অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই বলে দাবি করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষের সকল শক্তিকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
বুধবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তারেক রহমান। সভায় জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। সভায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, জনগণের বিশ্বাস-ভালোবাসা অর্জন করুন। জনগণের সঙ্গে থাকুন, সঙ্গে রাখুন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণ নিরপেক্ষভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বিএনপি অবশ্যই বিজয়ী হবে। প্রতিটি নেতাকর্মীর মধ্যে বিজয়ের আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো। তবে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। জনগণ পছন্দ করেন না এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।
তিনি বলেন, দেশকে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত করে মাফিয়া সরকারের প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। স্বৈরাচারের ১৫ বছরের দুঃশাসনের কুফল এখনো জনগণকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে হাজারো শহীদের রক্তস্লাত বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পলাতক স্বৈরাচারের পরাজয় হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহৎ ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। মাফিয়া সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতা আকড়ে থাকার সময়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার অপকৌশলে লিপ্ত ছিল। ক্ষমতা হারিয়ে ৫ আগস্টের অপশক্তি এখন আবার বিশ্বে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে।
তিনি আরও বলেন, পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষের সকল শক্তিকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ তিন মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। একটি সরকারের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য তিন মাস যথেষ্ট সময় নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাজারে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিদিন জনগণকে হার মানতে হয়। তিন মাস সময় তাদের (জনগণ) কাছে মনে হতে পারে তিন বছরের সমান। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে ব্যর্থ হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সকল কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রমেরামত তথা প্রচলিত বিধি বিধান সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম শুরু করেছে। সংস্কার একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। যা এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় বিএনপি ও সমাজের বহু মানুষ উল্লেখ করেছেন। বিএনপি সংস্কারের পক্ষে তবে রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রথাগত সংস্কারের চেয়ে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিকদের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
তা ছাড়া তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধানে আছে- জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। সংবিধানে লেখা থাকার পরেও মাফিয়া সরকার সেটা মানেনি। গত ১৫ বছর জনগণের ভোট ছাড়াই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদের পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা গেছে। এজন্য জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারেক রহমান বলেন, দেশে জনগণের আদালত এবং রাষ্ট্রীয় আদালত তথা বিচার বিভাগ শক্তিশালী-স্বাধীন থাকলে ফ্যাসিবাদ কখনোই জনগণের স্বাধীনতা, ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না। জনগণের আদালত কিন্তু মব জাস্টিজ নয়, এর অর্থ কোনো ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাহীন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকা। রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এমন হওয়া প্রয়োজন যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ, যে পর্যায়ের প্রতিনিধি হোক না কেন, নাগরিকদের প্রত্যক্ষতা ছাড়া কোনোভাবেই একজন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক কর্মী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে সক্ষম হবে না। রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে নিশিরাতের আয়োজন কিংবা ডামি প্রার্থী হিসেবে জনপ্রতিনিধি হবার পথ স্বাভাবিকভাবে রুদ্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক কর্মী জনপ্রতিনিধি হতে চাইলে জনগণের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করে ভোটের জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে। প্রার্থীকে জনগণের আদালতে দ্বারস্থ হতে হবে। বিজয়ের জন্য জনগণের আদালতের রায় পেতে হবে। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রে জনগণের আদালত ও রাষ্ট্রীয় আদালত এই দুটি কার্যক্রম শক্তিশালী করা গেলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার নিশ্চিত করা যাবে। জনগণের ভোট প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ কিংবা প্রসিদ্ধ করার মতো অপ্রিয় কাজের দায় রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে না। জনগণ নিজেরাই ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি, লুটেরা, টাকা পাচারকারী কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে থাকা মাফিয়া চক্রকে প্রত্যাখ্যান করবে। যেকোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচার হতে হবে রাষ্ট্রীয় আদালতে, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা দলের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের ভার রাজনীতির মাঠে অর্থাৎ জনগণের আদালতে করার সংস্কৃতি চালু করা গেলে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু করেছে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা জনগণের লুন্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের যাত্রাপথের এটি একটি শুরু মাত্র। সংস্কার কার্যক্রম এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতায় যথানিয়মে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৭ নভেম্বর শুধু একটি দিন নয়, দিবস নয়- ৭ নভেম্বর দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল, নতুন স্বত্বা পেয়েছিল। নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সেই ইতিহাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ’২৪-র ৫ আগস্ট আরেকটি বিপ্লব ও অভ্যুত্থান ঘটেছে। পরাজিত করেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে (শেখ হাসিনা)। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছি। এখন ভবিষ্যতে সতর্কতার সঙ্গে পার হতে পারে।
নির্বাচন ইস্যুতে তিনি বলেন, একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে ড. ইউনূসের সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি অতি দ্রুত নির্বাচনমুখী সেই সংস্কারগুলো করে নির্বাচন দিবেন বলে প্রত্যাশা করি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গত ১৬ বছর আমরা ৭ নভেম্বর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পালন করতে পারিনি। এই দিবস জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর ৫ আগস্ট বিপ্লব হয়নি, এটা ধারাবাহিকতা হয়েছে। বিপ্লব হয়েছে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। এটা (৫ আগস্ট) হয়েছে অভ্যুত্থান।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপের ঘোষণা দিন। অন্যথায় আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি। আমরা মাঠ ছাড়িনি। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কথা বলছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাবে। সেই সংস্কার যদি বর্তমান সরকারের কাছে একমাত্র কর্তব্য হয়, তাহলে ভুল হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলই সেটা করতে পারবে। যদি ভাবেন, সকল সংস্কার শেষে নির্বাচন দিবেন তাহলে তো আপনাদের রোজ কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে। এটা সম্ভব নয়।
তিনি দাবি করেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কারের কাজ একসঙ্গে চলতে তো বাধা নেই।
স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার চাইলে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সরকার এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। নির্বাচিত সরকারই পারে সংবিধান সংশোধন করতে। বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্যে রাখেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল আহসান, বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আহমেদ আযম খান, আবদুস সালাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আমিনুল হক, যুবদলের আব্দুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানী, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ।
মন্তব্য করুন