রমজান মাস আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ একটি মাস। এই মাসে মানুষ সাওম পালন ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে অনেক সহজেই। এই মাসের প্রতিটি ভালো কাজের জন্য আল্লাহতাআলা বান্দাকে অনেক সওয়াব দেন।
রমজান মাসের প্রথম এবং মূল ইবাদত সাওম পালন বা রোজা রাখা। সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকতে হয়।
শুধু কী তাই, মেনে চলতে হয় আরও অনেক নিয়মকানুন। খুব সামান্য কারণে ভেঙে যেতে পারে আপনার রোজা। এজন্য রোজাদারকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
তবে রোজা রেখে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না এই নিয়ে অনেকে অনেক বিভ্রান্তি ছড়ান। তেমনি অনেকে বলেন, রোজা রেখে সুগন্ধি বা আতর ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে। আবার অনেকে বলেন এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
সুগন্ধি বা আতর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পছন্দের বিষয়গুলোর একটি। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন এবং কেউ সুগন্ধি হাদিয়া দিলে সেটি গ্রহণ করতেন। তিনি কখনো তা ফেরত দিতেন না।
আতর সবসময় ব্যবহার করা যায়। সাধারণ সময়ের মতো রমজান মাসেও আতর, পারফিউম ব্যবহার করা যাবে, এতে কোনো বাধা নেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে আতর ও পারফিউমে ধোঁয়ার মতো কিছু না থাকে অর্থাৎ পেটে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ থাকা যাবে না।
রোজা ভঙের কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে পেটে বা মস্তিষ্কে কোনো জিনিস প্রবেশ করা। আতর বা পারফিউমের ঘ্রাণ নেওয়ার কারণে সরাসরি তা শরীরে প্রবেশ করে না। তাই রোজা রেখে আতর, সুগন্ধি ও পারফিউম ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না।
মনে রাখতে হবে, আতর ব্যবহার করা তো সুন্নত; কিন্তু পারফিউমে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়। তাই পারফিউম ব্যবহার করার আগে কিছু জিনিস জানতে হবে। যেমন- খেজুর বা আঙুরের রস থেকে তৈরি অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় অপবিত্র। তাই তার ব্যবহার জায়েজ নেই। যদি এটি অন্য কোনো জিনিস থেকে তৈরি করা হয়, তাহলে তা পবিত্র।
রোজা রেখে চুল, দাড়ি ও নখ কাটা নিয়েও আছে অনেক বিভ্রান্তি। একদল বলেন, রোজা রেখে চুল, দাড়ি ও নখ কাটা যাবে না। কাটলে রোজা ভেঙে যাবে। আবার আরেক দল বলেন, রোজা রেখে চুল, দাড়ি ও নখ কাটলেও কোনো সমস্যা হবে না।
আসুন জেনে নেওয়া যাক রোজা অবস্থায় চুল, দাড়ি ও নখ কাটা যাবে কি না।
রোজা অবস্থায় নখ কাটাতে বা চুল কাটতে কোনো অসুবিধা নেই। এগুলোর সঙ্গে রোজার কোনো সম্পর্ক নেই। আর রোজা রেখে দাড়ি শেভ করলে রোজা ভাঙবে না। তবে রমজানের উদ্দেশ্য পূর্ণতা পাবে না।
রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হলো- আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য করা। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী চলা ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নত নিজের ব্যক্তিজীবনে নিয়ে আসা।
কিন্তু দাড়ি কাটা অর্থাৎ শেভ করার মাধ্যমে আমরা নবীর একটা সুন্নতের ওপর আঘাত করি। অথচ দাড়ি কামানোর মাধ্যমে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের বিপরীত কাজ করা মুমিন মুসলমানের জন্য উচিত নয়।
অবশ্য এতে রোজা ভেঙে যাবে না, বরং রোজা— রোজার জায়গা থেকে আদায় হয়ে যাবে। তবে রমজানের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণভাবে আদায় হচ্ছে না। মানে আল্লাহর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী নিজের জীবন সাজানোর বিষয়টি পূর্ণতা পাচ্ছে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩/৩৩; সুনানে কুবরা, বায়হাকি, হাদিস : ৮২৫৩; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৯৩১৯)
হাত-পায়ের নখ কাটা, চুল কাটা বা দাড়ি ছাঁটা বা কাটা অথবা উপড়ানো যাবে। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
আমরা অনেকেই সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে থাকি। রোজা রেখে টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলে রোজা ঠিক থাকে না ভেঙে যায়, এ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে।
আসুন জেনে নেই সে বিষয়ে-
ইসলামি গবেষকরা বলেছেন, টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলে রোজা ভাঙে না। কারণ, টুথপেস্ট তো কেউ খায় না। তবে ব্রাশ করার সময় সতর্ক থাকতে হবে যে পেস্ট পেটে চলে না যায়।
কেউ কেউ আবার বলেন, টুথপেস্ট দিয়ে ব্রাশ করলে রোজা মকরুহ হয়। কিন্তু রোজা ভেঙে যায়- এমন কথা কেউ বলেননি।
রমজান মাসে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে যা নিষেধ, তা না করার চেষ্টা করতে হবে। যেন তিনি খুশি হন। মাকরুহ হলেও আমাদের রমজান মাসে রোজা রেখে টুথপেস্ট বা দাঁতের মাজন দিয়ে দাঁত না মাজার চর্চা করতে হবে।
সব থেকে ভালো হয়, সেহরি খাওয়ার পর পেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা, ইফতারের পর দাঁত ব্রাশ করা। আর দিনের বেলা মিসওয়াক ব্যবহার করা।
রাসুল (সা.) মিসওয়াক ব্যবহার করতেন। তাই মিসওয়াক করা সুন্নত। হাদিসে আছে, মিসওয়াক করে নামাজ পড়লে তা উত্তম। রাসুল (সা.) প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আগে মিসওয়াক করতেন।
মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী বলেছেন, রোজা রেখে টুথপেস্ট বা মাজন ব্যবহার করা মাকরুহ। এতে স্বাদ রয়েছে। রোজা রেখে যে কোনো জিনিসের স্বাদ গ্রহণ করা মাকরুহ। তবে মিসওয়াক ব্যবহার করতে পারবেন, এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না।
আবার রোজা ভঙের কারণ হচ্ছে, স্বাভাবিক প্রবেশপথ দিয়ে পেটে বা মস্তিষ্কে কোনো জিনিস প্রবেশ করা। রোজা রেখে টুথ পেস্ট বা মাজন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। কারণ কোনো কারণে যদি একবার পেটের মধ্যে চলে যায় স্বাদযুক্ত এই জিনিস, সেক্ষেত্রে রোজা নষ্ট হবে।
রমজান মাসে সব বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বছর ঘুরে আসে রমজান মাস। সারা বছরের অনেক অভ্যাস এই রমজানে বাদ দিতে হয়। সেজন্য সঠিক পন্থায় সাওম পালনে অবশ্যই সচেতনতা জরুরি। নইলে আপনার সামান্য অমনোযোগ নষ্ট করে দিতে পারে সারা দিনের কষ্ট।
রোজায় শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ইনহেলার ব্যবহারকরীদের পড়তে হয় বাড়তি চিন্তায়। যাদের অনেকের ধারণা ইনহেলার ব্যবহারে রোজা ভেঙে যেতে পারে। তাই জানা প্রয়োজন রোজা রেখে ইনহেলার ব্যবহার করা যাবে কি না?
শ্বাসকষ্ট প্রতিরোধে ইনহেলার ব্যবহার হয়ে থাকে। বিশেষ পদ্ধতিতে মুখের ভেতরভাগে এ স্প্রে করা হয়। ফলে শ্বাসরুদ্ধ জায়গা প্রশস্ত হয়ে স্বস্তি পাওয়া যায়।
স্প্রেকালে ইনহেলার ভেতরে থাকা দেহবিশিষ্ট তরল ওষুধ বের হয়ে আসে। তাই মুখের ভেতরে স্প্রে করার কারণে রোজা ভেঙে যাবে। তাই বলা যায়, ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়। তাই ইনহেলার ব্যবহার করে থাকলে, পরে রোজার কাজা আদায় করে দিতে হবে।
এখন প্রশ্ন জাগে জরুরি অবস্থায় কী করবেন? রোজা না ভেঙেও ইনহেলার ব্যবহারে কষ্ট থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। এ জন্য মুখে স্প্রে করার পর না গিলে থুতু দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে রোজা ভাঙবে না। ফলে শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
অনেকেই মনে করেন, ইনহেলার ব্যবহার হয়ে থাকে জরুরি প্রয়োজনে, তাই এতে রোজা ভঙে যাবে না। যা সঠিক নয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, কেউ ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পড়লে অতি প্রয়োজনে কিছু খেয়ে ফেলে, তাহলেও খাওয়ার কারণে রোজা ভেঙে যাবে। সুতরাং ইনহেলার অতি প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও রোজা ভেঙে যাবে এবং পরে রোজার কাজা দিতে হবে।
মন্তব্য করুন