। আমি ভিজিটিং আওয়ারের শেষ সময়ে যাবার কারণে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল না বললেই চলে। অল্প কিছু দর্শনার্থী আসছেন, কিছু সময় দেখার পরে চলে যাচ্ছেন। আমি পুরো কম্পাউন্ড হেঁটে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রধান ফটকের ডানদিকের ফটকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লক্ষ্য করলাম আমি একা! একটা বানর দেখছি, মনে করলাম এর সাথে গল্প করা যেতে পারে। হঠাৎ, দেখলাম পাশের ঝোপ থেকে বেশ কয়েকটি বানর আসছে! আমি দ্রুত স্থান ত্যাগ না করে পারিনি। এবার সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ'র মূল ভবনে এসেও লক্ষ্য করলাম যে, পাশে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বানররা মিটিং করছে।  তখন প্রায় সন্ধ্যা দর্শনার্থীদের আনাগোনা কমছে আর বানররা স্থান দখলের পরিকল্পনা করছে। আমার সময় শেষ হয়ে যাবার আগে বানরদের দৃশ্য ভিডিও করার চিন্তা করলাম। তবে যদি ভিডিওসহ মোবাইল নিয়ে যায়! তখন কি হবে? সিকান্দ্রাবাদ সমাধিফলকের জায়গাটি ছিল ঘন জঙ্গলে ভরা। সম্রাট জাহাঙ্গীর এখানে শিকারে আসতেন, বিশ্রাম নিতেন। সম্রাটের বিশ্রাম করার ঘর কাঁচমহল আজও দৃশ্যমান। কাঁচমহল একসময় হারেম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সময় স্বল্পতার কারণে কাঁচঘরে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।  বেসমেন্টে সম্রাট আকবরের কবর কম আলোর একটা ঘরের ভেতর অবস্থিত। সেখানে যাবার সুড়ঙ্গও অন্ধকার। কবরটি সাদা পাথর দিয়ে আবৃত। এ সমাধিসৌধে ৪০টি সমাধির জায়গা নির্ধারণ করা থাকলেও সমাধি রয়েছে চারজনার। সম্রাট আকবর, সম্রাট আকবরের বোন, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে ও মেয়ের। কথিত আছে, এখানে সম্রাট আকবরের সমাধি থাকলেও তার দেহাবশেষ নেই। ১৬৮৮ সালে জাট বিদ্রোহে অংশ নেয়া সেনারা সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ থেকে হাড়গোড় বের করে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে এবং সমাধিস্তম্ভ লুটপাট করে। সম্রাট আওরঙ্গজেব সমন জারি করেন। শাস্তিস্বরূপ, এককালের কাশ্মীরের শাসক রাজা রাম সিংহকে মথুরার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়। সমাধিতে সম্রাট আকবরের দেহাবশেষ থাকুক অথবা না থাকুক দর্শনার্থীরা বিশ্বাস করে, সমাধিতে সম্রাট শায়িত রয়েছেন। আকবর দ্যা গ্রেটের কবরস্থানে সম্রাট শাহজাহানের কবরস্থানের (তাজমহল) মতো ছবি তোলা নিষিদ্ধ। আমি দূর থেকে সেই সময় ছবি তুলেছিলাম। তবে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার পাশে অবস্থিত সম্রাট হুমায়নের সমাধিসৌধে ছবি তুলতে বাধা নেই। সিকান্দ্রাবাদ আগ্রায় অবস্থিত হলেও অধিকাংশ মানুষ তাজমহল দেখে সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ না দেখার মতো ভুল করেন। নয়াদিল্লি থেকে সিকান্দ্রাবাদে যেতে হলে আগ্রা যেতেই হবে। তাই, আগ্রার বাস থেকেই সিকান্দ্রায় যাওয়া যায়। আগ্রা শহর থেকে আধাঘণ্টায় যাওয়া যায় সিকান্দ্রাবাদের সমাধি ভবনে। নয়াদিল্লির নিজামুদ্দিন বাসস্ট্যান্ড থেকে এসি ও নন-এসি বাসে আগ্রা যাওয়া যায়। ভারতীয় ট্যুরিস্ট বা বাংলাদেশের ভ্রমণকারীদের জন্য টিকেট মূল্য ৩০ রুপি। সমাধিস্তম্ভে যাবার সময় গাইড তথ্য দিতে চাইতে পারে। কেউ চাইলে গাইড নিতে পারে, গাইড না নিলেও সমস্যা নেই। সমাধিসৌধ থেকে বের হতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ততক্ষণে ক্ষুধায় পেট অস্থির! পাশের হোটেলে বসে পেটপূজা করতেই মনে হল, সামনেই তো মরিয়ম-উজ-জামানের (যোধা বাঈ) সমাধি। কিন্তু, এতক্ষণে সামাধিসৌধ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্রাট আকবরের সমাধিস্তম্ভ দেখলাম, সম্রাজ্ঞীর সমাধিফলক অদেখাই রয়ে গেল। মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের নিকট পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত সুলতান ইব্রাহিম লোদির পিতা সুলতান সিকান্দার লোদীর নামেই সিকান্দ্রাবাদ নগরের নামকরণ করা হয়। ইতিহাস কেমন করে বারবার ফিরে আসে! ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী মোঘল সম্রাট আকবর সিকান্দ্রাবাদের মাটিতেই শেষ আশ্রয় খুঁজে নিলেন।  সম্রাটের আকবরের সমাধিতে গিয়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, এই পথে একসময় সম্রাট আকবর, সম্রাট জাহাঙ্গীর, সম্রাট শাহজাহানের পায়ের ধুলা পড়তো। নূরজাহান, আনারকলি, মমতাজ, যোধা বাঈ, জাহানারা, রওশন আরাসহ আরও মোঘল রমণীর চরিত্র মোঘল সম্রাটদের আশ্রয় করে জনশ্রুতি হয়েছে। কেমন ছিল সেই সময়? তাঁদের শাসনব্যবস্থা, তাঁদের রণকৌশল অবাক করার মতোই ছিল। তাদের শানশৌকত সাম্রাজ্য দেখে আকৃষ্ট হয়ে ভিনদেশি বণিকরা ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে এসে শাসনকর্তা হয়ে যান।  সম্রাট আকবর বা সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো দুর্দান্ত দাপুটে শাসক যদি জীবিত থাকতেন, তবে ব্রিটিশরা যে পথে এসেছে সেই পথেই ফিরে যেতে বাধ্য হতো। সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও মাঝে মাঝে মনে হয় মোঘল সম্রাট আকবর আমাদের মাঝে রয়েছেন।  ফাত্তাহ তানভীর রানা : ব্যাংকার ও গল্পকার 
৩০ এপ্রিল, ২০২৪

ড. মো. মোরশেদ হোসেনের নিবন্ধ / বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন, প্রয়োগ ও আজকের বাংলাদেশ
‘বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন’ হলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি (Economic and Social View)। যদিও বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ ভাবনা, রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়ন দর্শন আলাদা করে দেখা কষ্টকর, কারণ সবই হলো পরস্পর সম্পর্কিত এক সমগ্রক রূপ (Holistic Form)। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন গণমানুষের স্বার্থ- কল্যাণ- সমৃদ্ধির লক্ষ্যে তার আন্দোলন- সংগ্রামের ফসল। এর মূলনীতি-ভিত্তি হলো বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক আলোকিত মানুষের সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের অন্যতম সুষ্পষ্ট প্রতিফলন হয়েছে ১৯৭২- এর সংবিধান প্রস্তাবনায় যেখানে বলা হয়েছে ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা - যেখানে সকল নাগরিকের আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’  বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন একদিনে গড়ে ওঠেনি। সুদীর্ঘ লড়াই- সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন, যার ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছিল রাজনৈতিক দর্শন এবং তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন দর্শন। এ উন্নয়ন দর্শনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বের নানা ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব, রুশ বিপ্লব পরবর্তী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত  ইউনিয়নের দ্রুতগতিতে আর্থসামাজিক মৌলিক পরিবর্তন, ১৯২৯-৩৩ সালের মহামন্দা (Great Depression) যা পুঁজিবাদের প্রথম বৈশ্বিক পতনের লক্ষণ, দ্বিতীয় বিশ্বিযুদ্ধ ((১৯৩৯-১৯৪৫), দ্বিতীয় বিশ্বিযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ু যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে উপনিবেশসমূহে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের অভ্যুদয় এবং এ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণ, ১৯৪০-৫০ এর দশকে সমাজতান্ত্রিক চীনা বিপ্লব, চীনের অগ্রযাত্রা ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ১৯৬০ এ দশকে তৃতীয় বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন যেমন পানামা, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়ায় মার্কিন আগ্রাসন, কিউবার বিপ্লব ও বিপ্লবী চে গুয়েভারার হত্যা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারতা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষন- নির্যাতনসহ দুই অর্থনীতি (Two Economy) সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের উন্নয়নে চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি- সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের পটভূমি। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের মূল কথা হলো স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন। তাই ১৯৪৭ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে পটভূমি তাতে সর্বাধিক দক্ষতা ও সফলতার সাথে পদচারণা একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বীর সেনানী, বাষট্টির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথিকৃৎ, ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলনের ঋত্বিক, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেরণা-পুরুষ, সত্তুরের নির্বাচনের ঈর্ষণীয় বিজেতা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপকার, সর্বোপরি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি। স্বাধীনতা অর্জনের এই যে সংগ্রাম তা যেমন ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য, তেমনি তা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।  বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাচঁতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।... আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ বঙ্গবন্ধু উন্নয়ন দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পশ্চিম পাকিন্তান ও পূর্ব- পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরা। এ দু অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে গত ২২ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতের মোট ব্যয়ের মাত্র ১৫ শত কোটি টাকার মতো (মোট ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশ মাত্র) বাংলাদেশে খরচ করা হয়েছে। অথচ এর পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের সর্বমোট উন্নয়ন ব্যয় খাতে বাংলাদেশে মোট ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি।’ মূলত এই অর্থনৈতিক বৈষম্য বা দু অর্থনীতি তত্ত্ব ছয় দফার ভিত্তি। দুই অঞ্চলে স্ব-স্ব উদ্যেগে শিল্পায়ন, মুদ্রানীতি, বৈদেশিক মুদ্রানীতি, সুদের হার নীতিসহ এমন কিছু দাবি এই ছয় দফায় যুক্ত করেছিলেন তিনি, যা কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবির পর্যায়েই পড়ে।     বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ অবদান স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ‘সোনার বাংলা’, স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে ‘সোনার বাংলা’ ছিল একটি রূপকল্প। এটি কোন মিথ নয়। ‘রূপকল্প- ২০২১’ ও ‘রূপকল্প-২০৪১’ এর মতোই এটি রূপকল্প। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। বঙ্গবন্ধু একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসম্প্রাদায়িক ও বৈষম্যহীন সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বলেছিলেন, ‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামীদিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সংগে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেতখামার, কল-কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’ বলা যেতে পারে ৭০০ বা ৮০০ পৃষ্ঠার যে কোন রূপকল্পের চেয়ে ‘সোনার বাংলা’- এ শব্দ দুটি অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কাঙ্ক্ষিত, স্বপ্নীল ভবিষ্যতের প্রকাশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) স্পষ্টত : বলা হয়েছে, The father of the nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman soon after assuming the power initiated massive programmes for rebuilding the war-torn economy in a planned manner. Under his visionary and prudent leadership, the First Five Year Plan (1973-78) was formulated to guide the transformation of the country into ‘Sonar Bangla’, free of poverty, hunger and corruption along with rapid income growth and shared prosperity.    বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের আরেকটি মূল কথা হলো ‘দেশজ উন্নয়ন দর্শন (Home Grown Development Philosophy) অর্থাৎ দেশের সম্পদ, দেশের পুুঁজি, দেশের সামাজিক পুঁজি ব্যবহার করেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। এজন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার কথা বলেছেন। বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কন্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করবেন না, এটাই আমাদের কামনা’।  বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ এ, আর সংবিধান রচিত হলো ৪ নভেম্বর ১৯৭২ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হলো। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন প্রকাশ করে বাংলাদেশের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ। যেমন- (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগন; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে (সংবিধান, অনুচ্ছেদ ৭.১), (২) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১৫. ক), (৩) কর্মের অধিকার; যুক্তিঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫.খ), (৪) সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫.খ), (৫) সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা;... মানুষে সানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ (অনুচ্ছেদ ১৯/১,২) (৬) মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিককে- এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তিদান (অনুচ্ছেদ ১৪) (৭) জীবনযাত্রার বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার লক্ষ্যে কৃষি বিপ্লবসহ গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধন (অনুচ্ছেদ ১৬)। অর্থাৎ এসবের মূলকথা হলো বৈষম্যহীন এক অর্থনীতি- সমাজ- রাষ্ট্র গঠন।  বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের প্রকাশ রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) এর দলিলে। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র আড়াই মাসের মধ্যেই (৩০ মার্চ ১৯৭২) দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গঠিত হয় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, যার চেয়্যারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। কমিশন মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে রচনা করলেন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮), যার বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে। এ পরিকল্পনার মূল দিক নির্দেশনার বিষয় ছিল ভবিষ্যতের বাংলাদেশ- বৈষম্যহীন, জনকল্যানকর, সমৃদ্ধ, উন্নত, প্রগতিবাদী এক আলোকিত বাংলাদেশ। এতে উন্নয়ন দর্শন ছিল (১) পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হবে দারিদ্র হ্রাস (২) অর্থনীতির প্রতিটি খাতে বিশেষত কৃষি ও শিল্পের পুনঃগঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি (৩) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩ শতাংশ হতে কমপক্ষে ৫.৫ শতাংশে বৃদ্ধি করা (৪) নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের (বিশেষ করে খাদ্য, বস্ত্র, ভোজ্য তেল, কেরোসিন, চিনি) উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এসবের বাজার মূল্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা (৫) পুনঃবণ্টনমূলক আর্থিকনীতি কৌশলসহ বন্টন নীতিমালা এমন করা যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির হার দেশের সামগ্রিক গড় আয় বৃদ্ধির চেয়ে বেশী হয় (এবং উচ্চ আয়ের মানুষদের এক্ষেত্রে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে) (৬) বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা (৭) গ্রাম- শহরে স্ব-কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি করা (৮) কৃষির প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিশ্চিত করা; খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা। (৯) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীন গৃহায়ন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নখাতে উন্নয়ন বরাদ্দ হার বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের সাধারণ সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করা। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিলে এটি স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর  উন্নয়ন দর্শনে মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাস নিমিত্ত শক্ত- ভিত্তির জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সংসদে, সভা- সমিতিতে দেয়া বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলোরই প্রতিফলন এই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার দলিল।   বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে গ্রামীন উন্নয়ন ও কৃষির গুরুত্ব অনেক। সমাজতান্ত্রিক সমাজ- অর্থনীতি বির্নিমাণে গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লবের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে শিক্ষাকে কখনো ব্যয় হিসাবে গণ্য করেননি, গণ্য করেছেন উন্নয়নে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু এক বেতার ভাষনে বলেন ‘সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর হতে পারে না। ... জাতীয় উৎপাদনের শতকরা কমপক্ষে ৪ ভাগ সম্পদ শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে।’  বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ জাতীয়করণ নীতি ঘোষণা করেন। ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলোর জাতীয়করন বিষয়ে স্বাধীনতার পূর্ব হতে (২৮ অক্টোবর ১৯৭০) বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল, ‘জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলো ও অর্থনীতির অন্যান্য মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগনের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। অর্থনীতির এসবক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সাধিত হতে হবে সরকারি অর্থাৎ জনগণের মালিকানায়। নতুন ব্যবস্থায় শ্রমিকগণ শিল্প ব্যবস্থাপনায় ও মূলধন পর্যায়ে অংশীদার হবেন’। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন গ্রামীণ সমাজে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রতিটি গ্রামে গণমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হবে। তার মতে, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণমুখী সমবায় আন্দোলনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা সমবায়ের পথ- সমাজতন্ত্রের পথ, গণতন্ত্রের পথ। সমবায়ের মাধ্যমে গরীব কৃষকরা যৌথভাবে উৎপাদন-যন্ত্রের মালিকানা লাভ করবে। ... কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল -ভোগের ন্যায্য অধিকার (১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় আয়োজিত সমবায় সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা)। সম্পদের সুষ্ঠু ও সমবন্টনের দিকে বঙ্গবন্ধুর নজর সবসময়ই ছিল।  এ প্রসংগে ২৬ মার্চ ১৯৭২ সালে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি বলেন, সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রতিতে আমরা অটল, আমাদের সমস্ত নীতি, আমাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুর্গম পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে জনগণ সম্পৃক্ততা কথা বার বার উঠে এসেছে। তিনি বলেন, আজ যদি পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন স্ট্রং না হয় ভিলেজ লেভেল থেকে আরম্ভ করে শেষ পর্যন্ত যাকে ওয়াচডগ বলা হয়, তা যদি না থাকে তাহলে দেশের মঙ্গল করা যায় না শুধু সরকারি কর্মচারীর ওপর নির্ভর করে। দেয়ার মাস্ট বি এ ব্যালেন্স। দেয়ার মাস্ট বি পিপলস মবিলইজেশন। আমাদের হোল কান্ট্রিকে মবিলাইজ করতে হবে ফর ডেফিনিট পারপাস।  বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্যে সামাজিক পুঁজির ব্যবহারের প্রসংগ এসেছে, শুধু সরকারি অর্থে জনগণের মঙ্গল হয় না, উন্নতির কাজ হয় না। জনগণকে একতাবদ্ধ করতে হবে। আপনাদেরকে জনগনকে মবিলাইজ করতে হবে। সেজন্য জনগনের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে হবে।এই অনুপ্রেরণা সৃষ্টির দায়িত্ব থাকবে পার্টির এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের, গভর্নরের, জয়েন্টলি। বঙ্গবন্ধু মাটি- ঘনিষ্ঠ অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন। এক বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, আমার মাটির সাথে, আমার মানুষের সাথে, আমার কালচারের সাথে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে আমার ইতিহাসের সাথে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।   বঙ্গবন্ধু ‘স্বনির্ভর অর্থনীতির’ কথা বলতেন। জাতি হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে হয়ে পায়ের ওপর দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। এজন্য কঠোর পরিশ্রম করে  উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলেছেন, দ্বিগুন উৎপাদনের কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে’ বিশ্বাস করতেন। এদেশের কৃষক- শ্রমিক- মজুর অর্থাৎ পশ্চাৎপদ মানুষের জন্য ছিল তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। তার প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে গরীব- দুঃখী মানুষের কথা, কৃষক- শ্রমিকের কথা, নির্যাতিত মানুষের কথা উঠে এসেছে। এক বক্তব্যে তিনি বলেন,“আমাদের চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যেগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।  এ প্রসংগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল জুলুম শোষনমুক্ত সমাজ, কৃষি এবং সমবায় ভিত্তিক উন্নয়ন। তিনি সমাজের অবহেলিত ও বঞ্চিত শ্রেণির কথা ভাবতেন। ড. আতিউর রহমানের ভাষায়, এদেশের কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। তাই তারা ভাবেন, এদেশটি আরো কত আগেই না অর্ন্তভুক্তি উন্নয়নের স্বাদ পেত, যদি না বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ এমন করে চলে যেতে না হতো। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে পররাষ্ট্রনীতিতে উন্নয়ন অর্থনীতির কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯ তম অধিবেশনে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব - এই নীতিমালার ওপর জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহন করিয়াছে। কেবল শান্তিপূর্ণ পরিবেশই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে আমাদের সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদ সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত আলজিয়ার্সেও জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।  বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের অর্থাৎ বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামকে প্রাধান্য দিয়ে সমবায় কৃষির মাধ্যমে গ্রাম ও কৃষককে  এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। দেশে ৬০টি জেলা তৈরি করে, প্রতি জেলায় একজন গভর্নর নিয়োগ করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্য ছিল তার। দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার।   বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন প্রয়োগ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন- Bangladesh is a bottomless basket এবং অর্থনীতিবিদ ফাল্যান্ড ও জে আর পারকিনস তাদের বই Bangladesh : The Test Case of Developmen এ বাংলাদেশের  টিকে থাকা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলেছেন। অনেক অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা অসম্ভব, বাংলাদেশ সচল করতে কমপক্ষে দশ বছর সময় লাগবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই তার উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়ন শুরু করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বছরেই (১৯৭২ সালে) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।  মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার- পরিজনসহ জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ১ কোটি শরণার্থীসহ দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু, লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত,শহরচ্যুত পরিবারের পুনর্বাসন, দেশের অভ্যন্তরে ৪৩ লক্ষ বিধ্বস্ত বাসগৃহ পুননির্মাণসহ এসব পরিবারে খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবাহের কাজটি ছিল বড় মাপের চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু প্রথমেই যে কাজটিতে হাত দিলেন তাহলো যুদ্ধবিদ্ধস্ত মানুষের পুর্নবাসন। যুদ্ধবিধ্বস্ত কৃষিখাতকে পুনরুজ্জীবিত করতে বঙ্গবন্ধু যেসব বাস্তবভিত্তিক সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন তার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষকদের জরুরী ভিত্তিতে কৃষি ঋন প্রদান ও বীজ সরবরাহ করা, গভীর ও অগভীর নলকুপ মেরামত ও পুনঃখনন করা। হালচাষের জন্য কয়েক লাখ গরু আমদানি করে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা, খাস জমি ভূমিহীন- প্রান্তিক কৃষকসহ বাস্তুহারাদের মধ্যে বণ্টন। কৃষিতে শ্রেণি-বৈষম্য হ্রাসে কৃষকদের মুক্তিসহ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিকদের জমি খাস হিসাবে ঘোষণা। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের দালালেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধন করেছে অবকাঠামোগত ভৌত সম্পদের যার মধ্যে অন্যতম রাস্তা-ঘাট,ব্রিজ, কালভার্ট, বিদ্যুৎ (উৎপাদন- সঞ্চালন-বিতরন), টেলিযোগাযোগ। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা গঠনের পর কোন বিলম্ব না করে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সংস্কার- নির্মাণ-পুনর্নিমাণে হাত দেন।  মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যপক ক্ষয়-ক্ষতিসহ শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে ও মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নাম মাত্র মূল্যে পাঠ্যপু¯তক সরবরাহ, ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ, বাজেটে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ, ড. কুদরত- ই- খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন, ৩৬ হাজার ১৬৫ টি বেসরকারি স্কুল সরকারীকরণ- জাতীয়করণ এবং ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক স্কুল স্থাপন, ১ লক্ষ ৫৭ হাজার ৭৪২ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ এবং মুক্তিবুদ্ধি ও চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন (১৯৭৩) প্রদান করেন। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক- বিমার ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও সেসব চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সেও প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বন্ধ শিল্পকারখানা চালুসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তবে শুরুতে রাষ্ট্রীয়খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে তিনি ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। এসময়ে ১৩৩ টি পরিত্যক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তি মালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের কাছে বিক্রি করা হয়। এভাবে শিল্পায়নকে ডিরেগুলেট করার প্রক্রিয়া শুরু হয়, ফলে পরবর্তীতে ব্যক্তিখাত শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তিতে আবির্ভূত হয়। ড. আবুল বারকাত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু বেচেঁ থাকলে এবং একই সাথে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতির প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডে বাংলাদেশ কল্পনাতীত মাত্রায় এগিয়ে যেত। ২০০০ সাল নাগাদ মালয়েশিয়াকে পেছনে ফেলে দিত বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সমাজে, সমাজ কাঠামোতে, শ্রেণি কাঠামোতে সম্ভাব্য কি ধরনের পরিবর্তন হতে পারতো। যা হয় নি। যাকে আমি বলছি কল্পনাতীত হারানো সম্ভাবনা’ বা Unimaginable Lost Possibilities. বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ও আজকের বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৪৬ বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ডকুমেন্টে এ  প্রসংগে বলেছেন, This flagship document contains the philosophy of realizing the ‘Golden Bengal’as dreamed of by the Father of the Nation. বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ -এ ২০৪১ সালে উন্নত দেশ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্জনের কথা বলা হয়েছে।  রূপকল্প ২০৪১ এ বলা হয়েছে  বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের আলোকে স্বপ্নের উন্নয়ন পথে জাতিকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই সরকার রূপকল্প ২০৪১ গ্রহণ করেছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০৪১ এর ভিত্তিমূলে রয়েছে দুটি প্রধান অভীষ্ট : (ক) ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২,৫০০ মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং যা হবে ডিজিটাল বিশ্বের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ, (খ) বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্য হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। দারিদ্র্য নির্মূল করার পাশাপাশি পরিবেশের সুরক্ষা, উদ্ভাবনী জ্ঞান, অর্থনীতির বিকাশ ও উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করে এমন একটি দ্রুতগতির অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই রূপান্তর সাধন সম্ভব। মাত্র সাড়ে তিন বছর, বিশাল কাজে খুবই কম সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতির পিতার দেখানো পথে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে আজ বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, তথ্য-প্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যে অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন মানুষের, তা বাস্তবায়নে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। হংকং সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন (এইচএসবিসি)- এর  সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চ- The World in 2030 : Our Long Term Projection for 75 Countries  এ বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সমুদ্র হতে মহাকাশ সর্বত্র অর্জিত হয়েছে বিজয়। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)- বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে পূর্ণ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে। সিডিপির তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। মাথাপিছু আয়ের টার্গেট ছিল ১২৩০ মার্কিন ডলার আর বাংলাদেশের অর্জন ২০২০ সলে ১৮২৭ মার্কিন ডলার (বর্তমানে ২০৬৪ মার্কিন ডলার), মানব সম্পদ সূচক টার্গেট ছিল ৬৬ পয়েন্ট আর বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫.৩ পয়েন্ট এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক ধরা হয়েছিল ৩২ পয়েন্ট এর নিচে আর এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫.২ পয়েন্ট। স্বাধীনতার ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা স্বাধীনতার অন্যতম চালিকাশক্তি। গ্রামকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কেন্দ্রীয় দর্শন হিসাবেই বিবেচনা করতেন। এসকল ভাবনাকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দেশের প্রতিটি গ্রামে নাগরিক সুবিধা সম্প্রসারণ এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে আমার গ্রাম- আমার শহর নির্বাচনী অঙ্গীকার যুক্ত করে।   জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ দারিদ্র্যবিমোচনের কৌশল হিসাবে তৎকালীন ১৯ টি থানায় পল্লী সমাজসেবা কার্যক্রম শুরু করেন। এ কার্যক্রমের সফলতার কারণে বর্তমানে দেশের সকল জেলার প্রত্যক উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দেশের অতি দরিদ্র মানুষের ৪০ শতাংশেরও অধিক বর্তমানে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে সরকার গৃহহীনদের আধাপাকা ঘর নির্মাণের একটি বড় কর্মসুচি সম্পন্ন করেছে। এতে সারো দেশের ৮ লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি ঘরহীন পরিবারকে নতুন ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ চলছে। সেসাথে যুক্ত হয়েছে বৃত্তি, উপবৃত্তি ও পোষাক ক্রয়ের অর্থ প্রদান।  বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন দেশজ উন্নয়ন দর্শন (Home Grown Development Philosophy) অর্থাৎ দেশের সম্পদ, দেশের পুুঁজি, দেশের সামাজিক পুঁজি ব্যবহার করেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু দেশজ উন্নয়ন দর্শনের এক বাস্তব রূপ। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ২০১৯-২০ সালে জিডিপি ৩৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রপ্তানি আয় ৪০.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৪৪.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রেমিটেন্স ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াট (৯৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে), গড় আয়ু ৭২.৬ বছর হয়েছে।  দারিদ্র্যের হার কমে বর্তমানে ২০.৫ শতাংশ এবং হত- দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশ হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। তথ্য-প্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে লাখ লাখ মানুষের। বর্তমান সরকার নানা ধরণের অবকাঠামো নির্মাণ করেছে ও নানা সুবিধা দিয়েছে মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট, পদ্মা বহুমুখী সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব টানেল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দর, সাবমেরিন কেবল সংযোগ, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো চার লেন, ছয় লেনে উন্নীত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ করা, ফোর জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালু করা, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু ও সম্প্রসারণ করা এর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে পাঠিয়েছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট। নিজস্ব স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি দিয়েই চলছে দেশের সম্প্রচার কার্যক্রম। প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)  সংক্রমণের শুরুতে দেশ বিদেশের গণমাধ্যমসহ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ছিল, করোনায় বাংলাদেশে কয়েক কোটি মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। মৃত্যু হতে পারে কয়েক লাখ মানুষের। সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে অর্থনীতি। কিন্তু এক বছরের মাথায় এসে সেই শঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বৈশ্বিক করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি মিলেছে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের। বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ, করোনার টিকাদান কর্মসূচি চালু, আর্থিক প্রণোদনা ও অর্থনীতিতে সাফল্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং কুটনীতিকরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।  বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (WEF) – এর  Inclusive Development Index (IDI) -2018 অনুযায়ী র‌্যাংকিংয়ে দেখা যায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে দক্ষিন এশিয়ার বড় দেশ ভারতের চেয়ে ২৮ ধাপ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ১৩ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির তিনটি মানদন্ড - প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন, অর্ন্তভুক্তিকরণ এবং আন্তঃপ্রজন্ম সমতা, প্রাকৃতিক ও আর্থিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার ভিত্তি-এর সূচক হিসাবে ধরা হয়েছে।  বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা উন্নয়ন দর্শনকে সামনে রেখেই  ২০৩০ সালে- এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৪১ সালে- উন্নত দেশ  সোনার বাংলা, ২০৭১ সালে স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তিতে- সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে এবং ২১০০ সালে -ডেল্টা প্ল্যান অর্জনের  স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনে আমরা যেন নিরন্তর অঙ্গীকারবদ্ধ থাকি- এই হোক আজকের প্রত্যাশা।  ড. মো. মোরশেদ হোসেন: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়
১৭ মার্চ, ২০২৪

সাহিত্য ও দর্শন
আমরা সাহিত্যকে কীভাবে দেখব, এ প্রশ্নটা থাকা স্বাভাবিক। সাহিত্য বিষয়টা তো আমরা সবাই জানি। আমরা সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত। প্রথমত সবচেয়ে সুন্দর ভাষায় সুন্দর কথাটি উপস্থাপন হলো সাহিত্যের একটি ধারণা। তবে এটা তো সত্য যে, সাহিত্য কেবল শব্দ নয়, সাহিত্য কেবল অলংকার নয়। তবে সাহিত্যের ভেতরে আরও গভীর যে বিষয় আছে সেগুলোর জন্য অলংকারগুলো, এই ওপরের আচ্ছাদনগুলোও জরুরি। সাহিত্যের ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, এর বক্তব্য এবং উপস্থাপনের মধ্যে যে সম্পর্কটা রয়েছে সেটি অবিচ্ছেদ্য। আবার এ দুয়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কও থাকতে হবে। যেমন বক্তব্য উপস্থাপনাকে প্রভাবিত করে উপস্থাপনাও তেমনি বক্তব্যের ওপরে একটি নিয়ন্ত্রণ রাখে। তো সাহিত্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এ দুয়ের মধ্যে থাকে। সাহিত্য নিয়ে এ কথা আমরা বলতেই পারি যে, সেই সাহিত্যই ভালো সাহিত্য যেটি আমরা বারবার পড়ি এবং বারবারই যখন পড়ি তখন প্রত্যেকবারই একে নতুন মনে হয়। তো এই যে নতুন মনে হচ্ছে পুরাতন জিনিসকে, পুরাতন বইটিকে, পুরাতন রচনাটাকে এর কারণ কী? এর কারণ হচ্ছে এই যে, উন্নত সাহিত্যের ভেতরের যে অর্থ তা সম্পূর্ণভাবে কখনো পরিষ্কার হয় না। কিছুটা রহস্য থেকে যায় এবং ভেতরের বক্তব্য এত গভীর যে, এর রহস্য কখনোই পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না। এ রহস্যময়তাটাই সাহিত্যে একটি বৈশিষ্ট্য যার কারণে কোনো রচনাকে প্রতিবারই নতুন মনে হয়। অবস্থার এবং দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে বারবার এ নতুনত্ব তৈরি হয়। সেজন্য বলা হয় কিছু কিছু কবিতা কিংবা কবিদের ক্ষেত্রে আমরা বলি, যেহেতু কবিতাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য মনে করা হয়, কোনো কবিই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেননি যিনি মহৎ কবিতা লিখেছেন অথচ মহৎ দার্শনিক নন। তাহলে কাব্যের সঙ্গে, সাহিত্যের সঙ্গে দার্শনিকতার যে সম্পর্ক, এ সম্পর্কটি একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক এবং এটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সাহিত্যের একটি নান্দনিক বিচার আছে তার অলংকার তার উপমা তার ভাষা এগুলোর দিকে আমরা তাকালে দেখি যে, এর মধ্যে একটি নান্দনিক ব্যাপার আছে, একটি দার্শনিক ব্যাপার আছে। এই যে নান্দনিকতা ও দার্শনিকতা; এ দুটোর মধ্যে বিরোধ নেই কিন্তু একটা দ্বন্দ্ব আছে। আমাদের দেখতে হবে দ্বান্দ্বিকতা ও নান্দনিকতা সাহিত্যের ভেতরে বস্তু দার্শনিকতাকে প্রভাবিত করে কি না। দার্শনিকতাও নান্দনিকতাকে প্রভাবিত করে। সে কারণে কোনো সাহিত্য আমরা দর্শন বাদ দিয়ে ভাবতে পারি না এবং যখন সাহিত্যের কথা আসে তখন এ দুটি একসঙ্গে আসে। এবার যদি নির্ভেজাল দর্শনের কথা বলি তাহলে বলতে হবে সেখানে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা হয়। কিন্তু সাহিত্যে বুদ্ধিবৃত্তি এবং হৃদয়ের বিষয় দুটোই আসে এবং দুটোই সক্রিয় থাকে। কাজেই এখানে সংবেদনশীলতা আছে, এখানে হৃদয়ের পরিচর্যা আছে, প্রগতি আছে, আবার এখানে বুদ্ধি আছে যেটাকে দার্শনিকতা বলে। তো এই বুদ্ধি ছাড়া কখনোই ভালো উন্নত সাহিত্য হয় না। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে আবার দ্বন্দ্ব আছে, হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধির একটি দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এ দ্বন্দ্বে একজন যে আরেকজনকে পরাভূত করে শেষ করে দেবে তা নয়, এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটি রচনা পোক্ত হয়ে ওঠে। সেজন্য বলা হয় যে, শব্দের আড়ম্বর এবং কবিতা এক জিনিস নয়। আবার আড়ম্বর দিয়েও কবিতা হয় না, বিষয়বস্তুর দরকার হয় এবং সেজন্যই আমরা ওই দার্শনিকতার কথা বলি এবং একটা কথা বলা হয় যে, আনন্দের সাহিত্য চাই। কিন্তু আনন্দের জন্য সাহিত্য হবে সেটা অবশ্যই, সাহিত্যের প্রধান কাজ হচ্ছে আনন্দ দেওয়া, কিন্তু এ আনন্দটা আবার একটি বিশেষ ধরনের আনন্দ। মিষ্টি খাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ সাহিত্য পড়ার মধ্যে যে আনন্দ তার মধ্যে তফাত আছে। দুটি দুরকম, যে কারণে সাহিত্যের আনন্দ হলো বিশেষ ধরনের আনন্দ। হৃদয়ের আনন্দ এবং বুদ্ধির আনন্দ এ দুটি মিলে যে আনন্দ তৈরি হয়, সেটিই এ আনন্দ। এবার দৃষ্টান্তে যাওয়া যাক, ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি। এই যে গীতাঞ্জলি নোবেল পুরস্কার পেল এর একটা কারণ হচ্ছে এর সৌন্দর্য। যখন ১৯১৩ সালে পৃথবী একটা বিশ্বযুদ্ধের দিকে যাচ্ছিল প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদী বিশ্বে। তখন এ যান্ত্রিকতা এই পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে মানুষ একটি নতুন সুর ও নতুন স্বর চাচ্ছিল এবং রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি সেটি সরবরাহ করেছে। তখন মানুষ এতে নতুন কিছু পেল যেটি ইউরোপের সাহিত্যে নেই। ইউরোপের সাহিত্যে যে বাস্তববাদিতা আছে, যে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা আছে, যে আধুনিকতা আছে তথাকথিত তার বাইরেও তাদের অপূর্ণতা ছিল, যেটি তারা গীতাঞ্জলিতে পেল। তবে গীতাঞ্জলির মূল ভাষা মূল শৈলী তো তারা জানত না। এটা রবীন্দ্রনাথ নিজেই অনুবাদ করেছেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। তিনি জানতেন যে এই অনুবাদ অন্য কেউ করলে তার মতো করে করতে পারবে না, অন্য কেউ করলে এরকম আবেদন সৃষ্টি হবে না। কাজেই রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির যে অনুবাদ করেছিলেন সেটি নতুন সৃষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই গীতাঞ্জলির অনুবাদে ভাষার যে নান্দনিকতা বিদেশিদের আকর্ষণ করেছিল, সেটার থেকে এর ভেতরের যে ভাবসমৃদ্ধ বক্তব্য সেই বক্তব্যটি তাদের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের পেছনে আমরা জানি যে, উপনিষদ আছে। এই যে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ এই যে সংগ্রহ করেছেন এবং মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্কের যে চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন, সেটির মধ্যে আধ্যাত্মিকতা আছে এবং সেই আধ্যাত্মিকতা এসেছে উপনিষদ থেকে। রবীন্দ্রনাথের এ লেখার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ভাববাদী এটা আমরা বলি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ রকমের বাস্তববাদী ছিলেন, যা তার ভাবধারার সঙ্গে মিলেছে। রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রেম রোমান্টিকতা কিংবা আধ্যাত্মিকতা নিয়েই ভাবেননি, তিনি ভেবেছেন রাষ্ট্র নিয়ে, তিনি ভেবেছেন কৃষি নিয়ে, তিনি শিক্ষা সম্পর্কে ভেবেছেন, বিজ্ঞানে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল, বিশ্ব পরিচয় নামে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। কাজেই এ যে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা এটি রবীন্দ্রনাথের ছিল। কেবল তিনি সুরের জন্য, গানের জন্য বিখ্যাত তা-ই নয়, গীতাঞ্জলি শুধু গানেরই সংকলন তা নয়, এর বক্তব্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেটি একসঙ্গে বাস্তববাদী, বৈজ্ঞানিক এবং তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে, সভ্যতার সংকটগুলো উঠে এসেছে এ বক্তব্যে। রবীন্দ্রনাথের শেষ প্রবন্ধ, মৃত্যুর কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ যে ‘সভ্যতার সংকট’ নামে প্রবন্ধ লিখেছেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে, এত দিনের বিশ্বাস সমস্ত তার ভেঙে গেল। পাশ্চাত্য সভ্যতার ওপরে যে আস্থা তিনি রেখেছিলেন সেই আস্থা ভেঙে গেল। আজকে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন এবং তিনি আশা করছেন পূর্বদিগন্ত থেকে একজন মানুষ আসবেন, তিনি এ সভ্যতাকে নতুন পথ দেখাবেন। তবে সে সময়ে নিশ্চয়ই তিনি মাও সে তুংয়ের কথা ভাবছিলেন না। নিশ্চয়ই তিনি একজন মহাপুরুষ আসবেন সে কথা ভাবছিলেন, কে আসবেন সেটা তিনি জানতেন না। কিন্তু আরেক দিক থেকে সভ্যতার সংকট, রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বুঝেছেন অন্য কোনো কবি অন্য কোনো লেখক তার সময়ে বাংলা ভাষায় বোঝেননি। এখানেই রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব। আবার আমরা দেখব রবীন্দ্রনাথের যে ‘গোরা’ উপন্যাসটি আছে। সেটি একটি মহাকাব্যের মতো উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের বাস্তববুদ্ধি আবার দেখা যাবে তার গীতি কবিতায়। মহাকাব্য লেখেননি কবিতাতে। মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে গেছে এটা তিনি বুঝেছেন। এখন যুগ এসেছে গদ্যের। মহাকাব্যকে যদি লিখতে হয় উপন্যাসে লিখতে হবে এবং এই ‘গোরা’ উপন্যাস সম্পর্কে আমরা নিশ্চয়ই জানি যে ‘গোরা’ উপন্যাসটি একটি মহাকাব্যের মতো এবং ‘গোরা’ কী করছে, সে একটা দার্শনিকতা দিয়ে অন্বেষণ করছে এই ভারতবর্ষকে। তো আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, এই যে দার্শনিকতা এটির দিকে যদি আমরা না খেয়াল করি তাহলে আমরা সাহিত্যকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারব না। আর দার্শনিকতা ছাড়াও কখনো কোনো মহৎ সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়। সে কারণে সাহিত্য দর্শনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই মহৎ সাহিত্য রচনা এবং উপলব্ধির জন্য দর্শনের প্রয়োজন আছেই।
১৫ মার্চ, ২০২৪

‘শেখ হাসিনার দর্শন : ভিশন ও নেতৃত্ব, উন্নয়নের চাবিকাঠি’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সেই দর্শন, লক্ষ্য উঠে এসেছে ‘শেখ হাসিনার দর্শন ভিশন ও নেতৃত্ব, উন্নয়নের চাবিকাঠি’ বইয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের লেখা বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনরা এ মন্তব্য করেন।  বাংলা অ্যাকাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে রোববার অনুষ্ঠিত হয় এ প্রকাশনা উৎসব। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল বুকস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন। মানুষের ভাত-কাপড়, চিকিৎসার সঙ্গে ভোটের অধিকার প্রয়োজন সেই দর্শন তিনি তৈরি করেছিলেন। তার দর্শনে ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুটি দিক। তিনি আরও বলেন, বাবার দেখানো পথে হেঁটেই যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লেখক এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, শুধু দর্শন থাকলেই হয় না, দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য। এর দুটোই আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রী কোনোকিছু হাতে নিলে শক্ত হাতে নেন উল্লেখ করেন তিনি। জঙ্গিবাদ দমনে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্সের উদাহরণ দেন তিনি। সেইসঙ্গে ১৫ বছর স্থিতিশীলভাবে ক্ষমতায় থাকায় প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন কাজকে অভাবনীয় পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।   সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এর  সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী। স্বাগত বক্তব্য দেন বেঙ্গল বুকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান। এ ছাড়া বেঙ্গল বুকস নিয়ে বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্পপ্রধান আজহার ফরহাদ।  সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দর্শন নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে বঙ্গবন্ধুর কথা। বইটি সময়ের ফুট প্রিন্ট উল্লেখ করে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার বিভিন্ন উদাহরণ দেন।  ‘শেখ হাসিনার দর্শন : ভিশন ও নেতৃত্ব, উন্নয়নের চাবিকাঠি’ শীর্ষক এই বইটিতে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের লেখা ২১টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। লেখক শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের নানা বিষয়ও উঠে এসেছে। লেখকের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানা স্মৃতির কথাও বলা হয়েছে বইটিতে।
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

জবিতে বিশ্ব দর্শন দিবস পালন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) দর্শন বিভাগের উদ্যোগে বিশ্ব দর্শন দিবস পালন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) বিশ্ব দর্শন দিবস উপলক্ষে র‌্যালি বের করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে র‌্যালিটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে। এতে দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামসহ বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। র‌্যালি শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম। আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান এবং আলোচক ছিলেন বিভাগীয় অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান। এ ছাড়া স্বাগত বক্তব্য দেন অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়াদ্দার। এ ছাড়া এ দিন দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ ও বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।
১৬ নভেম্বর, ২০২৩

বিশ্ব দর্শন দিবস / সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় দর্শন
চিন্তাশীল জীব হিসেবে বিভিন্ন সময় মানুষের মনে নানা প্রশ্নের উদ্ভব হয়। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানুষ কখনো ধর্ম, কখনোবা বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাদের একদেশদর্শিতার জন্য কখনো মানুষের মনের সব জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি করতে পারেনি। দর্শন জগৎ-জীবন, পার্থিব-অপার্থিব, লৌকিক-অলৌকিক এরকম যে কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে এবং তা নিয়ে আলোচনা করে। অমীমাংসিত এমন বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে দর্শন চেষ্টা করে। সবসময় প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে না পারলেও দর্শন মানুষকে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। বার্ট্রান্ড রাসেল এজন্যই দর্শনকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী প্রদেশ (No Man’s land) বলে অভিহিত করেন। মানবকল্যাণ ও শান্তির প্রত্যাশায় দার্শনিকদের চিন্তা, চেতনা ও অবদানের কথা স্মরণ করে ইউনেসকো ২০০২ সালে সর্বপ্রথম বিশ্ব দর্শন দিবস ঘোষণা করে। ২০০৫ সাল থেকে নভেম্বর মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব দর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইউনেসকো ২০০৫ সালের সম্মেলনের ঘোষণায় বলেছে, দর্শন সমালোচনামূলক ও স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে এবং বিশ্বকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য সহনশীলতা ও শান্তির প্রচারে কাজ করতে সক্ষম। সারা বিশ্ব এখন নানা কারণে অস্থিতিশীল। কভিড-১৯, বর্ণবাদ, অর্থনৈতিক সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ, রোহিঙ্গা ইস্যু ইত্যাদি নানা সংকটে বিশ্বের মানুষ নিমজ্জিত। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে এ সংকট থেকে উত্তরণের আশু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানবিক ও মূল্যবোধের এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দর্শন আমাদের দেখাতে পারে। কোনো সমস্যাকে দর্শন বিশেষ কোনো প্রেক্ষিত থেকে মূল্যায়ন বা বিচার করে না। দর্শন সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। বর্তমানে বিশ্ব রাজনীতিতে যে যুদ্ধের দামামা বাজছে, তার অন্যতম কারণ গোষ্ঠীস্বার্থ সংরক্ষণ, একদেশদর্শী নানা নীতি। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল, ইউক্রেন-রাশিয়াসহ বর্তমানে যেসব যুদ্ধ চলছে, এসব যুদ্ধের কুশীলবরা যদি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারত, তাহলে অচিরেই আলোচনার টেবিলে এ সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যেত। উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার কারণে তারা বিশ্বনেতা হওয়ার পরিবর্তে আঞ্চলিক নেতায় পরিণত হচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের নেতা ভাবতে পারছে না। দর্শনের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে যেভাবে সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মার্টিন লুথার কিং কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলা। বিশ্ব নাগরিক হয়ে ওঠার আহ্বান জানিয়ে দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তার কবিতায় বলেছেন— ‘আরব আমার, ভারত আমার, চীনও আমার নয়কো পর বিশ্বের সেরা মুসলিম আমি সারাটি জাহানে বেঁধেছি ঘর।’ যুগে যুগে দার্শনিকরা যুদ্ধ এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। আঠারো শতকে ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের দুঃশাসন, সামন্ত প্রথা, দাস প্রথাসহ নানা কারণে মন্টেস্কো, ভলতেয়ার ও রুশো প্রতিবাদ করেছেন। প্রেরণা দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। ফরাসি দার্শনিক অঁদ্রে মালরো ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন করেন। তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্র ও ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলও সারাজীবন যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। উদারতাবাদী ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থ প্রয়োগ না হলে দিন দিন বিশ্বসভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তীব্র উৎকর্ষের এ যুগে নব নব আবিষ্কারও মানুষকে যথার্থ শান্তির পথ দেখাতে পারছে না। অনৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকটের জন্য খবরের কাগজের পাতায় সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং, প্রতারণার খবরে ভরপুর থাকে। একটি নৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেই তাদের জন্য বিজ্ঞান আশীর্বাদ হয়ে উঠবে; অন্যথায় অভিশাপে পরিণত হবে প্রযুক্তির সাফল্য। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার The Republic গ্রন্থের পাতায় পাতায় ন্যায়পরতার কথা বলেছেন। একটি রাষ্ট্র তখনই কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হয় যখন সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্লেটো তার গ্রন্থে ন্যায়তত্ত্বের ধারণায় বলেছেন, কারিগরশ্রেণি, যোদ্ধাশ্রেণি ও শাসকশ্রেণির গুণের সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বর্তমানে অনেক রাষ্ট্র মানবাধিকার সূচকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। গণতন্ত্রহীন অনেক সামরিক শাসিত রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার অনুপস্থিত। এসব দেশের শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নৈতিকতা চর্চা, সর্বোপরি দর্শন চর্চা প্রয়োজন। বিশ্ব দর্শন দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের আলোচনা ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে অসম অর্থনৈতিক বণ্টনের ব্যবস্থার জন্য ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিবরা আরও গরিব। অসাম্যের বিরুদ্ধে বহুদিন আগেই কথা বলেছেন কার্ল মার্কস, অ্যাঙ্গেলস ও লেনিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অসাম্যের এ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে যত সমৃদ্ধিই হোক, সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবে না। দর্শনের উদারনৈতিক সাম্যবাদী নীতি ‘তত্ত্ব’ থেকে সাধারণের কাছে পৌঁছাতে পারলেই কল্যাণকর সুখী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব দর্শন দিবস সিলেবাস বা পাঠ্যপুস্তকের ভেতর থেকে দর্শনের বাণীকে রাষ্ট্রনায়কের টেবিল কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা
১৬ নভেম্বর, ২০২৩

বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া দর্শন
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থনৈতিক নীতির ধরন কেমন হবে, সেটি নিয়ে বর্তমানে দুটি এজেন্ডা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। এদের একটি দেশীয় বিষয়াবলি—যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল, সমৃদ্ধ ও টেকসই মার্কিন অর্থনীতি বিনির্মাণকে গুরুত্বারোপ করছে। অন্যটি ভূ-রাজনীতি এবং চীনের ওপর মার্কিন আধিপত্য বজায় রাখার গুরুত্বারোপ করছে। আর বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে এ দ্বন্দ্বের ফলাফল এবং বিরোধী অগ্রাধিকারগুলো সহাবস্থান করতে পারে কিনা—তার ওপর। দেশীয় উৎপাদন পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং সবুজ রূপান্তর সহজ করতে উচ্চাভিলাষী শিল্পনীতি গ্রহণের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ডেমোক্রেটিক প্রশাসন থেকে যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন আমূল সরে এসেছে, সেটি নির্দেশ করে। এমনকি চীন বিষয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ অন্য যে কোনো প্রশাসনের তুলনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে বর্তমান বাইডেন প্রশাসন। চীন সরকারকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা এবং সূক্ষ্ম প্রযুক্তি রপ্তানি ও বিনিয়োগে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে।  যদিও কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের সুসংগত কোনো রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেনি, যা বিভিন্ন উপাদানকে একত্র করার পাশাপাশি চীন ও অন্যান্য দেশকে আশ্বস্ত করে—মার্কিন এ অর্থনৈতিক কৌশল-সংঘাত, একতরফাবাদ ও সংরক্ষণবাদকেন্দ্রিক নয়। কিন্তু বর্তমানে এই সমস্যা মোকাবিলায় বাইডেন প্রশাসন পদক্ষেপ নিচ্ছে—মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকে এমন ইঙ্গিতই মিলছে। আর সেটি সম্ভাব্য নতুন ওয়াশিংটন ধারণার উত্থানকেও নির্দেশ করছে। বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি বড় ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। জ্যেষ্ঠ মার্কিন নীতিনির্ধারকরা এখন মনে করছেন, ১৯৯০-পরবর্তী বিশ্বায়নের মডেল, যা জাতীয় নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চেয়ে মুক্তবাণিজ্য ও মুক্তবাজারকে অগ্রাধিকার দেয়, সুস্থ গণতন্ত্রের আর্থসামাজিক ভিত্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুলিভান তার বক্তব্যে প্রশাসনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক এজেন্ডার পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলেছেন। তিনি এই পাঁচ স্তম্ভকে ‘মধ্যবিত্তের বৈদেশিক নীতি’ বলে অভিহিত করেছেন।  প্রথম স্তম্ভ হলো—একটি ‘আধুনিক আমেরিকান শিল্প কৌশল’, যেটির লক্ষ্য হবে মার্কিন সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুঘটক হিসেবে কাজ করা। দ্বিতীয়টি হলো অন্যান্য উন্নত গণতন্ত্র এবং উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে কাজ করা। যার লক্ষ্য হবে মার্কিন মিত্ররাও যেন ‘সক্ষমতা, সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তি’ উন্নত করার ক্ষেত্রে একই ধরনের নীতি গ্রহণ করে তা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, বাজারে প্রবেশাধিকারে গুরুত্বারোপ করে এমন প্রথাগত বাণিজ্য চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও করপোরেট কর প্রতিযোগিতার মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব’-এর দিকে ঝুঁকবে দেশটি। পাশাপাশি উদীয়মান অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার নিয়ে আসা এবং ঋণ নিয়ে সংকটে থাকা দেশগুলোকে সহায়তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার কয়েকটি নিয়ে বিশেষভাবে বিতর্কও রয়ে গেছে। কারণ অন্যান্য দেশ কিছু নীতিকে, যেমন প্রশাসনের ‘আমেরিকান দাবি-দাওয়া কেনা’, সংরক্ষণবাদী হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু সুলিভানের পঞ্চম স্তম্ভ, যা ‘যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক প্রযুক্তি’ রক্ষায় গুরুত্ব দেয়, তা বিশ্ব অর্থনীতি ভবিষ্যতের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। উন্নত সেমিকন্ডাক্টর (অর্ধপরিবাহী) মার্কেটে চীনের প্রবেশাধিকারে বাধা দিতে বাইডেন প্রশাসনের সুদূরপ্রসারী রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ পঞ্চম স্তম্ভের সবচেয়ে স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। চীনা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে মার্কিন বিনিয়োগের ওপর আরও বিধিনিষেধের পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। বিশেষত মাইক্রোচিপের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাতে। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ‘প্রযুক্তিগত অবরোধ’ আরোপ করেছে বলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ চীনা কর্মকর্তারা অভিযোগ করে আসছেন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের কলামিস্ট অ্যাডওয়ার্ড লুসের মতে, চীনের প্রযুক্তি খাতকে বিচ্ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র ‘পূর্ণমাত্রার অর্থনৈতিক যুদ্ধে’ লিপ্ত হচ্ছে।  তবে এটিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছেন সুলিভান। মার্কিন এই নীতিকে একটি ছোট উঠান ও উঁচু বেড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন তিনি। প্রশাসনের পদক্ষেপগুলোকে তিনি ‘সতর্কতার সঙ্গে মানানসই বিধিনিষেধ’ বলেছেন, যা জাতীয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে গৃহীত এবং উন্নত প্রযুক্তির ‘ক্ষুদ্র একটা অংশ’কে লক্ষ্য করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। গত এপ্রিলের শেষ দিকে জনস হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে অর্থমন্ত্রী ইয়েলেনের বক্তব্য দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে সুলিভানের বার্তা প্রত্যাশিতই ছিল। তিনি বলছেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ মোকাবিলা করতেই এ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ। আর এটি ক্ষুদ্র পরিসরে কয়েকটি জিনিসেই থাকবে। তিনি জোর দিয়েই বলেছেন, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে না যুক্তরাষ্ট্র।’ জাতীয় নিরাপত্তার নামে বড় ধরনের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিধিনিষেধ আরোপের যে ঝুঁকি রয়েছে, তা বাইডেন প্রশাসন বোঝে—সেটি সুলিভান ও ইয়েলেনের বক্তব্যই নির্দেশ করে। এ ধরনের পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং সম্ভবত উসকানির ফলে চীন পাল্টা ব্যবস্থা নিলে বিপরীত ফলও বয়ে নিয়ে আসতে পারে।  স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থা নির্ভর করে প্রতিটি দেশের জাতীয় স্বার্থরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার নিয়ম ও অনুশীলনের ওপর। এসব স্বার্থরক্ষা সুচিন্তিত এবং অন্য দেশের ক্ষতি যেন না করে, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনও রয়েছে। এটি অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে অসম্ভব নয়। যখন কোনো সরকার অন্যান্য দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন একতরফা নীতির মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করে তখন নীতিনির্ধারকদের উচিত তাদের লক্ষ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা, যোগাযোগের উন্মুক্ত লাইন বজায় রাখা এবং সেই নীতির বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করতে প্রতিকারের প্রস্তাব করা। অন্যপক্ষকে শাস্তি দেওয়া বা দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করার স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে নীতি গ্রহণ করা উচিত নয় এবং কোনো ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে এর সঙ্গে সম্পর্কহীন ক্ষেত্রে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে একে  অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করাও ঠিক নয়। যেমনটা স্টিফেন ওয়াল্ট ও আমি বলেছি, গ্রহণযোগ্য নীতিমালার ওপর এ ধরনের স্ব-আরোপিত সীমারেখা (তিক্ততা) বৃদ্ধি রোধে সহায়তা করতে পারে। এমনকি অন্যপক্ষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুমোদন পেতে সহায়তা করতে পারে।  ইয়েলেন ও সুলিভানের সাম্প্রতিক বক্তব্য বলছে, বাইডেন প্রশাসনের বৈদেশিক অর্থনৈতিক নীতিমালা এসব নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হবে। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। যেমন : উন্নত চিপের ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কি যথাযথভাবে চিন্তা-ভাবনা করে নেওয়া, নাকি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তাকে পর্যাপ্ত সুবিধা না দিয়েই চীনের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ধ্বংসে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে? যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও পারমাণবিক ফিউশনের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে এসব বিধিনিষেধ সম্প্রসারিত করা হয়, তখনো কি আমরা কেবলমাত্র প্রযুক্তির ‘ক্ষুদ্র অংশকে’ লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে বলতে পারব? এ ছাড়া সুলিভান ও ইয়েলেনের ‘সোজা-সাপ্টা’ জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকৃত নাকি একতরফা পদক্ষেপের অজুহাত মাত্র—সেটি এখনো স্পষ্ট না। যুক্তরাষ্ট্র কি মাল্টিপুলার বিশ্বব্যবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত—যেখানে চীনের আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শাসন কাঠামো গঠনের ক্ষমতা থাকবে? নাকি প্রশাসন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেমনটা বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল দেখে মনে হয়? কথার চেয়ে কর্মকাণ্ডের আওয়াজ বেশি। এসব প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যাবে। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি না করেও তার বৈধ জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের সমাধান করতে পারে—ইয়েলেন ও সুলিভানের বক্তব্য তাদের কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করে।  লেখক : ড্যানি রড্রিক।  ড্যানি হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমিতির সভাপতি।  
১৪ নভেম্বর, ২০২৩
X