জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান এবং বন ও পরিবেশ বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আলোচনা শেষে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন- আমরা নির্বাচনে যাব কিনা, বিএনপি না এলেও যাব কিনা; জবাবে সেদিন বলেছিলাম- আমরা বিপ্লবীও নই, বিদ্রোহীও নই, সন্ত্রাসীও নই; বন্দুকের নলের গোড়ায় ক্ষমতা-এটা আমরা জানি না; আমাদের অবস্থান নির্বাচনের পক্ষে। তবে, এবার নির্বাচন প্রশ্নে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে।
আজ শনিবার রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ন ট্রেড সেন্টারে জেপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সভায় উদ্বোধনী পর্বে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, রাজাকার-আলবদর-আল শাম্সসহ স্বাধীনতা বিরোধীরা এখন ক্ষমতাসীন দলে অনুপ্রবেশ করেছে। শুধু দলে অনুপ্রবেশই করেনি, ওরা একেবারে নেতৃত্বেই জায়গা করে নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ওরা এখন আমাদেরকেই আক্রমণ করে। শুধু আমাদেরকেই নয়, অনুপ্রবেশকারী স্বাধীনতা বিরোধীরা আওয়ামী লীগকেও খেয়ে ফেলছে। প্রয়াত সাংবাদিক-কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী মৃত্যুর আগে একাধিক কলামে লিখে গেছেন- খোদ সরকারপ্রধানের চারপাশে এদের অবস্থান। অতএব, বাঁচতে হলে আমাদের সাবধান থাকতে হবে, নইলে প্রতিরোধ করতে হবে।
তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলে স্বাধীনতাবিরোধীরা অনুপ্রবেশ করে বড় বড় কথা বলছে, আস্ফালন করছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বও বলছে- স্বাধীনতাবিরোধীরা দলে অনুপ্রবেশ করেছে, সকল অপকর্মের মূলে এরা, এদের ছাড় নেই। পুলিশ-বিজিবি না থাকলে এই অনুপ্রবেশকারীরা ভয়ে ঘর থেকেও বের হতে পারার কথা নয়। সেজন্য এখন আমাদের (জেপিকে) পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে। কেউ হয়তো বলতে পারে- তাতে কী আসে যায়। আমরা বলব- আসে যায়।
জেপি চেয়ারম্যান বলেন, একসময় ছাত্রদল করা, রাজাকারের পোষ্য, অনুপ্রবেশকারীরা এখন বড় নেতা বনেছে। আন্দোলন নয়, ক্ষমতা নয়; মান-সম্মান রক্ষায় এবং অস্তিত্বের জন্য এখন আমাদেরকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এমতাবস্থায়, নির্বাচন সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে হবে, ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের ভাবতে হবে। এমনও হতে পারে-নির্বাচনে গেলামই না। হার-জিত আছে, থাকবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সেটা হতে পারে, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হবে না।
তিনি বলেন, দেশে এখন নির্বাচন হলেও যারা যাবে না-তাদের অন্য মতলব রয়েছে। আমাদের কোনো মতলব নেই। গেলেও মার দেবে, না গেলেও মার দেবে। মান-সম্মানের প্রশ্ন হয়ে গেছে। রাজাকারের ছেলেদের কী দুঃসাহস! কী আশ্চর্য! ঘরের মধ্যেও আমাদেরকে আক্রমণ করছে! আমাদের কথা পরিস্কার- হারানোর কিছু নেই, চাওয়া-পাওয়ারও কিছু নেই। কারও কাছে কিছু চাইনি, আগামীতেও চাইবো না। আমাদের দল ছোট হতে পারে, হয়তো আরো ছোট হবে। ছোটকে আরো ছোট হবার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নির্বাচন কী করে হয়-আমরা জানি। প্রশাসন, বিচার-বিভাগ সব এক হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগেরও হয়তো ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন নেই; কিন্তু ওদের দরকার। এই ফর্মুলা কে আবিষ্কার করেছে?
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন- জেপির লক্ষ্য আছে, নীতি-আদর্শ আছে। দেশে গণতন্ত্র থাকুক তা আমরা চাই। তবে এই গণতন্ত্র থাকার জন্য যেই ঐক্য দরকার, সেটা নেই। দলীয় নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সবাইকে অন্যভাবে ভাবতে হবে। দেশে আইনের শাসন, সুশাসন, গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার জন্য নয়; নিজেদের মান-সম্মানের জন্য।
বক্তব্যের শুরুতে জোট-রাজনীতির প্রসঙ্গে জেপি চেয়ারম্যান বলেন, সেই পাকিস্তান আমল থেকেই জোটের ইতিহাস হতাশাজনক। প্রথম জোট হলো যুক্তফ্রন্ট। অল্পদিনের মধ্যেই সেখান থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নাম নেই, হয়ে গেল হক-ভাসানীর জোট। ৬ দফা দেওয়া হলো, পরে সেটা হয়ে গেল ১১ দফা। কীভাবে হলো, জানি না। বলা হলো- আওয়ামী লীগের পক্ষে এককভাবে ৬ দফা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এজন্য ১১ দফা করতে হবে। জোটবদ্ধ ছাড়া নাকি আন্দোলন ও নির্বাচন হয় না, কিন্তু ফলাফল শূন্য। একইভাবে এখন ১৪ দলের শরিকদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনলে মনে হয় তারা তাদের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত। নির্বাচন আসলেই মনে প্রশ্ন জাগে- কয়টা আসন দিবে। কে জিজ্ঞাস করে? কেউ জিজ্ঞাসা করে না। নিজেরাই উষ্মা প্রকাশ করে। ঐক্যে যারা বড় থাকে তারা অন্যদের পাত্তাই দেয় না; বলে- আসছে কেন, থাকতে হয় তাই থাকে। তাদের বাজারটা বড়, সেজন্য তারা অন্যদের রাখে।
তিনি বলেন, সেদিন দেখলাম জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব বললেন- কিছুই পাইনি, মাঝখানে আমাদের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার পথে। না সরকারি দল, না বিরোধীদল; সরকারি জোটে থাকলেও বিরোধীদলের মতো মার খেতে হয়। কাজেই, সেই ’৫৪ সাল থেকে মানুষ অদ্যাবধি বিভ্রান্তির মধ্যেই রয়েছেন।
সম্প্রতি একটি পৌরসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ ইঙ্গিত করে জেপি চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচন কমিশন নিজেরাই বললো- আগের রাতেই ভোটকেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার তার কেটে ফেলা হয়েছে। কই, পরে কী হলো! কমিশন নিজেই একজনকে চিিহ্নত করলো, আইনে তার দুই বছর জেল হওয়ার কথা। কমিশন এব্যাপারে মন্ত্রণালয়কে চিঠিও লিখলো। তারপর কী হলো?
সভায় জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাদেক সিদ্দিকী, আবদুর রহিম, সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ, রুহুল আমিন, মফিজুল হক বেবু, আজিজ বাঙ্গাল, নাজমুন্নাহার বেবী ও মোহাম্মদ আলী মিয়া; ভাইস-চেয়ারম্যান মীর হারুন অর রশীদ, মোহাম্মদ হোসেন রেণু, ইফতেখার লিমন ও ফতেহ আলী টিপু; কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব ও জাতীয় যুব সংহতির সভাপতি এনামুল ইসলাম রুবেল, যুগ্ম-মহাসচিব ও দপ্তর সম্পাদক এম সালাহউদ্দিন আহমেদ; কেএম মুজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম তপন ও হুমায়ুন কবির তালুকদার রাজু, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল খায়ের সিদ্দিকী আবু, যুগ্ম-প্রচার সম্পাদক জীবন কৃষ্ণ বৈরাগী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভার শুরুতে দলের প্রয়াত নেতাদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সভায় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জেপি।