কিশোরী উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় মন্দিরে আগুন
গ্রামজুড়ে সুনসান নীরবতা। হৈ-হুল্লোড় তো দূরের কথা, কোথাও নেই সাধারণ ভিড় বা জটলা। বোরো ফসল তোলার জন্য নেই বৈশাখের নিয়মিত কর্মচাঞ্চল্য। তার পরিবর্তে গ্রামের সর্বত্র টহল দিচ্ছেন পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। যেন অঘোষিত এক যুদ্ধাবস্থা।
কোনো কোনো বাড়ির উঠানে খাঁচায় বন্দি হাঁস-মুরগি আর গোয়ালে গরু রেখে উধাও হয়ে গেছেন বাসিন্দারা। তাই চরম অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে নির্বোধ প্রাণীগুলো। অনেক বাড়ির সব ঘরেই ঝুলছে তালা। কোনো কোনো বাড়িতে দু-একজন নারীর দেখা মিললেও ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে আছেন তারা। যেন নিঃশ্বাসও ফেলছেন নিঃশব্দে। সব মিলিয়ে চারদিকে থমথমে, গুমোট পরিবেশ।
ফরিদপুরের মধুখালী থানার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী এলাকায় সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত গ্রামটির কৃষ্ণনগর এলাকায় পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই বারোয়ারী কালীমন্দির। এই বিদ্যালয় আর মন্দির ঘিরেই গত ১৮ এপ্রিল ঘটে গেছে মর্মান্তিক এক ঘটনা। মন্দিরের কালী প্রতিমায় আগুন দেওয়াকে কেন্দ্র করে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নির্মাণ শ্রমিক সহোদরকে। সে সময় আহত হন আরও দুজন।
অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনার পর জল গড়িয়েছে বহুদূর। দুই ভাইকে পেটানোর কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল। ভিডিওতে স্থানীয় চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামানকে দেখা যায় ওই শ্রমিকদের প্রথম আঘাত করতে। এরপরই উত্তেজিত জনতা তাদের গণপিটুনি দিতে শুরু করে। তাতেই মারা যান দুই ভাই আসাদুল ও আশরাফুল।
কীভাবে মন্দিরের কালী প্রতিমায় আগুন লাগল, এই অপকর্মে কারা জড়িত— এ প্রশ্ন এখন সবার। সেইসঙ্গে এত অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে সেখানে হাজারো গ্রামবাসী জড়ো হলেন, তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর আলোচনা। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। আর শ্রমিক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা ও পাল্টা হামলার ভয়ে গ্রাম ছেড়েছেন পঞ্চপল্লীর পুরুষরা।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম কালবেলাকে জানান, মধুখালী থানায় মন্দিরে আগুন, দুই নির্মাণ শ্রমিককে হত্যা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৩ জন। তবে আগুন দেওয়া, হামলার নেপথ্যে কারা আছে, সেসব বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তদন্ত চলছে।
কী ঘটেছিল ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায়:
কৃষ্ণনগর এলাকায় পঞ্চপল্লী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আর বারোয়ারী কালীমন্দিরের মধ্যে ব্যবধান মাত্র একটি বটগাছের। বিদ্যালয়টিতে বেশ কিছুদিন ধরে শৌচাগার নির্মাণে কাজ করছিলেন সাত-আটজন শ্রমিক। তাদের বাড়ি অন্য গ্রামে হওয়ায় রাতেও স্কুলের একটি কক্ষেই ঘুমাতেন।
সরেজমিন স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে এই মন্দিরের দেখাশোনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে মন্দিরের পাশেই থাকা প্রভাস মণ্ডলের পরিবার। যুগযুগ ধরে সেই পরিবারের নারীরাই এই মন্দিরে প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রদীপ দেন। বর্তমানে মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতেন প্রভাসের স্ত্রী। এ ছাড়া মাঝে মাঝে তাদের কলেজ পড়ুয়া মেয়েও মন্দিরে প্রদীপ জ্বালাতে যেতেন। ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায়ও গিয়েছিলেন প্রভাসের কন্যা। মন্দিরে যাওয়ার পথে শ্রমিকদের মধ্যে কেউ ওই কিশোরীকে উদ্দেশ করে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এ নিয়ে কিশোরীর মা-বাবার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান অভিযুক্ত শ্রমিকরা। এর কিছুক্ষণ পর তপতী ও প্রভাস মন্দিরে গিয়ে দেখতে পান, এক শ্রমিক লাইটার দিয়ে কালী প্রতিমার শাড়িতে আগুন দিয়ে মন্দির থেকে নামছে। এ সময় তারা চিৎকার করতে করতে নিজেরাই আগুন নেভান।
স্থানীয়রা জানান, তাদের চিৎকারে আশপাশের বাড়ির ১০-১২ জন নারী-পুরুষ এসে জড়ো হন। সে সময় শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন প্রতিমায় আগুন লাগানোর বিষয়টি অস্বীকার করছিলেন। তবে দু-একজন আবার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলছিলেন। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে শ্রমিকরা রড নিয়ে আসা নছিমন গাড়িতে করে পালানোর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু নছিমন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা যেতে পারেননি।
এরই মধ্যে গ্রামের মানুষ এবং স্থানীয় চৌকিদার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। চৌকিদার ফোনে স্থানীয় ইউপি মেম্বার অজিত কুমার বিশ্বাসকে ঘটনা জানালে তিনিও সেখানে আসেন। মোবাইল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে মন্দিরে আগুন লাগার ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তখন আশপাশের কয়েক গ্রামের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে দেখে আতঙ্কে অভিযুক্ত শ্রমিকদের বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষে বন্ধ করে রাখেন ইউপি সদস্য অজিত। পরে আরেক ইউপি সদস্য লিংকন বিশ্বাসও ঘটনাস্থলে হাজির হন।
উত্তেজিত জনতা এক পর্যায়ে ‘ধর ধর’ বলে ইটপাটকেল, রড, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে কক্ষের দরজা-জানালা ভাঙতে শুরু করে। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে অজিত কুমার চেয়ারম্যান শাহ আসাদুজ্জামান তপনকে ফোন করে ডেকে আনেন। চেয়ারম্যান এসেই সোজা কক্ষের ভেতরে যান।
এ ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শ্রমিকদের জেরা করার একপর্যায়ে তাদের মারধর করে মন্দিরে আগুন দেওয়ার কারণ জানতে চাইছেন ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি মার শুরু করার পরই মূলত পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়। এককথায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। উত্তেজিত জনতা মেম্বার এবং চেয়ারম্যানের কথা পাত্তা না দিয়ে শ্রমিকদের মারধর শুরু করেন। এ সময় চেয়ারম্যান শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে থানায় ফোন করেন।
খবর পেয়ে মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হন। কিন্তু উত্তেজিত জনতা তাদেরও অবরুদ্ধ করে। পরে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে আসেন। রাত ১১টার পর রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়ে স্থানীয় জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা হয়। ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই মারা যান নির্মাণ শ্রমিক দুই ভাই।
এ ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরিদপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, ‘কোনো মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে এই ঘটনা ঘটেছে কি না, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। ভিডিওতে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান আঘাত করার পরই এই গণহামলার ঘটনা ঘটেছে। ইউপি মেম্বার এবং চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই ঘটনা সম্পর্কে জানা যাবে। তাদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের অভিযান চলছে।’
যেভাবে ছড়িয়ে পড়ল ঘটনা:
গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ এপ্রিল ঘটনা শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টার দিকে। প্রথমে কয়েকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে কয়েকজন মোবাইলে পোড়া মূর্তির ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে তা ছড়িয়ে যায়। আশপাশের সব গ্রামের লোকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় খুব সহজেই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
এ ছাড়া দিনের কাজ শেষে কয়েক গ্রামের মানুষ স্থানীয় বাজারে আড্ডা দেয়। কৃষ্ণনগর এলাকার যেসব লোকজন বাজারে উপস্থিত ছিলেন, তাদের মাধ্যমে অন্য গ্রামের লোকজনের মধ্যেও বিষয়টি জানাজানি হয়। এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজার হাজার লোক ওই মন্দিরের সামনে চলে আসেন।
শান্তির গ্রামে আতঙ্কের ছায়া:
সাত বছর বয়সে পঞ্চপল্লী গ্রামে বধূ হয়ে এসেছিলেন সেঁজুতি বিশ্বাস। তার বয়স এখন সত্তরের বেশি। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘এত বছরে এই গ্রামে কখনো এমন ঘটনা দেখিনি। এখানে সবাই কৃষিকাজ করে চলি। দিন এনে দিন খাই। এই স্কুলে অনেক মানুষ কাজ করতে এসেছে। হিন্দু হোক আর মুসলিম হোক—কারও সঙ্গে আমাদের কিছু হয়নি। তারা আমাদের ঘরে খেয়েছে, জল নিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা ১০ দিন ধরে বাড়িতে নেই। কই আছে জানি না। শুনেছি, ফিরলেই নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। ঘরের খাবারও শেষ। হাতে একটা টাকাও নেই। আমরা তো কিছু করিনি, আমাদের কেন এমন হবে?’
এমন আতঙ্ক নিয়ে বসবাস করছেন গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারগুলো। পুলিশের পাহারায় থাকা গ্রামে প্রবেশ করছেন না কেউ। একাধিক নারীর ভাষ্য, ‘বাড়ির পুরুষরা আমাদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতেও ভয় পায়। কে যে কই আছে, জানি না। এই অবস্থা কি কোনোদিন শেষ হবে না?’
কথা হয় পঞ্চপল্লী গ্রামের অদূরে কয়েকটি মুসলিম পরিবারের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘কখন যে কী হয় বুঝতে পারছি না। শুনেছি, আরও হামলা হতে পারে। এসব হামলা করে লাভ কী। মারা তো যাবে মানুষই!’
পঞ্চপল্লী গ্রামে নিরাপত্তার দায়িত্বে আসা পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের একজন এসআই জানান, ‘উপরমহল থেকে নির্দেশ আছে যেন কোনোভাবেই কোনো সহিংস ঘটনা না ঘটে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে উত্তেজনা সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত টহল চলবে। যেন বাইরে থেকে কোনোভাবেই এখানে হামলা না হয়। এজন্য ফরিদপুর সদর থেকে মধুখালী পর্যন্ত মোড়ে মোড়ে পুলিশ পাহারায় আছে।’
সার্বিক বিষয়ে ফরিদপুর জেলা প্রশাসক মো. কামরুল আহসান তালুকদার কালবেলাকে বলেন, ‘এটি পরিকল্পিত নাকি আকস্মিক ঘটনা, তা তদন্ত শেষ না হলে বলা যাবে না। এরই মধ্যে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুই ভাইকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ আসামিদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আমি বলতে চাই, তারা যেন আত্মসমর্পণ করেন। যদি তারা সেটা না করেন, তাহলে তাদের ধরিয়ে দিতে কেউ তথ্য দিলে তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। কোনো আসামি যেন দেশত্যাগ করতে না পারে, সেজন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন বিমানবন্দর, পোর্ট, বন্দরগুলোকে সতর্ক থাকার অনুরোধ করা হয়েছে।’
মধুখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মামনুন আহমেদ অনীক কালবেলাকে বলেন, ‘নির্মাণ শ্রমিক হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা কে বা কারা, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় স্থানীয় ইউপি সদস্য এবং চেয়ারম্যানের শতভাগ ব্যর্থতা রয়েছে। আমি এবং মধুখালী থানার ওসি ঘটনাস্থলে যাওয়া পর্যন্ত তিনি বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। এ ছাড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি নিজেই শুরুতে শ্রমিকদের মারধর করছেন। এ ছাড়া আগুন দেওয়ার ঘটনায় শ্রমিকরা যে জড়িত, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ মেলেনি।’
মধুখালী থানার ওসি মিরাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। তবু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারেও চেষ্টা চলছে।’
২৮ এপ্রিল, ২০২৪