বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ যেন আর কখনো পথ হারিয়ে না ফেলে, সে জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী এই সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানায় এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করেছে। কেননা, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সহনশীলতা ও পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় থাকে।
শনিবার (৮ মার্চ) রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, চ্যার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্সসহ কূটনীতিকগণের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে এসব কথা বলেন জামায়াত আমির।
তিনি কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, এই পবিত্র রমজান মাসে আপনাদের সাথে ইফতারের এ মহতী আয়োজন করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। এই সন্ধ্যায় আমরা শুধু রমজানের ফজিলতই স্মরণ করছি না, বরং শান্তি, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির সেই অভিন্ন মূল্যবোধকেও স্মরণ করছি, যা সমগ্র মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মহান আল্লাহ দীর্ঘ ১১ বছর পর এই আয়োজনের সুযোগ করে দিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিদেশি বন্ধুদের সম্মানে ইফতার আয়োজনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের এসব আয়োজন করতে দেয়নি।
এমনকি কিছু অনুষ্ঠানের জন্য ভেন্যু বুকিং ও অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও, শেষ পর্যন্ত সরকারের বাধার কারণে আমাদের সেইসব আয়োজন বাতিল করতে হয়েছে। আজ আমরা আবারও আপনাদের এই মর্যাদাপূর্ণ ইফতার মাহফিলে স্বাগত জানাচ্ছি এবং এ জন্য মহান আল্লাহর দরবারে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একইসঙ্গে আমরা জুলাই বিপ্লবের সকল শহীদ ও নির্যাতিতদের স্মরণ করছি, যাঁদের আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো মুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা এমন এক সময়ে একত্রিত হয়েছি, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্য উপভোগ করছে। রমজান শুধুমাত্র সিয়াম সাধনার মাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মনিবেদন করার মাস। রোজা রাখার মাধ্যমে আমরা নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কষ্ট অনুধাবন করি এবং আমাদের হৃদয়ে সহমর্মিতার বীজ বপন হয়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা শুধু শারীরিক অনুশীলন নয়; বরং এটি আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা এবং ন্যায়পরায়ণতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার নবায়ন করার মাধ্যম।
জামায়াত আমির বলেন, কুরআনুল কারিম, যা এই মাসে নাজিল হয়েছে, মানবতার জন্য দিশারী, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও রহমতের উৎস। এই মাসে আমরা ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা ও উদারতার সর্বোচ্চ আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করি। তারাবির নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত ও দান-সদকা আমাদের মাঝে ঐক্য ও দায়িত্ববোধ তৈরি করে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ৯০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জামায়াত স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রস্তাব দেয় ও এর পক্ষে জনমত তৈরি করে। কিন্তু গত ১৫ বছরের দুঃশাসনে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতকে দমন করার সব ধরনের অপচেষ্টা চালিয়েছে।
তিনি বলেন, জামায়াতের পাঁচজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, ছয়জন নেতাকে কারাগারে বা পুলিশের হেফাজতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে গুমের শিকার হয়েছেন এবং অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
এই নিষ্ঠুরতার মধ্যেও জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির জুলাই বিপ্লবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
আমিরে জামায়াত আরও বলেন, বিশেষ করে, বাংলাদেশে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা চালুর পক্ষে আমরা জোরালো মতামত ব্যক্ত করেছি। আমরা বিশ্বাস করি, এই ব্যবস্থা জনগণের মতামতকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করবে এবং ফ্যাসিবাদী শাসন পুনরায় ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করবে।
এ ছাড়া, লক্ষ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবিও আমরা তুলে ধরেছি, কারণ তাদের মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
আমরা মনে করি, একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা টেকসই শান্তি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। আমাদের দায়িত্ব হলো—প্রত্যেক নাগরিকের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং দেশ গঠনে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া। এই লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই—এদেশের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকারভুক্ত। ইসলাম আমাদের শেখায় যে বৈচিত্র্য এক আশীর্বাদ, আর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমেই আমরা ন্যায়সংগত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তুলতে পারি।
আপনাদের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনাদের অংশগ্রহণ আমাদের বন্ধুত্ব ও সংলাপের প্রতি অঙ্গীকারের প্রমাণ। আসুন, আমরা এই উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করি এবং এমন এক বিশ্ব গঠনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি, যেখানে শান্তি, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পবিত্র রমজান মাস আমাদের সবার জন্য বরকতময় হোক।
ইফতার মাহফিলে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স জেমস এ. স্টুয়ার্ট, ব্রিটিশ হাইকমিশনার মিস. সারাহ কুক, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মিসেস মেরি মাসদুপি, চীনের রাষ্ট্রদূত মি. ইয়াও ওয়েন, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার গিরি গোরিওভিস কোজিন, অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার মিস. সুসান রেলি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মিকায়েল মিলার, ইরানের রাষ্ট্রদূত মি. মানসুর চাভোশি, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মি. রমিস সেন, পাকিস্তানের হাইকমিশনার কামরান ধাংগল, দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ভারত, ভুটান, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই, ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, ভ্যাটিকান সিটি, কানাডা, ব্রাজিল, আলজেরিয়া, কসোভো, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিনিধি, আইআরআই এবং এনডিপি’র আবাসিক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবৃন্দ শরীক হন।
অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতাদের মধ্যে ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের ও আনম শামসুল ইসলাম, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, মাওলানা এটিএম মাছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মোয়াযযম হোসাইন হেলাল, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, সাইফুল আলম খান মিলন, আবদুর রব ও অধ্যক্ষ মো. ইজ্জত উল্লাহ, মতিউর রহমান আকন্দ, নূরুল ইসলাম বুলবুল, মো: সেলিম উদ্দিন, মোবারক হোসাইন, ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ড. রেজাউল করিম, মাওলানা আফম আব্দুস সাত্তার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম প্রমুখ।
মন্তব্য করুন