বিএনপির বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। শনিবার (১১ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, ছাত্র-জনতার দুনিয়া কাঁপানো রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মুখে শিশুঘাতী, কিশোরঘাতী, নারীঘাতী, শ্রমিকঘাতী গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের স্বস্তি-শান্তির অভাবনীয় স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হলেও রাষ্ট্র ও সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা সবকিছু লন্ডভন্ড করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে ছদ্মবেশে। তাদের পালিয়ে যাওয়া গডমাদার হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত ১৬ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার কারণে প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের শিকড় অনেক গভীর পর্যন্ত গ্রোথিত হয়েছে। প্রত্যেকটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের নিচের স্তর থেকে একেবারে উপরের স্তর পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসর। তারা সুযোগ খুঁজছে ছোবল মারার।
তিনি বলেন, এই দোসররা দিবা স্বপ্ন দেখছে, তাদের প্রভু ভারত সরকার হাসিনাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে, বাতিল হওয়া ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, প্রোপাগান্ডা করে আবারও কিছু একটা করে ফেলতে পারে। কিন্তু সেই স্বপ্নের গুড়ে বালি। সাত মণ ঘিও পুড়বে না, আর রাধাও নাচবে না।
রিজভী বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষে পরিমার্জিত নতুন করে ছাপানো নবম-দশম শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নাগরিকতা’ বইয়ের ৭৩ নম্বর পৃষ্ঠার ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন ব্যবস্থা’ অধ্যায়ে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ সম্পর্কে হাসিনার অলিগার্করা লিখেছে, আওয়ামী লীগ এ দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আর বিএনপিকে নিয়ে অতিকথন, অপপ্রচার আর কুৎসা রটানোর বিরতিহীন যে ধারাভাষ্য চালানো হয়েছে শেখ হাসিনার ১৬ বছরে তারই প্রতিফলন এখনও আমরা দেখছি পাঠ্যপুস্তকে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি’র পরিবর্তে ‘সাবেক সেনাপ্রধান’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ‘সামরিক শাসনামলে’ ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভেতরে-বাইরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা আওয়ামী ভুতেরা শেখ হাসিনারই মিথ্যা বয়ান লিপিবদ্ধ করেছে পাঠ্য পুস্তকে।
তিনি বলেন, বর্তমানে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মাফিয়া প্রধান পালালেও মাফিয়া চক্রের অনেকেই এখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বহাল তবিয়তে ঘাপটি মেরে রয়েছে। সুযোগ পেলেই তারা স্বরূপে আভির্ভূত হচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, দেশের জনগণের ভালোবাসায় ধন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকেও বিএনপি সম্পর্কে ভুল তথ্য সন্নিবেশিত করা হচ্ছে। আমরা রাজনীতি সচেতন দেশবাসীর সামনে স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, বিএনপি সেনাছাউনিতে জন্ম হওয়া কোনো দল নয়। সামরিক প্রশাসক কিংবা সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নয় বরং ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সুতরাং বিএনপি সেনাছাউনিতে গঠিত হয়েছে এই তথ্য ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, পাঠ্য বইয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা জরুরি, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। গঠন করেছিলেন একদলীয় বাকশাল। এরপর ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পট-পরিবর্তনের দেশে সামরিক শাসন জারি করে খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সময় দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। এমনকি একদলীয় অভিশপ্ত বাকশালের নাম নেয়ারও কেউ ছিল না। দেশের এমন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। জারি করেন ‘রাজনৈতিক দলবিধি ১৯৭৬’।
তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির সবকিছুকেই শুধু শেখ মুজিবময় মাফিয়া আওয়ামী সরকার। দেশের সকল পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করে পাতায় পাতায় স্থান দেওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের গুণগান, শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা গল্প-প্রবন্ধ ও ছবি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঠ্যবই থেকে দলীয় গুণগান বাদ দিয়ে সংশোধন ও পরিমার্জন করার উদ্যোগ নিলেও হাসিনার দোসররা তাদের অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে মত্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগ আজ একটি গণহত্যাকারী, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেশে-বিদেশে পরিচিত। তারা মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে এবং ১২ কোটি ভোটারের ভোটাধিকার হরণ করেছে।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, গুম-খুন, হামলা-মামলা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাকস্বাধীনতা হরণ করে গণশত্রু এই দলটি জনবিচ্ছিন্ন ও গণবিদ্বেষী অপশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তাদের ‘বৃহত্তম রাজনৈতিক দল’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি এবং দুই হাজার ছাত্র জনতার আত্মত্যাগ, দুই সহস্রাধিক আহত ও পঙ্গুত্বের মাধ্যমে পাওয়া নতুন বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথম সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়ক এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপিকে বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অপপ্রচার।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান, এই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে প্রতিটি উদ্যোগকে সফল করে তোলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। অবিলম্বে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ভেতরে-বাইরেসহ সকল পর্যায় থেকে ফ্যাসিবাদের দোসরদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রিজভী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হচ্ছে। তারা এখনো বাজার সিন্ডিকেট দমন করতে পারেনি। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশাহারা মানুষ। প্রতিদিনের সংসারের ব্যয় মেটাতে জনগণকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। তাতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ আরেক দফা বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
তিনি বলেন, জনজীবনের নিত্যদুর্ভোগ কিংবা বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি শুধু সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করেন, তাহলে জনগণের কাছে সংস্কার আগে না সংসার প্রশ্নটিই মুখ্য হয়ে উঠতে পারে। দুর্ভোগ মেনে নিলেও জনগণ এখনো সরকারের বিরুদ্ধে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না। কারণ জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল দেখতে চায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার নিজেরা নিজেদের সফল দেখতে চায় কিনা, মানুষের ক্ষুধা নিবৃতির কার্যক্রমের মাধ্যমে সেটি তাদেরই প্রমাণ করতে হবে।
মন্তব্য করুন