নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সংস্কার কমিশনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি)।
সোমবার (২১ এপ্রিল) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানান দলের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
বিবৃতিতে তারা বলেন, গত ১৯ এপ্রিল শনিবার ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সরকারি সূত্র থেকে আমরা যতটুকু জানতে-বুঝতে পেরেছি তা হলো-
১ ) সংস্কার কমিশন ১৫টি বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে।
২ ) এতে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে।
৩ ) সুপারিশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ক) কিছু সুপারিশ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করে যেতে পারবে। খ) কিছু সুপারিশ পরবর্তী নির্বাচিত সরকার করতে পারবে। এবং গ) কিছু প্রস্তাবে নারী আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে।
৪ ) কমিশনের সদস্যরা মোট ৪৩টি বৈঠক করেছেন।
৫ ) দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠন, উন্নয়ন সংস্থা, শ্রমিক সংগঠন, পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ৩৯টি পরামর্শ সভা করেছেন।
৬ ) অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে ৯টি সভা করেছেন।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, উপরোক্ত তথ্যের আলোকে আমাদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও মতামত হলো- নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন যথেষ্ট কষ্ট ও পরিশ্রম করে এই প্রতিবেদন তৈরি করছেন, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। এই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আগে জনসমক্ষে তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা দরকার। সুপারিশগুলো নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা, সমালোচনা, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ রাখা দরকার।
এতে বলা হয়, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনটি ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তি মূলক) ছিল না, এতে বিশেষ চিন্তা ও দর্শনের সদস্যগণই কেবল অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আমাদের বহুমাত্রিক নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব এই কমিশনে না থাকায় পুরো সংস্কার প্রস্তাবনাই একপেশে ও বিতর্কিত হিসেবে বিবেচিত হবে। কোন সুপারিশগুলো অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়ন করবে? কোনগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে? এবং কোন সুপারিশগুলোর মাধ্যমে নারী আন্দোলনের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো আলাদা করে তুলে ধরা হয়েছে তা পরিস্কার নয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, সুপারিশমালায় বিয়ে-তালাক, উত্তরাধিকারে সমান অধিকার, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, যৌনপেশাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করা, শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যা বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিবেচনায় খুবই সংবেদনশীল। এসব বিষয়ে অতীতেও পাশ্চাত্য সমাজ সংস্কৃতির আদলে বহু পরিবর্তন প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে কিন্তু আমাদের সমাজ কাঠামো ও ধর্মীয় ঐতিহ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনাকে উত্তম হিসেবে সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষ বিবেচনা করেছে। অতএব বর্তমান সময়ে এ ধরনের প্রস্তাব আলোচনা নতুন করে এনে বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলার জন্ম দেওয়া মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, সুপারিশে ধর্ষণের শিকার হওয়া অন্য লিঙ্গের মানুষের বিচার ও আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতে আইনে ধর্ষণ ধারায় সংস্কার আনা, যেকোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা, নারীর প্রতি সম্মানজনক, মর্যাদাপূর্ণ ও যথাযথ সংবেদনশীল আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি নেওয়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি দেওয়া এবং পূর্ণ বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনসহ যেসকল প্রয়োজনীয় সুপারিশ রয়েছে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাই।
তারা বলেন, সংস্কার কমিশনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করে পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রস্তাবের বিতর্কিত অংশ ও সুপারিশগুলো বাদ দিয়ে পুরো প্রতিবেদনটি পরিমার্জন করা দরকার। বাংলাদেশের দুর্বল সমাজ কাঠামো, অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং দরিদ্রতার কষাঘাত আমাদের নারী সমাজকে নানাভাবে পিছিয়ে রেখেছে। অপসংস্কৃতির নোংরা প্রভাবে নারীরা ভোগ্যপণ্য হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির একটা নেতিবাচক মনোবৃত্তিও কোথাও কোথাও নারী বঞ্চনার কারণ। কিন্তু সেসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে নারী অধিকারের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মানুষের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে বারবার মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা প্রবণতা আমরা বহুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। এটা আমাদের জাতীয় উন্নয়ন ও সংহতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্টরা এ ধরনের ভুল ও হীন ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা থেকে সরে আসবেন।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, ২০১৩ সালে নারী নীতিমালার নাম করে যে উদ্ভট প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছিল তা অনেকেরই স্মৃতিতে বিদ্যমান। সে সময় এটাকে কেন্দ্র করে অযথা একটা সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা আশা করি, সরকারসহ সকল মহলের সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। জাতীয় সংসদকে ৬০০ আসনে উন্নীত করা ও নারীদের জন্য ৩০০ আসন সংরক্ষিত করে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাবটি খুবই বিপ্লবী প্রস্তাবনা বলে আমরা মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব সংরক্ষণের নির্দেশনা এখনো কোনো দল পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে পারেনি। সে বিবেচনায় নির্বাচন সংস্কার কমিশন ১০০ নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের যে প্রস্তাব দিয়েছে তা পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা পর্যায়ক্রমে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে অগ্রসর হতে পারি।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও কিছু ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে যা এবি পার্টির পক্ষ থেকে আরও বিশদভাবে অবহিত হয়ে এবং পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে তুলে ধরা হবে বলেও নেতারা জানান।
মন্তব্য করুন