চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এখনো ফ্যাসিবাদের দোসররা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে নানা কলাকৌশলে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা বন্দর নিয়ে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে। প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। বন্দরকে রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতাও চান নেতারা। বুধবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশে এসব কথা বলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ‘দেশ বাঁচাও, বন্দর বাঁচাও আন্দোলন’-এর উদ্যোগে এই বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
মো. রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং এনডিপির মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন- বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, কল্যাণ পার্টির (একাংশ) চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, গণঅধিকার পরিষদের শহিদুল ইসলাম ফাহিম, শ্রমিক নেতা মো. বাহার মিয়া প্রমুখ।
সাইফুল হক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের তৎপরতা চলছে। নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন করা হচ্ছে। যারা এই কনটেইনার টার্মিনালের দায়িত্বে আছেন তারা রাষ্ট্রকেও বড় সংখ্যক রাজস্ব দিয়ে আসছেন। কিন্তু এখন এই টার্মিনালকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
ষড়যন্ত্র বন্ধের উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ পরিবহন উপদেষ্টাকে আগামী ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নিয়ে বিদেশি দুবাইভিত্তিক কোম্পানিকে দেওয়ার যে তৎপরতা, তা আপনি স্থগিত করবেন। তারপর দেশীয় ও বন্দর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলবেন, চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। কীভাবে আমরা আমাদের কোম্পানির মধ্য দিয়ে বন্দরের গতি সঞ্চার করতে পারি, তা আলোচনা করবেন।
তিনি আরও বলেন, ৫৪ বছর পরও একটা জাতি রাষ্ট্র নিজেদের বন্দর যদি নিজেরা চালাতে না পারে, এটা আমাদের জন্য লজ্জার ও অপমানের। অদক্ষতার কথা বলে কোনো অজুহাতে চট্টগ্রাম বন্দরকে কোনোভাবেই অন্য কারো হাতে জিম্মি করতে আমরা দিবো না। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধ। প্রয়োজনে ঢাকা-চট্টগ্রামে সকল রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন মিলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির লাইফ লাইন। আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে দেশীয় কোম্পানিগুলো এই বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। এর সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতি ও হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান যুক্ত। আমরা কোনোভাবেই এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, যাতে চট্টগ্রাম বন্দর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এর আগে ফ্যাসিবাদের দুঃশাসনের সময় দুবাইভিত্তিক একটা কোম্পানির সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক তৈরি করা হয়েছে- এখনো কোনো চুক্তি হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ পরিবহন উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে পারি না, লিজ দিতে পারি না। আপনারা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না, যা সরকারকে বিতর্কিত করবে- যেটা সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। বাংলাদেশের জনগণ ও গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতার কাছে আপনাদের দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু কোনো বিদেশি কোম্পানি, সংস্থা কিংবা স্বার্থের কাছে আপনাদের মাথা নত করার কোনো সুযোগ নেই।
নুরুল হক নুর বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো একটা বিষয় নিয়ে রাজপথে নেমে কথা বলতে হবে, এটা আমরা আশা করিনি। এখনো দেশীয় কোম্পানি বন্দর পরিচালনা করছে, সেখানে নতুন করে কেন বিদেশি কোম্পানিকে নিয়ে আসতে হবে। এখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের বিষয় আছে।
নৌ পরিবহন উপদেষ্টার উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশের ও জাতীয় স্বার্থে বন্দরকে বিদেশি কোম্পানির হাতে বন্ধক দেওয়ার অপতৎপরতা বন্ধ করুন। দেশীয় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দিন। চট্টগ্রাম বন্দরের বিষয়ে আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে আপনাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ আবারো রাজপথ নামবে।
সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে যারা গলাবাজি করত, তারা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে এখন ভারতে পালিয়ে আছে। বাংলাদেশটা এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছিলো যেখানে পুলিশ ও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা যেত, কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা যেত না। স্বৈরাচার সরকার ভারতের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছিল।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে, ষড়যন্ত্র চলছে। চট্টগ্রাম বন্দর একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। তারা যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সব কিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরেও ষড়যন্ত্র চলছে। বর্তমান বিপ্লবী সরকারও সেই ষড়যন্ত্রের চক্রে পা দিচ্ছে। বন্দর নিয়ে কোনো ধরনের হঠকারিতা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নিবে না। প্রয়োজনে জনগণ আবারো রাজপথে আন্দোলন করবে। তবুও চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাত থেকে রক্ষা করবে।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেক আগে থেকেই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায় আছে- চট্টগ্রাম বন্দরকে কোনো বিদেশিদের কাছে ইজারা দেওয়া যাবে না। মংলা বন্দর নিয়েও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বন্দর জাতীয় সম্পদ- এটা নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় আয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমাদের যদি দক্ষতা ও যোগ্যতা না থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে তা বাড়াতে হবে। বন্দর বিদেশিদের হাতে গেলে আমাদের হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হবে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র চলতে দেওয়া যাবে না। সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে হবে।
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরেও বর্তমান সরকার চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আলোচনা করছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বলছি, দেশের হাজার মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট করে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল যদি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে চট্টগ্রামের একটা অঙ্গহানি হবে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় আয়বর্ধক এই টার্মিনাল কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।
নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে অবিলম্বে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সকল ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে হবে। বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নৌ উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান, আপনাদের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে না দিয়ে দেশীয় অপারেটরদের দিয়ে টার্মিনাল আপারেশন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিন।
মন্তব্য করুন