উচ্ছেদের দুশ্চিন্তায় অলিম্পিকে টিকিট পাওয়া সন্তানের চা দোকানি মা
আর্চার সাগর ইসলাম (১৮)। দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে এবার প্যারিস অলিম্পিকে খেলার সরাসরি সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এ নিয়ে সাগরের পরিবারসহ রাজশাহীবাসী বেজায় খুশি। কিন্তু হঠাৎ দেশের এই সুখকর খবরের মধ্যে সাগর ইসলামের অসহায় বিধবা চা দোকানি মা সেলিনা খাতুন পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়।  রাজশাহী নগরীর মহানন্দা আবাসিক এলাকার বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে সাগর ইসলামের মায়ের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সেই চায়ের দোকানটি উচ্ছেদের খবর শুনে দুঃখিনী মা সেলিনা খাতুনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।  জানা গেছে, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) জায়গায় বিধবা সেলিনা খাতুনের চায়ের দোকানটির অবস্থান। আরডিএ ওই এলাকাতেই উদ্যোগ নিয়েছে উচ্ছেদ অভিযানের। আর সেই অভিযানে সাগরদের মানুষ করে তোলার পেছনে একমাত্র অবলম্বন হয়ে থাকা চায়ের দোকানটিও করা হবে উচ্ছেদ। এমন খবরে চরম দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন সাগর ইসলামের চা দোকানি মা। সাগর ইসলামের মা সেলিনা খাতুন জানান, চার সন্তান নিয়ে অভাব অনটনের সংসারে মোটামুটি ভালোই কাটছিল তাদের সংসার। কিন্তু ১৫ বছর আগে হঠাৎ সাগর ইসলামের বাবা মারা যান। তখন থেকেই মহানন্দা আবাসিক এলাকায় বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে ছোট্ট চায়ের দোকান দিয়ে চার সন্তানকে লালনপালন করে আসছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ তিনি জানতে পারেন সেখানে আরডিএ অভিযান চালিয়ে অন্য সবকিছুর সঙ্গে তার একমাত্র জীবিকার অবলম্বন চায়ের দোকানটিও হবে উচ্ছেদ।  সেলিনা খাতুন জানান, তার এই দোকানটি উচ্ছেদ হলে তাকে পথে বসতে হবে। এজন্য অন্য কোথাও পুনর্বাসন না কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি দোকানটি সেখানেই রাখার দাবি জানান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেলিনা খাতুনের চার সন্তান। দুই ছেলের মধ্যে সাগর ইসলাম ছোট, জাতীয় দলের আর্চার। বড় ছেলে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকে (অনার্স) পড়ছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। চায়ের দোকানের আয়ে চার ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন তিনি।  সেলিনা বলেন, সাগর যখন ছোট, তখন দোকানের টুলের ওপরে শোয়ায়ে রাখতেন। যখন খুব মশা লাগত, তখন গায়ের ওপরে কাপড় দিয়ে রাখতেন। ভোর ৫টায় দোকানে আসতেন ও রাত ১১টায় বাড়ি ফিরতেন। এভাবেই কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন।  জানা গেছে, সাগর ইসলাম ২০১৭ সালে রাজশাহী ‘এসবি আর্চারি ক্লাবে’ ভর্তি হয়ে অনুশীলন শুরু করেন। দুই বছর পর ২০১৯ সালে তিনি ভর্তি হন বিকেএসপিতে। বিকেএসপিতে ভালো করে জাতীয় দলে সুযোগ পান। ১৭ জুন তুরস্কের আনাতোলিয়ায় ‘২০২৪ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্ট’-এ ছেলেদের রিকার্ভ এককে দারুণ পারফর্ম করে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন সাগর। প্যারিস অলিম্পিকের আগে সেটিই ছিল রিকার্ভ ইভেন্টে সরাসরি যোগ্যতা অর্জনের শেষ সুযোগ। সেমিফাইনালে উঠে অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করে সেখানেই থেমে যাননি সাগর। ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত ঘরে এনেছেন রৌপ্য। গত মঙ্গলবার দেশে ফেরেন সাগর ইসলাম। এখন টঙ্গীতে জাতীয় দলের ক্যাম্পে রয়েছেন। সাগর জানান, এই চায়ের দোকান চালিয়েই তার মা তাদের বড় করে তুলেছেন। এই চায়ের দোকানেই তারা মানুষ করেছেন। এখন অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা হলে তাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মায়ের দুশ্চিন্তা আর কষ্টের কথা চিন্তা করে অন্য কোথাও পুনর্বাসন না করে সেখানেই দোকানটি চালাতে দেওয়ার দাবি জানান তিনি। রাজশাহী এসবি আর্চারি ক্লাবের সভাপতি ও কোচ সাইফুদ্দিন বাচ্চু জানান, রাজশাহী বিভাগ থেকে এই প্রথম কোনো খেলোয়াড় (সাগর ইসলাম) অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হলেন। এটি রাজশাহীর জন্য একটি বিরাট গর্বের ব্যাপার। যে ছেলে দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনছেন, তার পরিবারের পাশে প্রশাসনের দাঁড়ানো দরকার। হয়তো সাগরের মায়ের দোকানটা রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু ছেলের অর্জনের দিকে তারা পরিবারের জন্য জায়গাটা ছেড়ে দিতে পারে। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এস্টেট অফিসার মো. বদরুজ্জামান জানান, বছরে চারবার তারা উচ্ছেদ অভিযান চালান। তাদের প্লটে অবৈধভাবে কেউ দোকান করলে সেখানে থাকার সুযোগ নেই। তবে ওই চায়ের দোকানিকে তারা উঠতে বলেননি। হয়তো প্লটের মালিক আরডিএর কথা বলে তাকে সরে যেতে বলেছেন। তিনি আরও জানান, আরডিএর প্লটে কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই, নেই নীতিমালাও। তবে জেলা প্রশাসন চাইলে ভূমিহীনকে কোনো খাসজমি বরাদ্দ দিতে পারেন। জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত মো. রহমতুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি আমি ওইভাবে জানি না। আসলে না দেখলে তো কিছুই বলতে পারছি না। সরেজমিনে দেখে কী করা যায় সেটি পরে দেখা যাবে। এ বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ কালবেলাকে বলেন, তিনি যেখানে চায়ের দোকান রয়েছে সেটি যদি সরকারি খাস জমি হয়ে থাকে তাহলে মানবিকতার দৃষ্টিতে আমি অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারতাম। এটি যেহেতু আরডিএর জায়গা। সুতরাং সরকারিভাবে বা প্রশাসনিকভাবে ওইখানে হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে।
২৯ জুন, ২০২৪
X