পরীকাণ্ডে চাকরি হারাচ্ছেন সাকলায়েন
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার ও বর্তমানে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. গোলাম সাকলায়েনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনকে (পিএসসি) জানানো মতামতে ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে পুলিশের এই কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার জন্য বলেছে মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি পিএসসিতে পাঠানো এক চিঠিতে এ মতামত জানানো হয়েছে। নায়িকা পরীমণির সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক গড়ার অভিযোগে সাকলায়েনকে এ শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালের ৯ জুন রাতে সাভারে ঢাকা বোট ক্লাবে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ১৪ জুন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন পরীমণি। সেই মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন ডিএমপি ডিবির গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাকলায়েন। মামলাটি তদারকি করার সময় বাদী পরীমণির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান এই কর্মকর্তা। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তাকে বদলি করা হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল তদন্ত কমিটি। বিভিন্ন ধাপে তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ১৩ জুন সাকলায়েনকে গুরুদণ্ড দেওয়ার এই মতামত দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পিএসসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত পেয়েছি। এখন সেই মতামত যাচাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে মতামত দিয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা যাচাই করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ যাবে, পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির আদেশ সাপেক্ষে প্রজ্ঞাপন জারি করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামতে ওর ওপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ সাকলায়েনের বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরীমণির করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তৎকালীন এডিসি সাকলায়েন অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তবে পিএসসিতে পাঠানো মতামতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ জানিয়েছে, সাকলায়েন ঢাকায় কর্মরত থাকা অবস্থায় পরীমণির সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয় এবং যোগাযোগ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নায়িকা পরীমণির বাসায় নিয়মিত রাতযাপন শুরু করেন। সাকলায়েনের সিডিআর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২১ সালের ৪ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময়ে (দিনে ও রাতে) নায়িকা পরীমণির বাসায় অবস্থান করেছেন। নায়িকা পরীমণির মোবাইলের ফরেনসিক রিপোর্ট (মামলার আলামত হিসেবে জব্দ) পর্যালোচনায় দেখা যায়, সাকলায়েন ও পরীমণির আদান-প্রদান করা মেসেজগুলো (২৯ জুলাই, ২০২১ তারিখ থেকে ৩ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) এবং তাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে (১১ জুলাই, ২০২১ তারিখ থেকে ৪ আগস্ট, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত) কথোপকথন সাধারণ পরিচিতি বা পেশাগত প্রয়োজনে স্থাপিত কোনো সম্পর্কের নয়, বরং অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক। মন্ত্রণালয় তাদের চিঠিতে জানিয়েছে, গত ১ আগস্ট, ২০২১ ভোর ৬টা থেকে ২ আগস্ট, ২০২১ রাত ৩টা পর্যন্ত রাজারবাগ মধুমতি পুলিশ অফিসার্স কোয়ার্টার্সে নায়িকা পরীমণির যাতায়াতের সিসিটিভি ফুটেজের ফরেনসিক করা হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্ট বিশ্লেষণ ও সাক্ষীদের জবানবন্দি অনুযায়ী, গত ১ আগস্ট, ২০২১ সাকলায়েনের স্ত্রী না থাকা অবস্থায় নায়িকা পরীমণি তার রাজারবাগের সরকারি বাসায় যান এবং প্রায় ১৭ ঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে রাত দেড়টায় বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন। মন্ত্রণালয় মতামতে বলেছে, সাকলায়েন ও নায়িকা পরীমণির সম্পর্কের বিষয়টি বিভিন্ন অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায়, টেলিভিশনে ও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে জনমনে এ বিষয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার জন্ম দেয়। গোলাম সাকলায়েন বাংলাদেশ পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে সরকারি দায়িত্বের বাইরে নায়িকা পরীমণির সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তিনি বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক হওয়া সত্ত্বেও পরীমণির সঙ্গে তার বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পরীমণির সঙ্গে জন্মদিন উদযাপন ও নিজের সরকারি বাসভবনে নিজ স্ত্রীর অবর্তমানে সময় কাটানোর মতো ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। তা প্রচারিত হওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। উল্লিখিত অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলাটির শুনানি ও তদন্ত করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) হায়াত-উদ-দৌলা খানকে। তদন্তে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এ কারণে সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী কেন তাকে ‘চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ’ করা হবে না সে মর্মে দ্বিতীয়বার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সাকলায়েন নোটিশের জবাব দেন এবং ‘চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ’ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক লিখিত জবাব, মৌখিক বক্তব্য ও অন্যান্য কাগজপত্র পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে দ্বিতীয়বারের কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় বিধি মোতাবেক ‘গুরুদণ্ড’ হিসেবে চাকরি থেকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। বিধি অনুযায়ী এ বিষয়ে পিএসসির পরামর্শ চেয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। পুলিশ সদর দপ্তর ও পিএসসির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাকলায়েনের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে জননিরাপত্তা বিভাগ এ সংক্রান্তে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
২৬ জুন, ২০২৪
X