বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা আজ (১ আগস্ট)। সারাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পূর্ণিমাটি পালিত হয়েছে।
এ পূর্ণিমার বৌদ্ধদের বিশ্বে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং অতিপবিত্র। বৌদ্ধ দেশগুলোয় আজ থেকে ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস ব্রতের শুরু।
এ পূর্ণিমার আরও একটি বিশেষত্ব হলো, এই শুভ তিথিতেই রাজকুমার সিদ্ধার্থ রানি মহামায়ার গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ পরিভাষায় একে বলা হয় মহাভিনিষ্ক্রমণ। বুদ্ধত্ব লাভের পর এ দিবসেই তিনি তার অধীত নবলব্ধ ধর্ম ‘ধর্মচক্র প্রবর্তনসূত্র’ রূপে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের কাছে প্রথম প্রচার করেন সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে (বর্তমান উত্তরপ্রদেশের বানারসের সন্নিকটস্থ)।
আরও পড়ুন : রাশিফল অনুযায়ী আজকের দিন কেমন যাবে
সেদিন তার প্রচারিত ধর্মের মূল আবেদন ছিল-জগৎ দুঃখময়, জীবন অনিত্য, জগতের সব সংস্কার অনিত্য। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যুই শাশ্বত। এই দুঃখময় সংসার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ বা উপায় তৃষ্ণাক্ষয়, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার সাধনা এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ তথা আটটি বিশুদ্ধ পথে চলা।
এ পূর্ণিমার আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এ শুভ তিথিতেই ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তীর গণ্ডম্ব বৃক্ষমূলে প্রতিহার্য প্রদর্শন করেন এবং মাতৃদেবীকে দর্শন ও ধর্মদেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। আমরা জানি, রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্মের পরই রানি মহামায়ার মৃত্যু হয়েছিল।
এ কৃতজ্ঞতাবোধে তিনি তার প্রাপ্ত ধর্মজ্ঞান তার মাতৃদেবীকে বিতরণ তথা দর্শনের জন্যই স্বর্গে গিয়েছিলেন। রানি মহামায়ার মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠ বোন গৌতমীই পরবর্তীকালে রাজকুমার সিদ্ধার্থকে লালন-পালন করেন। এ জন্য সিদ্ধার্থের অপর নাম হয়েছিল গৌতম।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের অন্যতম সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গৌতম বুদ্ধ যেমন নিজ প্রচেষ্টায় জীবনের পূর্ণতা সাধন করে মহাবোধি বা আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং জগজ্জ্যোতি বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হন তেমনিভাবে পূর্ণ চন্দ্রের মতো নিজের জীবনকে ঋদ্ধ করাই প্রতিটি বৌদ্ধের প্রচেষ্টা। আষাঢ়ী পূর্ণিমার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধরা এই প্রচেষ্টার প্রতি তাদের অঙ্গীকার নবায়ন করে থাকে। শুধু সাধারণ বৌদ্ধ নয়, ভিক্ষুদের জন্যও আষাঢ়ী পূর্ণিমা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। বৌদ্ধরা এদিনটিকে সচরাচর শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা হিসেবে অভিহিত করে থাকে।
আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করেই যা গৌতম বুদ্ধের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। বর্ণিত আছে: এক আষাঢ়ে পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে মাতৃগর্ভে প্রবিষ্ট হয়েছিলেন। কপিলাবস্তু নগরে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা সাড়ম্বরে উদযাপন হতো। এক আষাঢ়ী পূর্ণিমায় রাজা শুদ্ধোধনের মহিষী রানি মহামায়া উপোমথ ব্রত গ্রহণ করলেন। সে রাত্রে রানি মহামায়া স্বপ্নমগ্না হয়ে দেখলেন যে চার দিক থেকে পাল দেবগণ এসে পালঙ্কসহ তাকে নিয়ে গেল হিমালয়ের পর্বতোপরি এক সমতল ভূমির ওপর। সেখানে মহামায়াকে সুউচ্চ এক মহাশাল বৃক্ষতলে রেখে দেবগণ সশ্রদ্ধ ভঙ্গিমায় এক পাশে অবস্থান দাঁড়িয়ে পড়ল। অতঃপর দেবগণের মহিষীরা এসে মায়াদেবীকে হিমালয়ের মানস সরোবরে স্নান করিয়ে দিব্য বসন-ভূষণ ও মাল্যগন্ধে সাজিয়ে দিলেন। অনতিদূরে একটি শুভ্র রজতপর্বতে ছিল একটি সুবর্ণ প্রাসাদ। চারদিক থেকে পাল দেবগণ মহারাজা পুনঃপালঙ্কসহ দেবীকে সেই প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে দিব্যশয্যায় শুইয়ে দিল। তখন অদূরবর্তী সুবর্ণ পর্বত থেকে এক শ্বেতহসত্মী নেমে এসে উত্তরদিক থেকে অগ্রসর হয়ে রজতপর্বতে আরোহণ করলেন। রজত শুভ্রশু একটি শ্বেতপদ্মের রূপ পরিগ্রহ করে কবীবর মহাক্রোষ্ণনাদে সুবর্ণ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে তিনবার মাতৃশয্যা প্রদক্ষিণপূর্বক মায়ের শরীরের দক্ষিণ পার্শ্বভেদ করে মাতৃজঠরে প্রবেশ করলেন। পর দিন প্রত্যুষে রানি মহামায়া রাজা শুদ্ধোধনকে স্বপ্ন বৃত্তান্ত অবহিত করলেন। কালবিলম্ব না করে রাজা শুদ্ধোধনকে ৬৪ জন জ্যোতির্বিদ এনে স্বপ্নের ফল জানতে চাইলেন। তারা বললেন, মহারাজ চিন্তা করবেন না, আপনার মহিষী সন্তানসম্ভবা। তিনি এমন এক পুত্ররত্ন লাভ করবেন যার ফলে বসুন্ধরা ধন্য হবে।
আরও পড়ুন : ১ আগস্ট : নামাজের সময়সূচি
আষাঢ় মাসের আরেক পূর্ণিমা রাতে মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে তিনি স্ত্রী-পুত্র-রাজ্য সব মায়া ছেড়ে গৃহত্যাগ করেন। গয়ার বোধিদ্রুম মূলে একাধারে ছয় বছর কঠোর তপস্যার পর পরম জ্ঞান ‘মহাবোধি’ লাভ করেন। নবলব্ধ ধর্ম প্রকাশের উদ্দেশ্যে তিনি আরেক আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে সারানাথের ঈষিপত্তন মৃগদাবে আগমন করেন। বুদ্ধ এক আষাঢ়ী পূর্ণিমার রাতে ঈষিপত্তন মৃগদাবে সেই পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদেরকে প্রথম ধর্মদেশনা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ দেশনা করলেন। কৌণ্ডণ্য, বপ্প, ভদ্দীয়, মহানাম ও অশ্বজিত-এ পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের কাছে তার নবলব্ধ সদ্ধর্মকে প্রকাশ করেন। পরে আরো এক পূর্ণিমা তিথিতে তিনি মাতৃদেবীকে সদ্ধর্ম দেশনার জন্য স্বর্গে গমন করেন। অনুরূপ পূর্ণিমার তিথিতেই বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান গ্রহণ করে।
ভিক্ষুদের অন্যতম বাৎসরিক আচার বর্ষাবাস শুরু হয় আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে, শেষ হয় আশ্বিনী পূর্ণিমাতে। বর্ষাকালে সিক্ত বসনে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করা, বস্ত্র তুলে চলাফেরা করা মানায় না বিধায় যেখানে-সেখানে ভিক্ষুদের বাস না করে গৌতম বুদ্ধ বর্ষাবাস গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। বৌদ্ধ বিনয় মতে যে ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করেন তিনিই কঠিন চীবর লাভের যোগ্য হন। বর্ষাবাস যাপন ব্যতিকে চীবর লাভ করা যায় না। যে বিহারের ভিক্ষু বর্ষাবাস যাপন করবে না, সেই বিহারে কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানও করা যাবে না। বর্ষাবাসের জন্য ভিক্ষুরা সাংঘারা, বিহার ও সাধনাকেন্দ্র বেছে নেয়।
মানবজীবনে এসব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ব্রত, অধিষ্ঠান সবই মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য এবং মানবজীবনের পরিপূর্ণতা ও মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য। আজ দেশের বিভিন্ন নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমরা এর সমাধান হিসেবে শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা আমাদের সবার চেতনায় এই বোধ ও জ্ঞান তৈরি করুক-এটাই আজ আমাদের প্রার্থনা। ‘সব্বে সত্তা সুখীতা হোন্তু’-জগতের সব জীব সুখী হোক।
মন্তব্য করুন