দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপের বিষয়ে কথা বলা উচিত বলে মন্তব্য করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর)। তিনি দাবি জানিয়েছেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী এক বা দেড় বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা উচিত।
শনিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীর পুরানা পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের কার্যক্রম ও দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে’ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি জানান।
এ সময় তিনি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী এক বা দেড় বছরের মধ্যে আয়োজন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। এই যৌক্তিক সময়ের মেয়াদ এক বা দেড় বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। তাদের সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের বিষয়ে বলা উচিত। কারণ সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে, তাই পরিষ্কার করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি নির্বাচনী পরিকল্পনা ঘোষণার দাবি জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, অনিশ্চয়তা ও শূন্যতা নানা ধরনের জটিলতা ও অপলাপের জন্ম দেয়। তা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সুষ্ঠু ও অবাধ পরিস্থিতি তৈরিতে করণীয় নির্ধারণ, তার জন্য সময়সীমা ঠিক করে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ঘোষণা করা হলে সবার জন্য কাজ করা সহজ হবে।
তিনি বলেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চরম বিতর্কিত উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে জনগণ মেনে নেয়নি। ফারুকীকে দ্রুত উপদেষ্টা পরিষদ থেকে প্রত্যাহার করা হোক, তা দেশবাসী প্রত্যাশা করে।
সংস্কার কার্যক্রম গতিশীল ও গণসম্পৃক্ত করার আহ্বান জানিয়ে ইসলামি আন্দোলনের আমির বলেন, এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রসংস্কার করা, যাতে করে আর কখনোই কোনো স্বৈরাচার জন্ম নিতে না পারে। সেজন্য সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। এখন এই কমিশনগুলোকে গতিশীল করুন। রাজনৈতিক দল, ওলামা শ্রেণি এবং বিভিন্ন পেশা ও স্তরের জনমানুষকে সম্পৃক্ত করুন। ইতোমধ্যেই মানুষের মধ্যে কানাঘুষা তৈরি হয়েছে। এই কানাঘুষা সংস্কারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ তাদের খাদ্যের নিশ্চয়তা চায়, জীবনের নিরাপত্তা চায়। স্বৈরাচারের পতনের পরে মানুষ ভালো কিছু আশা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে। এটা মানুষকে হতাশ করেছে। সেজন্য বলব, যে কোনো মূল্যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করুন। শক্তহাতে সিন্ডিকেট ভেঙে দিন। মনে রাখবেন এই দ্রব্যমূল্যই আপনাদের প্রতি জনসমর্থন কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
চরমোনাই পীর বলেন, পতিত হাসিনা সরকার জাতির সঙ্গে যা করেছে তার বিচার না হলে মানবতার সঙ্গে অপরাধ করা হবে। কিন্তু এই বিষয়ে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আপনাদের সরকার গঠন হওয়ার পরেও ফ্যাসিস্ট রিজিমের মন্ত্রী, এমপি, দালাল পাবলিক সার্ভেন্ট, লাকার নেতা, পাতি নেতা, মাস্তানদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছে। অনেকে দেশেই আত্মগোপনে থেকে জনতার রুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কেনো তাদের পালানোর সুযোগ দেওয়া হল? কেনো দেশে থাকা অপরাধীদের আটক করা হচ্ছে না? বিচারে কোনো অবহেলা বা আপস দেশবাসী কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
আগামীতে যাতে কোনো স্বৈরাচারের উত্থান না হয় সেজন্যই আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, গত ১৬ বছর ধরে এই পদ্ধতির দাবি জানিয়ে আসছি। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এর পক্ষে অবস্থান জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে। তাদেরকে বলব, ক্ষমতা যাতে কোনো একক দলের হাতে একিভূত না হয় সেজন্যই পিআর পদ্ধতির প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, আপনারা যেমন রাজনৈতিকভাবে স্বৈরাচারবিরোধী তেমনি মানসিক ও পদ্ধতিগতভাবেও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী। তাই যদি হয় তাহলে আপনারাও পিআর পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানাবেন বলে আশা করছি।
ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, স্বৈরাচারের পতনের পরে সবারই প্রত্যাশা ছিল যে, আর যাই হোক আগামীতে যেনো আর কোনো স্বৈরাচার জন্ম নিতে না পারে সেই বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি যে, বিএনপি সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনকে বেশি প্রধান্য দিচ্ছেন এবং নির্বাচনকেই মূখ্য করে তুলছেন। এমনকি সংস্কার কার্যক্রমের বৈধতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলে রাখছেন।
বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার করবে এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া তিনি বলেন, তারাই আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাচ্ছেন, সেই নিশ্চয়তা তারা কোথায় পেলেন? আবার তারা ক্ষমতায় গেলেও জনতার কাঙ্খিত সংস্কার করবেন তার নিশ্চয়তা কি? সেজন্যই আমরা আগে সংস্কার, স্বৈরাচারের উত্থানরোধে সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন তারপরে নির্বাচন আয়োজনের আলাপ ভোলার জন্য সবার প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
বিপ্লবে অংশ নেয়া সব রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের সমন্বয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করার আহ্বান জানিয়েছেন চরমোনাই পীর। তিনি বলেন, সংবিধানসহ রাষ্ট্রীয় নানা ক্ষেত্রে সংস্কার, বৈদেশিক সম্পর্ক নির্মাণ, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিচারসহ জাতির সামনে করণীয় কাজের গুরুত্ব বিবেচনায় একটি সাধারণ রাজনৈতিক ঐক্যমত জরুরি। আর সেজন্য বিদ্যমান আইনের আওতায় বিপ্লবের অংশীদারদের সমন্বয়ে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা যেতে পারে। যা বহু জটিলতা থেকে উদ্ধার করবে এবং জরুরি বিষয়গুলোতে সাধারণ ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।
রেজাউল করিম বলেন, দীর্ঘদিন জনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা, জনমতকে ধারণ করা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ধৃত এই প্রস্তাবনাগুলো অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্টরা আমলে নেবেন এই প্রত্যাশা করছি। অন্যথায় ঈশাণ কোণে কালো মেঘের আনাগোনা আরও প্রকট হয়ে উঠতে পারে। এছাড়াও জুলাই আগস্টের বিপ্লবে হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে শুরুতে অর্থনীতি, রাজনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপর্যয় রোধ করা, স্বৈরশাসনের হোতাদের একাংশকে আটক করে বিচার কার্যক্রম শুরু করা, প্রশাসনে ধীরগতিতে হলেও শুদ্ধি অভিযান চালানো, সংস্কার কমিশন গঠন করা, বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কার্যক্রম শুরু করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মুহাম্মাদ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব আমিনুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার আশরাফুল আলম ও সহকারী মহাসচিব মাওলানা ইমতিয়াজ আলম প্রমুখ।
মন্তব্য করুন