সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার নেতারা বলেছেন, ৮ দফা দাবিতে সারা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আজ ঐক্যবদ্ধ। দাবি আদায়ে তারা রাজপথে নেমেছেন। যতই মামলা দেওয়া হোক, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হোক, দাবির বাস্তবায়ন ছাড়া তারা কেউ মাঠ ছাড়বে না।
শনিবার (০২ নভেম্বর) বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক গণসমাবেশে এসব কথা বলেন নেতারা।
এ সময় তারা আরও বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ৫৩ বছরে যত সরকার এসেছে, তারা দাবি জানিয়েছে। কিন্তু দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। আগে তারা দাবি জানিয়ে থমকে গেছেন, আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু এবার যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে, কেউ ঘরে ফিরবে না। সারা দেশে তিন কোটি হিন্দু সম্প্রদায় আজ জেগেছে। দাবি মানা না হলে প্রয়োজনে ৫০ লক্ষ লোক নিয়ে ঢাকা ঘেরাও করা হবে। এ দেশ আমাদের, এ দেশ আমাদের জন্মভূমি। সুতরাং তারা কেউ এ দেশ ছেড়ে যাবে না। তারা আরও বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায় ৮ দফা দাবি অনতিবিলম্বে বাস্তবায়ন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত এবং মানবাধিকার নেতা অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্তসহ সারা দেশে সংখ্যালঘু নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ‘হয়রানিমূলক মিথ্যা’ মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সংখ্যালঘু সংগঠনসমূহের জোট ‘সংখ্যালঘু ঐক্যমোর্চার’ উদ্যোগে এই কর্মসূচি হয়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে এই ঐক্যমোর্চায় ৪১টি সংগঠন রয়েছে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে আট দফা দাবি পেশ করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এরপর দাবি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের উদ্যোগে গত ৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া আট দফা দাবিতে গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের লালদিঘি মাঠে গণসমাবেশ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ।
৮ দফা দাবিসমূহ হচ্ছে-সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন; অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় বাধা অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ; জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ; দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন; বৈষম্যবিলোপ আইন প্রণয়ন; পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকরীকরণ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী তিনদিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় একদিন এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে'তে একদিন সরকারি ছুটির ঘোষণা।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণসমাবেশের ঘোষণাপত্রে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনে ৬ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও।
প্রস্তাবনাসমূহ হলো : সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও সংসদের প্রতিটি অধিবেশনের সূচনায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পদক্ষেপ গ্রহণ; সংবিধানে বিদ্যমান সাংবিধানিক বৈষম্য দূরীকরণে ১২ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক রাষ্ট্রধর্ম সম্বলিত ২ক অনুচ্ছেদের বিলোপকরণ; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় শিক্ষায়তনের উন্নয়ন ও বিকাশে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ধর্মীয় শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর বৈষম্য দূরীকরণ; ধর্মীয় বাজেটে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে আমানতের সুদের টাকায় পরিচালিত ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টসমূহকে ফাউন্ডেশনে রূপান্তরকরণ; সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও কটুক্তির প্রতিকারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় বৈষম্যের অবসান করে অসাম্প্রদায়িকতাকে অগ্রাধিকার প্রদান।
সভাপতির বক্তব্যে নির্মল রোজারিও আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না। আমরা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই। গণতন্ত্র, সমতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাই। দেশে যে জাগরণ তৈরি হয়েছে, আসুন সেই জাগরণের মাধ্যমে সবার অধিকার নিশ্চিত করি।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক বলেন, ৮ দফার ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে ৮ দফা বাস্তবায়িত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হওয়া সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। একইসঙ্গে আগামীতে কোনো ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা যেন আর করা না হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ আছি, ৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছি। যতক্ষণ দেহে প্রাণ থাকবে, মাঠ ছাড়ব না। তিনি আরও বলেন, গত ৫৩ বছরে যত সরকার এসেছে, দাবি জানিয়েছি। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। অতীতে আমরা দাবি করে থমকে গেছি-আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারিনি। কিন্তু এবার আর মাঠ ছাড়ব না।
শ্রী শ্রী ভোলানন্দগিরি আশ্রম ট্রাস্টের সভাপতি ও গণফোরাম নেতা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, গত ৫৩ বছর ধরে আমাদের গাঁধা বানিয়ে রাখা হয়েছিল। সারাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় আজ ঐক্যবদ্ধ। আমরা আর গাঁধা হতে চাই না। এখন থেকে আমরা ঘোড়ার মতো দৌঁড়াব। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক সচিব তপন মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য অন্য কারোর মায়াকান্নার দরকার নেই। আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করব। আমরা কারোর দয়ার বশবর্তী হবো না। এখন থেকে আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথের সঞ্চালনায় গণসমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশ ছাত্রঐক্য পরিষদের অন্যতম সমন্বয়ক দীপঙ্কর শীল, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের পলাশ কান্তি দে, বিশ্ব হিন্দু ফেডারেশনের সন্তোষ দাস, ঋষি পঞ্চায়েত ফোরামের সভাপতি রামানন্দ দাস, বাংলাদেশ সনাতন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সুমন কুমার রায়, রবিদাস ফোরামের সভাপতি চাঁদ মোহন রবিদাস, সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের সুস্মিতা কর, মাইনোরিটি রাইটস ফোরামের উৎপল বিশ্বাস প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, রাজনীতির নামে আমরা বারবার প্রতারিত হয়েছি। অতীতে আমাদের ঘাড়ে পা রেখে অনেকে রাজনীতির ময়দান গরম করে ক্ষমতায় গিয়েছে। অনেকে এখনো ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। আমরা আর কাউকে এভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দিব না। তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দশটা সংস্কার কমিশন করেছে। কিন্তু সেখানে একজন সংখ্যালঘু প্রতিনিধিও নেই। আমরা অনেক বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আর কোনো বৈষম্যের শিকার হতে চাই না।
গণসমাবেশ থেকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত এবং ইসকনের সংগঠক চিন্ময় কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারীসহ সকল সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাথে যুক্ত সকল অপরাধীকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানানো হয়।
গণসমাবেশ থেকে জানানো হয়, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা ছাড়াও সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রাঙ্গামাটি, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, রংপুর, বগুড়া, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, রাজশাহী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা শহরে গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
গণসমাবেশের পর শহীদ মিনার থেকে মিছিল বের হয়। এরপর মিছিলটি দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে শেষ হয়।
মন্তব্য করুন