গত ৫০ বছর পূর্বের জাতীয় ভূমি নকশা অনুসারে বাংলাদেশের প্রতিটি নদ-নদী ও খাল পুনরুদ্ধার এবং নদীর সীমানা নির্ধারণ করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক সহদপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন আব্দুল লতিফ জনি।
তিনি বলেন, বিভিন্ন নদী ভরাট করে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিলাসী প্রমোদ বাংলোবাড়ি, বিনোদনকেন্দ্র, ক্লাব তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করে নদীগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের পাতায় স্থান পাচ্ছে কিন্তু বাস্তবে নেই। এর কারণ হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপের দখল। তারা মেঘনার শাখা নদীগুলো ভরাট করে তাদের শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার কারণে নদীগুলো বিলীন হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে।
১৮ কোটি মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, এভাবে যদি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাংলাদেশের নদী দখল অব্যাহত থাকে, তাহলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়; যেদিন এই অঞ্চল সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যাকবলিত হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে।
নদী ভরাট করে কিভাবে মানুষের ক্ষতি হয়েছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, নদী দখল বিষয়ে তদন্ত করা হোক। নদী হত্যাকারী পাহাড় ধ্বংসকারী ও ইটভাটা করে পরিবেশ নষ্টকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক।
শুধু তদন্ত নয়, উপদেষ্টামন্ডলীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে জনি বলেন, ওই সমস্ত দখলকারী ও তাদের দোষরদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
একইসঙ্গে তিনি বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের যুগান্তকারী পদক্ষেপ খাল খনন প্রকল্প ও নদী খনন প্রকল্প অব্যাহত থাকলে আজ বাংলাদেশের নদীগুলো সচল থাকত। তাহলে প্রতিবছর বন্যার তীব্রতা থেকে এ দেশের মানুষ রক্ষা পেতো। আবারও জিয়ার খাল খনন প্রকল্প ও নদী খনন প্রকল্প চালু করার দাবি জানান বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবদুল লতিফ জনি বলেন, সম্প্রতি দেশের পূর্বাঞ্চলে ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা হয়। এতে তারেক রহমানের বিশেষ নির্দেশনায় দলের প্রতিটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন প্রতিটি জেলা থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও ঔষধসামগ্রী নিয়ে বন্যায় সহায় সম্বলহীন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তারেক রহমানের এ নির্দেশনায় বানভাসী এলাকার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের যে উপকার হয়েছে তাহা ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরবাসী আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
তিনি বলেন, আমি ফেনী জেলার একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে এবারের বন্যা নিজ চোখে দেখেছি- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার কারণে লাখ লাখ মানুষ নিশ্চিত মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছে। ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরবাসী- তিন বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডকে কখনো ভুলতে পারবে না। বিশেষ করে ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও ফুলগাজীর মানুষ আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
এই আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার ও সাহায্য করার জন্য দেশের প্রতিটি জেলা থেকে অসংখ্য সামাজিক সংগঠন এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্ররা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিকদল তাদের সাধ্যানুযায়ী ত্রাণ নিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষের সীমাহীন কষ্টের পাশে থেকেছেন। তাদেরকেও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
আবদুল লতিফ জনি বলেন, লাগাতার বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পানি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কোনো পূর্ব সতর্কীকরণ ছাড়াই সব গেট আকস্মিকভাবে খুলে দেওয়ার কারণে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা জেলায় নিয়ন্ত্রণহীন এ ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। শুরু হয় মানবিক বিপর্যয়।
ফেনী জেলার পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া থানার পুরো এলাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ থেকে ১৫ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। সোনাগাজী, দাগুনভূঁইয়া থানাও ৭ থেকে ১০ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। গবাদি পশু (গরু-ছাগল-ভেড়া-মহিষ-হাঁস-মুরগি) পানির তীব্র স্রোতে ভেসে চলে যায়। শুরু হয় অমানবিক-অবর্ণনীয় বাসস্থান ও খাদ্যসংকট।
বন্যার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জনি বলেন, ঘুম থেকে উঠেই মানুষ দেখতে পায় অথৈ পানিতে তীব্র স্রোতে মানুষের জীবনের সমস্ত সহায়-সম্বল টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও-কোথাও বানভাসী মানুষ গাছে এবং আশে-পাশের উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, সেটাও দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের বিশেষ নির্দেশনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বানভাসি মানুষকে উদ্ধার ও প্রয়োজনীয় খাদ্য ,পানি সরবরাহ করতে এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী তাদের হেলিকপ্টার, স্পিডবোট ও নৌযান নিয়ে।
সেনাবাহিনী প্রধান নিজেও বন্যাকবলিত এলাকার দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের উদ্ধারকাজ নিজ চোখে দেখার জন্য যান এবং মানুষকে সব রকম সহযোগীতার আস্বাস দিয়েছে। সেনা সদস্যরা মানুষকে উদ্ধার করে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার দোতলা-তিনতলা ভবন যেগুলো উঁচু ছিলো সেখানে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বানভাসিদের রাখা হয়। প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হয়। পানির তীব্র স্রোতে অনেক সময় ইঞ্জিন চালিত নৌকাও সঠিক পথে চলতে ও উদ্ধার কার্যক্রম চালু রাখতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। নদী বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে চিন্তা করা যেমন অসম্ভব তেমনি বাংলাদেশের অনেক নদী অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে মাতৃতুল্য নদী আজ ইতিহাসের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে, তেমনি বাংলাদেশের নদীও হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে একাকার হয়ে মিশে আছে। এই বিবেচনার গুরুত্বকে সামনে রেখে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম ফেনী নদীর মোহনায় মুহুরী প্রকল্প এবং ছোট ফেনী নদীর মোহনায় মুছাপুর ব্যারেজ প্রকল্প চালু করেন।
এই প্রকল্পগুলো সমুদ্রের নোনা পানির জোয়ারের সময় ফসলের যাতে ক্ষতি না হয় এবং শুকনো মওসুমে মিঠা পানি জমিয়ে রেখে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। ফলে ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের অনেক অঞ্চলে ধান ও অন্যান্য ফসল উৎপাদনে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধিত হয় এবং ধান উৎপাদনে এই অঞ্চল স্বনির্ভর হওয়ার সফলতা লাভ করে। জোয়ারের সময় নোনা পানির তীব্র আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ায় মানুষ ফসল উৎপাদনে সফলতার গৌরব অর্জন করে।
আবদুল লতিফ জনি বলেন, উল্লিখিত- ২ প্রকল্প বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন সেচ প্রকল্প হিসেবে তাদের দ্বারাই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। সেচ প্রকল্পে কতটুকু পানি ধারণ করতে পারবে এবং কতটুকু পানি জমে গেলে বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে যাবে, সে নির্দেশনাও কিন্তু, প্রতিটি বাঁধে দেওয়া আছে।
অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করে বাঁধের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও মুহুরী প্রজেক্টে মাত্র ৪টি গেট খোলা হয়। পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষ অনুরোধ ও প্রচেষ্টায় সবগুলো গেট খুলে দেওয়া হয়।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, মুহুরি প্রজেক্টের নিম্নাঞ্চল এবং সমুদ্রের মোহনায় চট্টগ্রাম জেলার মিরেরসরাই থানার সমুদ্রাঞ্চলে বিগত সরকারের আমলে বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল তৈরি করতে গিয়ে নদীর মোহনাকে বালু ভরাট করে সংকুচিত করে ফেলা হয়। এতে পানির স্বাভাবিক গতিপথ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এই ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠা নিয়ে জাতির সামনে এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মুছাপুর ব্যারেজ প্রকল্পের গেটগুলো বন্ধ থাকার কারণে বাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে বাঁধটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাছে আবেদন জানিয়ে জনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার রাস্তা-ঘাট মেরামত ও মানুষের বাড়িঘর পুর্নবাসনের পাশাপাশি মুহুরী ও মুছাপুর প্রকল্পের গেটগুলো কেনো সময়মতো খোলা হয়নি তার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
মন্তব্য করুন