আমি হেটিসবার্গে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপির স্কুল অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছি। এ শহরটি যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এবং ফরেস্ট কাউন্টির কাউন্টি সিট। হেটিসবার্গ, মিসিসিপির দক্ষিণ অংশে অবস্থিত, একটি প্রাণবন্ত শহর যা ‘হাব সিটি’ নামে পরিচিত, পাইন বেল্ট অঞ্চলের মধ্যে এর কেন্দ্রীয় অবস্থানের কারণে।
এটি সাউদার্ন মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসস্থল, যা শহরের পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, প্রাণবন্ত উচ্ছল এবং ক্রীড়ায় অবদান রাখে। এ শহরটি ঐতিহাসিক স্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং একটি বিকাশমান শিল্পের একটি মিশ্রণ, যা এখানে বসবাস ও ভ্রমণের জন্য একটি অনন্য স্থান বানিয়ে তুলেছে। হেটিসবার্গ মেট্রোপলিটন স্ট্যাটিস্টিক্যাল এরিয়ার প্রধান শহর, যা কভিংটন, ফরেস্ট, লামার এবং পেরি কাউন্টি নিয়ে গঠিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬৪ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এ শহরটিকে ‘পাইন বেল্টের কেন্দ্রবিন্দু’ বলা হয়।
হেটিসবার্গ সাধারণত মৃদু আবহাওয়ার জন্য পরিচিত এবং এখানে তুষারপাত খুবই বিরল ঘটনা। তুষারপাতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো : ১৮৯৫ ফেব্রুয়ারি মাসে ৬.৩ ইঞ্চি তুষারপাত রেকর্ড করা হয়। এরপর, ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৭ ইঞ্চি তুষারপাত, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ৫ ইঞ্চি তুষারপাত। আর সর্বশেষ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ৬ ইঞ্চি তুষারপাত রেকর্ড করা হয়। আর এখন ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস চলছে, এরই মাঝে শুভ্র তুষারপাতে আমিও প্রথমবারের মতো এ বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে গেলাম।
তুষারঝড়ের পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি
ইউএস ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস জানুয়ারির ২১ তারিখকে উইন্টার স্টর্ম ওয়াচ জারি করেছিল। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, তুষারপাতের সম্ভাবনা ৭৫% এবং ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত তুষার জমতে পারে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২১ জানুয়ারি মঙ্গলবার ও পরদিন বুধবারের জন্য সমস্ত ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে। ক্লাস ও গবেষণা কার্যক্রম স্থগিত করা হয় এবং জরুরি তথ্যের জন্য Eagle Alert এবং Emergency.USM.edu প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এছাড়াও, হেটিসবার্গ সিটি গভর্নমেন্ট থেকে জানানো হয়, তুষারপাতের কারণে রাস্তায় যাতায়াত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ব্লাক আইস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনায় মঙ্গল এবং বুধবার সকালে রাস্তায় বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় খাবার ও উষ্ণ পোশাক সংগ্রহ করতে বলা হয়। ৩৬১ স্টর্ম শেল্টার খোলা থাকবে।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বারবার সতর্কবার্তা পাচ্ছিলাম। এমন আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ সবার বাসায় সতর্কতামূলক লিফলেট পাঠায়। সেখানে তারা কিছু পূর্বপ্রস্তুতির কথা বলে ও পরবর্তীতে করণীয় বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ উপলক্ষে দুই দিনের জন্য ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করেছিল।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে আগেই জানানো হচ্ছিল এবং আমাদের সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক কমিউনিটি গ্রুপ ‘iFriends’-এর প্রতিষ্ঠাতা মিস ক্যাথি র্যান্ডি পোপ ফেসবুকে তুষারপাত নিয়ে পোস্ট দিচ্ছিলেন। আমি বারবার গুগল ওয়েদার চেক করছিলাম এবং অপেক্ষা করছিলাম কখন তুষারপাত শুরু হবে।
আমি এবং আমার অ্যাপার্টমেন্ট পার্টনার সাদমান সাকিব (সাইকোলজির পিএইচডি শিক্ষার্থী) এ তুষারঝড় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিই। বাংলাদেশ থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে, যেখানে কখনো তুষারপাত হয় না, তুষার দেখার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের ছিল। যেদিন থেকে শোনা গিয়েছিল, হেটিসবার্গে তুষারপাত হবে, আর এ খবরে আমি দারুণ রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
তুষারপাতের শুরু
মঙ্গলবার খুব ভোরেই অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে ফোনটি হাতে নিয়ে ওয়েদার আপডেট দেখি- কখন তুষারপাত হবে। দেখলাম সকাল ৯টায় শুরু হবে, ৩০ শতাংশ পড়বে এবং দশটা-এগারোটায় ৭০ শতাংশ পড়বে। এরপর ফজরের নামাজ পরে ল্যাপটপ খুলে বসি।
আমি প্রতিদিন সকালে বাংলাদেশের খবরাখবর নেওয়ার জন্য দেশের সংবাদপত্র অনলাইনভার্সনে চোখ বুলাই। এরপর, আমার পরিবার যেহেতু দেশে থাকে তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলি। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর আবার গুগল ওয়েদারে আবহাওয়ার আপডেট চেক করছিলাম। দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দেখতে লাগলাম কি অবস্থা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে- যেন এখনই বৃষ্টি নেমে আসবে। সকালের নাস্তা শেষ করতে করতে ৯টা বেজে গেল।
আবার দরজা খুলে বাইরে গেলাম- তখন হালকা হালকা তুষারপাত শুরু হচ্ছিল, যা খালি চোখে বোঝা যাচ্ছিল না। তবে ১০টার দিক থেকে প্রকৃতি যেন সাদা চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে শুরু করল। শুভ্র তুষার ঝুমঝুম বৃষ্টির মতো ঝরছিল। এরপর টানা তুষারপাত হলো দুপুর ২টা পর্যন্ত।
ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা
চারপাশে শুভ্রতুষার পড়ার দৃশ্য দেখে মন ভরে যাচ্ছিল। আমি একটি কালো হুডি পরে ছিলাম, ফ্রিজিং ঠান্ডায় যদিও সেটি যথেষ্ট ছিল না। আমাদের ব্লেইনউড অ্যাপার্টমেন্টের আশপাশের প্রতিবেশী, যাদের মধ্যে বাংলাদেশি আকারাম ও তুরান এবং ব্রাজিলের দুই বন্ধু মার্কোস এবং তার স্ত্রী আমান্দাও ছিল। এ ছাড়া কিছু পরিবার তাদের ছোট বাচ্চা ও পোষা কুকুরকেও নিয়ে এসেছিল তুষার উপভোগ করতে। সবাই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে নেমে নিচে তুষারপাতের আনন্দে ছবি তুলছিল এবং ভিডিও করছিল। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম।
এরপর আমার অ্যাপার্টমেন্টের সাদমান প্রস্তাব দিল ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য। আমিও প্রস্তাবটি লুফে নিলাম। ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখলাম, ইতোমধ্যে সেখানে অনেক শিক্ষার্থী তুষার উপভোগ করতে এসেছে। কেউ ছবি তুলছে, শুভ্র তুষারের ওপর গড়াগড়ি করছে, কেউ তুষার দিয়ে স্নোম্যান বানাচ্ছে, কেউ তুষার দিয়ে বল বানিয়ে খেলছে। আমরাও এ আনন্দের অংশ হয়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ে গেলাম। এটি আইকনিক ডোম, যা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচিতিকরণ করে সবার কাছে। এ ভবনের চারপাশে সাদা তুষারে ঢাকা ছিল। দৃশ্যটি যেন এক স্বপ্নের মতো লাগছিল। আমি মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে বেশ কিছু ছবি তুললাম। দলবেঁধে শিক্ষার্থীরাও ঘুরে ঘুরে তুষারপাত উপভোগ করছিল। বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের তুষারপাত উপভোগের উচ্ছ্বাস- এক অন্য রকম পরিবেশ তৈরি করে।
ক্যাম্পাস ও আশপাশের পরিবেশ
আগেই বলেছিলাম আমি যেহেতু নাতিশীতোষ্ণ এলাকার মানুষ। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিলাম। আর সেজন্য সাদমানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে ফিরছিলাম, পথিমধ্যে ব্রাজিলের কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আবার দেখা হলো। আমরা সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুললাম এবং অনেক মজা করলাম। এরপর শ্রীলঙ্কান বন্ধু নিপুন ও তার সহধর্মিণী ইরেশাসহ কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো। এর মধ্যে দুজন নেপালীও ছিল। ঠান্ডায় আমরা যেন জমে যাচ্ছিলাম।
আমরা সবাই মিলে জন্সন সায়েন্স টাওয়ারের ভেতর ঢুকলাম। এটি ক্যাম্পাসের সবচেয়ে উচু দশতলা বিল্ডিং। নয় তলাতে ইরেশা ও আনুশকার ল্যাব, সেখানে কফির ব্যবস্থা ছিল। আনুশকা কফি তৈরি করে গরম গরম কফি পরিবেশন করল। ঠান্ডায় উষ্ণ কফি যেন শরীর ও মনে আরাম এনে দিল।
দশতলা জন্সন সায়েন্স টাওয়ার থেকে পুরো ক্যাম্পাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাদা তুষারের আস্তরণে ঢাকা এলাকা যেন ছবির মতো লাগছিল। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্নজনের তুষারপাত নিয়ে প্রোফাইল চেঞ্জ, কাভার ফটো, পোস্ট দেখে বুঝতে পারলাম, এ দিনটি শুধু আমার জন্য নয়, সবার কাছেই বিশেষ হয়ে থাকবে।
পরিশেষে
বাংলাদেশ থেকে আসা একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ তুষারময় দিনটি আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির এমন উপহার আমি আগে কখনো পাইনি। শুধু তুষারের সৌন্দর্য নয়, এ দিনটি ছিল নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করার এবং নতুন সংস্কৃতি উপলব্ধির দিন। হেটিসবার্গের এ তুষারময় দিনটি আমার হৃদয়ে স্থায়ী হয়ে থাকবে। এটি ছিল এমন একটি দিন, যা শুধু স্মৃতিতে নয়, বরং আমার জীবনের গল্পের একটি বিশেষ অধ্যায় হয়ে থাকবে।
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (কেইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন মিসিসিপির শিক্ষার্থী।
মন্তব্য করুন