শৈলেন কুমার দাশ
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৫, ১০:৩১ এএম
অনলাইন সংস্করণ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করল বিএসসি 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করল বিএসসি । ছবি : কালবেলা
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করল বিএসসি । ছবি : কালবেলা

কানাডার কেলগরিতে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর আন্তরিকতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) নগরীর রেনফ্রিউ কমিউনিটি হলে এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরি (বিএসসি)।

আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ‍্যে ছিলেন নগরীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত কমিউনিটি সদস‍্যরা, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশার নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর। যারা এসেছিলেন তারা হলেন কেলগেরি নগরীতে বসবাসরত ১০টি দেশের কমিউনিটির সদস‍্যরা। হরেক রঙের পোশাকে সুসজ্জিত আগত অতিথিদের সমাগমে কমিউনিটি সেন্টারটি বর্ণময় হয়ে উঠে। প্রায় তিন শতাধিক মানুষের আগমনে এক মুগ্ধময় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক মিলন ভূমিতে পরিণত হয় রেনফ্রিউ কমিউনিটি হল।

প্রথমে নগরীর বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা সুসজ্জিত শহীদ বেদিতে পরম শ্রদ্ধায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় বেজে উঠে গভীর আবেদনময় সেই বিখ‍্যাত সুরের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি। বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন‍্যান দেশের ভাষায়ও গানটি সুর ছড়িয়ে যেতে থাকে পরম মমতায়। বিএসসি এর একজন ডিরেক্টর হাসান আব্বাস এর সুনিপুণ হাতের স্পর্শে তৈরি ও সাজানো শহীদ বেদি বর্ণিল পুষ্পস্তবকে আরও আকর্ষণীয় ও বর্ণময় হয়ে উঠে।

অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হয় কানাডা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ‍্য দিয়ে। এ সময় হল রুমে সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। পরক্ষণেই সুকণ্ঠী সঞ্চালিকা নাহিদ চৌধুরী কনক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করেন।

এরপর অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক বিএসসি এর ডিরেক্টর ওবায়দুর রহমানকে তার স্বাগত বক্তব্য রাখার জন‍্য অনুরোধ করেন সঞ্চালিকা। মি. রহমান প্রথমেই তার বক্তব‍্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে ভাষার জন‍্য বাংলা মায়ের যেসব দামাল সন্তানেরা আত্মাহুতি দেন তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। তারপর অতিথিদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান অনুষ্ঠানে আন্তরিক অংশগ্রহণের জন‍্য।

অতিথিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আজ এই অনুষ্ঠানে এসে আমাদেরকে আলোকিত করেছেন। আপনাদের উপস্থিতিতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি। আপনাদের মাধ‍্যমে আজ আমরা পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে সমৃদ্ধ হব। তিনি তার বক্তব্যে বহুভাষিক বৈচিত্র্য এবং বহু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।

এরপর সঞ্চালিকা অনুষ্ঠানের অতিথি কেলগেরি ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজ ধালিওয়ালকে বক্তব‍্য রাখতে অনুরোধ করেন। তিনি তার বক্তব‍্যে বাংলাদেশের ভাষাশহীদের স্মরণ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্ববাসীকে উপহার দেওয়ার জন‍্য বাংলাদেশের অবদানের প্রতি সম্মান জানান। তিনি কমিউনিটির উন্নয়নে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

এরপর পযাক্রমে আফাগানিস্তান, বাংলাদেশ, কানাডা, চায়না, ইরিথ্রিয়া, ইন্ডিয়া, লেবানন, নেপাল, পেলেস্টাইন, রাশিয়া ও থাইল‍্যান্ড এর সাংস্কৃতিক গ্রুপগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করেন।

আফগানিস্তান তাদের ঐতিহ্যবাহী আফগান পাঞ্জাবি পোশাকে সজ্জিত একদল যুবক তাদের বিখ‍্যাত ছন্দময় নৃত‍্য আফগান সংগীতের তালে তালে উপস্থাপন করে। আফগান রমণীর সুন্দর সাজে অর্থাৎ মাথায় লাল দোপাট্টা এবং লাল কালোর সংমিশ্রণে সালোয়ার কামিজে সুসজ্জিতা হয়ে মঞ্চে আসেন এক সুদর্শনা। সঙ্গে সহপারফরমার। আবৃত্তি করেন ১৩ শতকের বিখ‍্যাত পারসিয়ান কবি জালাল আল-দিন মোহাম্মদ রুমির কবিতা থেকে অংশবিশেষ।

কানাডিয়ান নেটিভ সোসাইটির প্রাণবন্ত সদস‍্যা অপরূপ সুরে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করেন নেটিভ সংগীতের এক বিচিত্র সুরের সুমধুর মূর্ছনা, যা ক্ষণকালের জন‍্য শ্রোতাদের নিয়ে যায় সেই নির্জন পাহাড়ি জীবনের লীলাভূমে। যেখানে প্রকৃতি আর জীবন মিশে ছিল একাকার হয়ে।

চীনা দলটি বিভক্ত ছিল দুটি অংশে। বসন্তের পলাশ রাঙ্গা রঙের আবরণে সেজেছিল চৌদ্দজন নৃত‍্যশিল্পী। যাদের মধ‍্যে তিনজন নারী ছিলেন সত্তর বছরের কাছাকাছি বয়স। অসম্ভব গতি, নৃত‍্যকৌশল আর তাল সম্পন্ন নৃত‍্যে যেন বার বার বসন্তের অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হচ্ছিল পুরো হলরুম। মন্ত্রমুগ্ধের মত গোটা হল হারিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন‍্য এই নৃত‍্যের গহন গভীরে। অন‍্যদলে দুই কিশোরী বোন চায়নিস সুরে সাজিয়ে তোলে আলোকোজ্জল হল রুমের পরিবেশকে।

ইরিথ্রিয়ার জাতীয় পোশাকে সুসজ্জিতা ইরিথ্রিয়ান তিনকন‍্যা সুরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কিছুক্ষণ। মানবজীবন ও সভ‍্যতার বিকাশে ভাষা বৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তার ওপর বাণীর মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ইন্ডিয়ান অংশগ্রহণকারী।

লেবাবনন ও পেলেস্টাইন এর পোষাকে সজ্জিত দুই শিল্পীর একজন গেয়েছেন সেই অঞ্চলের শক্তিশালী সুরের গান। আর অপরজন বেহালায় তুলেছেন প্রাণকাড়া সুর।

নেপালী সুন্দরী কন‍্যার সেই পাহাড়ঘেরা শ‍্যামলভূমির ছন্দময় নৃত‍্যে আর ছোট্ট কন‍্যার সংগীত পরিবেশন মন কেড়ে নেয় সবার। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ যেন কন‍্যার নৃত‍্যে এসে দাঁড়ায় পথ আগলে কানাডার সুসজ্জিত এই হলরুমে।

ফিলিপাইনের ১২ জন কন‍্যার সুসজ্জিত নৃত‍্যের পোষাকে আগাগোড়া সাজানো দলটি আবার চায়নিস নৃত‍্যের মত শক্তিশালী নৃত‍্য পরিবেশন করে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। মুহূর্তের তরে যেন সবাই তাদের নৃত‍্যের তালে তালে বারবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছিল। অর্থাৎ তাঁদের নৃত‍্যশৈলী দর্শকদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে।

রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিতা রাজকুমারীর অবয়বে মঞ্চে এসে দাঁড়ায় উঁচু ফিগারের সুন্দরী রাশিয়ান কন‍্যা। রাশিয়ান কথার বর্ণময়তায় ও কবিতার ছন্দময়তায় সাজে তাঁর জন‍্য নির্ধারিত সময়।

থাই সংগীতের সুরেলা মূর্ছনায় আবার সেজে উঠে মঞ্চ আঙিনা। তিনজনের দলে অভিজ্ঞ দলনেতার সঙ্গে সুরের আলপনা সাজিয়েছেন সুরেলা কণ্ঠে দুই থাই কন‍্যা।

পরিশেষে বাংলাদেশ দল মঞ্চে আসেন। তারা তাদের গিটার, বেহালা, হারমনিয়ামের সুরকে সাজিয়ে তুলে গান ও কবিতার ছন্দে। যা ছিল মূলত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কেন্দ্র করে। মায়ের প্রতীক্ষার করুণ আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁদের আয়োজনের পরতে পরতে।

সব দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একই মঞ্চে আয়োজনের মধ‍্য দিয়ে এই আসরটি যেন একটি বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের চারণভূমিতে পরিণত হয়। সবার মনে এক বিনিসুতোর মালা যেন জড়িয়ে যায় অপূর্ব স্নিগ্ধতায়।

এ বছরটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন‍্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫তম বার্ষিকী। কারণ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা বা UNESCO ১৯৯৯ সালে আমাদের মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ বছর এই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সংস্থাটি বিভিন্ন ক্রোড়পত্র, পোস্টার এবং থিম বা ভাবনা প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এ বছরের UNESCO এর থিম হচ্ছে ‘ভাষাকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের শক্তিশালী উপায় হিসাবে বিবেচনা করা’। সত‍্যি অতি সুন্দর থিম প্রকাশ করেছে UNESCO। সেজন‍্য UNESCO কে প্রাণঢালা অভিনন্দন। কারণ কোন উন্নয়ন যখন মানুষের ভাষা বা সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিফলিত হয় তখন মানুষ এর অংশীদারত্ব অনুভব করে। অর্থাৎ মানুষের জীবন, জীবিকা, চিন্তা, অনুরাগ, অনুভূতি তথা ভাষা ও সংস্কৃতি যদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলন ঘটে তখন সে উন্নয়ন স্থায়িত্বশীল হয়।

UNESCO থিম এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে কানাডার বাংলাদেশি সোসাইটি অব কেলগেরি (বিএসসি) তার থিম এবং পোস্টার প্রকাশ করেছে। বিএসসি এর থিম হচ্ছে ‘ভাষা হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার, বিশ্বের সব মানুষের এ অধিকার সুরক্ষিত হোক।’ সেই সঙ্গে বিশেষ পোস্টারে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে ‘ভাষা হোক শান্তি ও সম্প্রীতির বাহক, হোক যুদ্ধ বন্ধের শান্ত বহিঃপ্রকাশ।’

এই সুন্দর অনুষ্ঠানটির সফল বাস্তবায়নের জন্য বিএসসির ২৪ জন ডিরেক্টর কাজ করেছেন। বিশেষ করে গত একমাস ব্যাপী যে সমস্ত ডিরেক্টররা নিরলস কাজ করেছেন তারা হলেন সায়মা মাওলা, মো. জাহিদুল হক, আনিসুর রহমান, মো. আলী আশরাফ লস্কর, আহমেদ আল-ইমরান নিক্কন, হাসান আব্বাস, মো. জামাল উদ্দিন, খলিলুর রহমান শম্পা, সজ্জাদ বিপুল, হাবিব ইসলাম হিরণ, ওবায়দুর রহমান ও শৈলেন কুমার দাশ। সেইসাথে যন্ত্রকৌশল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব‍্যবস্থাপনায় গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন বিএসসি ডিরেক্টর মামমুদুল হক খোকন ও সাজ্জাদ বিপুল।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উলফা ক্যাম্প নিয়ে ভারতীয় সংবাদপত্রের খবর সত্য নয়

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ইংল্যান্ডের পরাজয়ে বদলে যাবে বাংলাদেশের ভাগ্য!

রমজান ও ঈদ উপলক্ষে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিবির অ্যাকশন শুরু

গুলির ভয় উপেক্ষা করে আল-আকসা মসজিদে তারাবির নামাজ আদায়

চাঁদ দেখা কমিটি বৈঠকে বসছে সন্ধ্যায়  

রোজার নিয়ত করতে ভুলে গেলে করণীয় কী

‘পুলিশ আমাদের অনুমতি ছাড়া ধরলে থানা ঘেরাও করা হবে’

ট্রাম্প-জেলেনস্কির তর্কে ভীত ইউক্রেনীয়রা

সৌদির সঙ্গে মিলিয়ে রোজা রেখেছেন শরীয়তপুরের হাজারো মুসল্লি

ঢাকা মহানগর হেফাজতের ইফতার মাহফিল ১২ মার্চ

১০

আবারও বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় ময়মনসিংহের অধ্যাপক সাইদুর

১১

পিরোজপুরে ১০ গ্রামে রোজা শুরু

১২

গাজীপুরে ছিনতাইচেষ্টা, সেনাবাহিনীর হাতে আটক ৩

১৩

যা হয়েছে, সেটা ছিল একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল : হাসনাত

১৪

অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ, দুই পুত্রসহ সাবেক এমপির বিরুদ্ধে মামলা

১৫

ব্রাজিলের জার্সিতে ফিরছেন নেইমার!

১৬

ফের ২ জেলায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস

১৭

বাসরঘর থেকে গ্রেপ্তার যুবক

১৮

ছবি আঁকতে পারা ভেড়াটি কারা নিয়ে গেল?

১৯

চাঁদপুরে অর্ধশত গ্রামে রোজা শুরু

২০
X