রমজান মাসে রোজা রাখা ফরয। এটা রমজান মাসের বিশেষ আমল। সকল আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
রমজানের রাতের বিশেষ আমল হল কিয়ামে রমজান তথা বিশ রাকাত তারাবীর সালাত আদায় করা। রমজান মাসের অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত লাভ করার জন্য এবং প্রতিশ্রুত সওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার জন্য তারাবীর নামাযের প্রভাব অপরিসীম।
ন-সদকা সর্বাবস্থাতেই উৎকৃষ্ট আমল, কিন্তু রমজানে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২
রমজান মাস কুরআন অবতরণের মাস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল আ.-এর সাথে রমজানের প্রত্যেক রাতে কুরআন মাজীদ দাওর করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘হযরত জিবরাইল আ. রমজানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে নবী করিম (সা.)-এর সাথে সাক্ষাত করতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন মাজীদ শোনাতেন।’-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০২
রমজান মাসে শয়তান শৃংখলাবদ্ধ থাকে। এই সুযোগে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করা যায়। এ মাসে যে কোনো ইবাদত নিয়মিত করতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয় না এবং পরবর্তীতে তা সহজেই অভ্যাসে পরিণত হয়। সুতরাং যিকির-আযকারের সঙ্গে অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা উচিত। অন্তত বিভিন্ন সময়ের নফল নামাযগুলো আদায় করা যেমন-ইশরাক, চাশত ও তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।
রমজান মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়ে কান্না-কাটি করে দুআ করা।
যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও নিজের গুনাহসমূহ ক্ষমা করাতে পারল না তার উপর জিবরীল আ. ও দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসাপ করেছেন। তাই জীবনের কৃত গুনাহের কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তওবা ইস্তেগফার করা এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা মন্জুর করিয়ে নেওয়ার উত্তম সময় রমজান।
শেষ দশকের মাসনূন ই’তিকাফ অত্যন্ত ফযীলতের আমল। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৭১
ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে সহস্র রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রাত-লাইলাতুল কদর তালাশ করা কর্তব্য। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
‘নিঃসন্দেহে কদরের রাতে আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। আর আপনি কি জানেন শবে কদর কী? শবে কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেশতা ও রুহুল কুদ্স (জিবরাঈল আ.) তাদের পালনকর্তার আদেশক্রমে প্রত্যেক মঙ্গলময় বস্ত্ত নিয়ে (পৃথিবীতে) অবতরণ করে। (এ রাতের) আগাগোড়া শান্তি যা ফজর হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ -সূরা কদর
প্রত্যেক নেক আমলের বিভিন্ন ফযীলত ও সওয়াব রয়েছে যা দ্বারা মহান রাব্বুল আলামীন আমলকারীকে পুরস্কৃত করবেন, কিন্তু রোজার বিষয়টি একেবারেই স্বতন্ত্র। কারণ রোজার বহুবিধ প্রতিদান ছাড়াও এ বিষয়ে একটি অতুলনীয় ঘোষণা রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন -
‘মানুষের প্রত্যেকটি আমলকে বৃদ্ধি করা হয়। একটি নেকী (সওয়াব) ১০ গুণ থেকে (ক্ষেত্র বিশেষে) ৭০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : কিন্তু রোজার ব্যাপারটি ভিন্ন। কারণ রোজা আমার জন্য। সুতরাং তার প্রতিদান আমি নিজেই প্রদান করব।’- সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৪
এক. রোজা ছাড়া অন্যান্য সব আমলের সওয়াব বৃদ্ধির ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তা হল ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত। এটি সাধারণ নিয়ম। আল্লাহ তাআলা চাইলে বিশেষ ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও প্রদান করতে পারেন।
তবে সাধারণত সব আমলের সওয়াব এ নীতির মাধ্যমেই নির্ণিত হয়। কিন্তু রোজার বিষয়টি স্বতন্ত্র। কারণ এর সওয়াবের নির্ধারিত কোনো সীমারেখা নেই; বরং আল্লাহ তাআলা নিজে এর সওয়াব প্রদানের ঘোষণা প্রদান করেছেন। এর পরিমাণ যে কত হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
রোজার এত বড় ফযীলতের একটি বাহ্যিক কারণ এও হতে পারে যে, রোজা ধৈর্য্যের ফলস্বরূপ। আর ধৈর্যধারণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার সুসংবাদ হল-‘ধৈর্য্য ধারণকারীগণই অগণিত সওয়াবের অধিকারী হবে।’ -সূরা যুমার ১০
দুই. সকল ইবাদত আল্লাহর জন্য। রোজার বহুবিধ বিশেষত্বের কারণে শুধু তাকেই নিজের জন্য খাস করে নিয়েছেন এবং বলেছেন- ‘রোজা তো আমারই জন্য, তাই রোজার প্রতিদান তিনি নিজেই দান করবেন এবং বে-হিসাব দান করবেন বলে তিনি রোজাদারকে সুসংবাদ দান করেছেন। -লাতায়িফ ১৬৮-১৭০
হাদীস শরীফে রোজাদারের জন্য বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার ও প্রতিদানের কথা বিবৃত হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি হল :
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘রোজা ও কুরআন মজীদ কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ!আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে পূর্ণ বিরত রেখেছি। কাজেই তাকে ক্ষমা করে দিন এবং পুরস্কৃত করুন এবং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।
আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। কাজেই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কুবল করুন। অতঃপর তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৬৫৮৯; তবারানী-মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৫১৯
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের জন্য একটি ঢাল এবং দুর্গ।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৯৭২
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-‘জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি শাহী তোরণ আছে যা দিয়ে একমাত্র রোজাদারগণই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সে তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (‘আর যে ব্যক্তি সে রাইয়ান গেট দিয়ে প্রবেশ করবে সে আর কখনো পিপাসিত হবে না।’ সহীহ বুখারী ১/২৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫২
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে সওয়বের উদ্দেশ্যে রমজানের রোজা রাখে, আল্লাহ পাক তার জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০১
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-‘তিন ব্যক্তির দুআ ফেরত দেওয়া হয় না : রোজাদার ব্যক্তির ইফতারের সময়ের দুআ, ন্যায়পরায়ণ শাসকের দুআ ও মজলুমের দুআ। এ তিন ব্যক্তির দুআ আল্লাহ তাআলা মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন। এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। তখন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আমার ইযযত ও মহাসম্মানের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।’ -সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৩৪২৮
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-‘রোজাদার ব্যক্তির আনন্দ উপভোগের দুটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে। একটি ইফতারের সময়, অপরটি স্বীয় প্রভূর সাথে সাক্ষাতের সময়।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫১/১৬৪
রোজার কারণে মুখে যে দুর্গন্ধ হয় আল্লাহ তাআলা তারও মূল্যায়ন করেছেন কল্পনাতীতভাবে। অনাহারের কারণে সৃষ্ট দুর্গন্ধ তাঁর কাছে মিশকের চেয়েও অধিক সুঘ্রাণ বলে জানিয়েছেন আর ধন্য করেছেন তাঁর প্রেমে মত্ত রোজাদারদের।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘নিশ্চয় রোজাদারে মুখের (পানাহার বর্জনজনিত) গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধি অপেক্ষা উত্তম।’ -সহীহ বুখারী হাদীস, ১৯০৪
মন্তব্য করুন