আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলো বিচার বিভাগ। দেশ ও জাতির স্বার্থে তাই এই প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, পেশাদারিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা অতীব জরুরি। স্বাধীন ও পেশাদার বিচার বিভাগ ছাড়া দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বলে দাবি করেছে আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)।
মঙ্গলবার (০১ অক্টোবর) পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘বিচার বিভাগের সংস্কার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে করণীয়’ বিষয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন এবি পার্টির নেতারা।
এ সময় ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেন এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমেদ ভুইয়া, কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন রানা, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল, সহকারী সদস্য সচিব ব্যারিস্টার সানী আব্দুল হকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও নাক গলানো থেকে এই রাষ্ট্রীয় স্তম্ভকে রক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছি অন্তর্বর্তী সরকারকে। গত মাসে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আশা করছি অতিসত্বর বাকি সদস্যদের মনোনীত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হবে এবং তারা দেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ছাত্র-জনতার মতামত এবং গণঅভ্যুত্থানের মননকে ধারণ করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা জাতির সামনে পেশ করবেন।
সম্প্রতি অধস্তন আদালতের বিচারকদের সম্মেলনে দেওয়া আইনবিষয়ক উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের দেওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এবি পার্টি নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা ও দাবি জানাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে- ১. অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আইন ও বিচার বিষয়ক প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন করতে হবে যার নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির পুরো এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে।
২. অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, পাবলিক প্রসিকিউশনের অফিস, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগসহ সব প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
৩. ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তদন্ত ব্যতীত পুলিশের কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না; দীর্ঘসূত্রতাকে এড়িয়ে যথা সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই একই সচিবালয়ের অধীনে স্বাধীন প্রসিকিউশন টিম গঠন করতে হবে।
৪. বিচারিক যোগ্যতা, মেধা, অভিজ্ঞতা, বিবেকবোধ, সততা ও নিষ্ঠা হতে হবে বিচারক ও বিচারপতি হবার একমাত্র যোগ্যতা। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো নিয়োগ হতে পারবে না।
৫. যেসব বিচারক ও বিচারপতি অর্থ, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও অবৈধ সুবিধা লাভের জন্য জুলুম করেছেন, ঘুষের বিনিময়ে রায় দিয়েছেন, নির্বাহী বিভাগের গোলামী করে বিচারের নামে অবিচার করেছেন তাদের তদন্ত সাপেক্ষে চাকরিচ্যুত অথবা অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠিত হতে পারে।
৬. আইন পেশায় ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা ব্যতীত নিম্ন আদালতের বিচারক হতে পারবে না। মামলা জট কমাতে জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারকদের সংখ্যা ও বিচারপ্রার্থীদের সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও বিভিন্ন ল’ কলেজের পাঠ্য কারিকুলাম ও পঠন পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
৮. বার কাউন্সিলকে আইনজীবীদের স্বার্থ ও পেশার মর্যাদার জন্য পুনর্গঠন জরুরি। সেক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের বার কাউন্সিল নীতিমালা সব পক্ষের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে পুনর্লিখন জরুরি।
৯. যারা আইন পেশায় নিয়োজিত হতে চান, তাদের বার কাউন্সিলের অধীনে এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কোনো মেধাবী ছাত্রকে কোর্স থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এখানে মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হবেন, আর কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন না।
১০. জেলা ও উচ্চ আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশনের বাধ্যতামূলক সদস্য হওয়ার বিধান বাতিল করতে হবে, এটা ঐচ্ছিক থাকবে। শুধু বার কাউন্সিলের সদস্য থাকাটা সব আইনজীবীর জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে।
১১. আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। মিছিল, মিটিং, স্লোগান, ব্যানার, পোস্টারিং করে আদালতের ভাবমূর্তিকে হেয় করবার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক বারকে বিচারিক আদালতের সীমানা থেকে আলাদা করবার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. দেশের আবহাওয়া ও জনমানুষের সংস্কৃতিকে ধারণ করে এমন আরামদায়ক কিন্তু পেশাদার পোশাকের প্রচলন করতে হবে।
১৩. সংবিধান সংশোধন করে আপিল বিভাগকে সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা দিতে হবে; হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ দুটোই সুপ্রিম কোর্ট হতে পারে না।
১৪. ৪০ লক্ষাধিক মামলার জট কাটাতে একটা কমিটি করে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রত্যেক স্তরে বিচারিক প্রশাসন গঠন, আপিল করার সীমা বেঁধে দেওয়া, পরাজিত পক্ষকে খরচের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাকে বিচারিক সচিবালয়ের অধীনে ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ জরুরি বলে মনে করে এবি পার্টি। প্রত্যেকটি বিভাগ এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন করতে হবে, বিচার বিভাগীয় সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে। ১৫. লাখ লাখ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা নিষ্পত্তির জন্য স্থায়ী ‘ফৌজদারি মামলা পুনর্মূল্যায়ন কমিশন’ (Criminal Cases Review Commission) গঠন করতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে আর যারা এসব বেআইনি কাজে জড়িত ছিল, তাদের তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- এবি পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার ফারুক, গাজী নাসির, যুগ্ম সদস্য সচিব সফিউল বাসার, আহমেদ বারকাজ নাসির, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হালিম নান্নু, মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব সেলিম খান, যুবপার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক তোফাজ্জল হোসেন রমিজ, উত্তরের সদস্য সচিব শাহিনুর আক্তার শীলা, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মশিউর রহমান মিলু, শরণ চৌধুরী, পল্টন থানা আহ্বায়ক আব্দুল কাদের মুন্সিসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
মন্তব্য করুন