রাজকুমার নন্দী ও শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৩, ০৬:১২ এএম
অনলাইন সংস্করণ

বিএনপির টার্গেট ঢাকা

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

সরকার পতনের একদফা লক্ষ্য অর্জনে ঢাকাকে ঘিরেই চূড়ান্ত পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিএনপি। সারা দেশে নানা কর্মসূচি শেষে রাজধানীকে আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করতে চায় দলটি। আগামী ২৭ জুলাই মহাসমাবেশের পর লাগাতার কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেই পর্বের সূচনা হতে পারে। তার আগে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা জানান, ‘চলো চলো, ঢাকা চলো’ স্লোগান তুলে বিএনপির ৮২ সাংগঠনিক জেলার নেতাকর্মীরা আগামী বৃহস্পতিবার ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দেবেন। এরই মধ্যে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অথবা ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই সমাবেশে কয়েক লাখ মানুষকে সমবেত করে

একদফা দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে দলটি। জানা গেছে, মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে দুদিনের আলটিমেটাম দেওয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেওয়া না হলে সপ্তাহব্যাপী লাগাতার কর্মসূচি দেওয়া হবে। এরপর আগস্ট মাসজুড়েও কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এভাবেই আন্দোলনকে চূড়ান্ত সফলতার দিকে নিয়ে যেতে চায় বিএনপি। তবে সরকার কঠোর অবস্থান বা রাজনৈতিকভাবে বাধা সৃষ্টি করা হলে আন্দোলনের ধরন বদলানোর চিন্তাও রয়েছে।

ঢাকায় চূড়ান্ত আন্দোলন ঘিরে পরিকল্পনা

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদায়ের লক্ষ্যে লাগাতার আন্দোলনে থাকা বিএনপির টার্গেট এখন ঢাকা। এবার চূড়ান্ত আন্দোলন হবে রাজধানী ঢাকা ঘিরে। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে রাজধানীতে সংগঠন শক্তিশালী করতে নানামুখী উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় নানা কারণে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। হামলা, মামলা ও নির্যাতনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নেতাকর্মীরা। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে জেল খাটতে হয়েছে। ওই পরিস্থিতিতে ঢাকায় সংগঠনের অবস্থা সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এ কারণে ঢাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

আরও জানা যায়, ২০১৪ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার ঢাকার নেতৃত্বে রদবদল এনেও সুফল পায়নি বিএনপির হাইকমান্ড। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৭ সালে ঢাকা মহানগরকে উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই ভাগ করে আলাদা কমিটি গঠন করা হয়। তবে তাতেও সংগঠন চাঙ্গা হয়নি।

সর্বশেষ ২০২১ সালের আগস্টে ডাকসুর সাবেক ভিপি আমান উল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক করে ঢাকা উত্তর ও পুরোনো নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামকে আহ্বায়ক করে ঢাকা দক্ষিণের কমিটি গঠন করা হয়। উত্তরের জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক এবং দক্ষিণে যুবদলের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম মজনুকে সদস্য সচিব করা হয়। এই নেতাদের তৎপরতায় রাজধানীতে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। আগের তুলনায় বর্তমানে ঢাকায় বিএনপির আন্দোলন নতুনভাবে কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকায় সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে ঢাকা মহানগর উত্তরের ২৬টি থানা ও ৭১ ওয়ার্ডে এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর উত্তরের ৮০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬০টিতে পূর্ণাঙ্গ এবং ২০টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৪টি থানায় আহ্বায়ক কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত ত্যাগী, সক্রিয় দক্ষ ও আন্দোলন-সংগ্রামে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে ঢাকায় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেও শক্তিশালী করা হয়েছে। সাংগঠনিক এই পরিস্থিতি রাজধানীতে চূড়ান্ত আন্দোলন পরিচালনার জন্য অনুকূল বলে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন।

নয়াপল্টনেই জমায়েতের পরিকল্পনা

আগামী ২৭ জুলাই দলের রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। তবে বিকল্প হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেও বিবেচনা রাখা হয়েছে। দুটির যে কোনো একটিতে কর্মসূচি পালনের জন্য গতকাল সোমবার ডিএমপি কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

বিএনপি নেতারা জানান, ডিসেম্বরে ঢাকায় বিভাগীয় সমাবেশের স্থান নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে সময় ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের পর কয়েক ঘণ্টা আগে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছিল বিএনপি। এবার যাতে সে ধরনের পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়, সেজন্যই নয়াপল্টনের পাশাপাশি বিকল্প জায়গা চাওয়া হয়েছে।

তারা আরও জানান, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশের পর থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। দীর্ঘ সাত মাস আন্দোলনের পর এখন একদফা দাবিতে ২৭ জুলাই মহাসমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের গতি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই এই কর্মসূচির লক্ষ্য।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই মহাসমাবেশ কিন্তু হঠাৎ করে আসেনি। ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন করছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের সংসদ ও সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এবং জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বিএনপিসহ ৩৬টি রাজনৈতিক দল ঢাকায় মহাসমাবেশ আহ্বান করেছে। এটি এখন দেশের জনগণের সমাবেশ। এখান থেকে আমরা বার্তা দিতে চাই যে, অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।’

ঢাকার প্রায় ৫শ নেতাকে দিকনির্দেশনা

বিএনপি যে দ্রুত ঢাকা ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিতে যাচ্ছে, তা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্যে স্পষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগের জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন আসনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ঢাকায় এসে আন্দোলন করার মতো মানসিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। এ ছাড়া গত কয়েকদিনে ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৫শ নেতার সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করেছেন তারেক রহমান। ঢাকা সিটির সাবেক কাউন্সিলর এবং যারা কাউন্সিলর পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গেও সভা করেছেন তিনি। এসব সভায় বিভেদ ভুলে সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তারেক রহমানের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তারা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মাঠে থাকবেন।

ঢাকায় আসবেন জেলার নেতারা

বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, ২৭ জুলাই মহাসমাবেশে যোগ দিতে আগেভাগেই ঢাকায় আসবেন জেলার নেতারা। এরই মধ্যে সব জেলার শীর্ষ নেতাদের ডাক আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। মহাসমাবেশের পর ঢাকার বাইরে থেকে আসা নেতাকর্মীদের নিয়ে টানা কর্মসূচি পালনের চিন্তাও আছে বিএনপির হাইকমান্ডের। এ কারণেই ঢাকার বাইরে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।

বিএনপি নেতারা মনে করছেন, দলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় অবস্থান নিয়ে কয়েকদিন বড় কর্মসূচি করতে পারলে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনে আন্দোলন নিয়ে ভীতির সঞ্চার হতে পারে। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে আস্থা ও জনপ্রিয়তা বাড়বে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসবে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে তা সরকারের সামাল দেওয়া কঠিন হবে এবং চাপে পড়বে।

কোনো কোনো নেতার মতে, বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বিদেশি প্রভাবশালী কিছু রাষ্ট্রেরও আগ্রহ আছে। সেই লক্ষ্যেই ঢাকার মহাসমাবেশের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনের শক্তি দেখাতে চাইছে দলটি। রাজধানীতে শক্তি দেখাতে পারলে বিএনপি বিদেশিদের সমর্থন পেতে পারে। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকার কঠিন চাপে পড়বে। আর বাধা না দিলে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অতীতে যে ধরনের কর্মসূচি দিয়েছি এবং আগামীতে দিচ্ছি—তার মূল কথাটি হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। পাশাপাশি এটি নিশ্চিত করছি যে, আমাদের কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।’

তিনি বলেন, ‘২৭ জুলাই যে কর্মসূচি দিয়েছি সেখানে আমরা এটিই প্রত্যাশা করছি যে, জনগণের ঢল নামবে। কেননা, আমরা যে একদফা দাবিতে আজকে রাজপথে নেমেছি—তার মূল উপজীব্য হচ্ছে, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা। যতক্ষণ না এই সরকার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করছে, ততদিন পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন করে যাব।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ট্রাক থেকে মালামাল লুট করার সময় ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তার

সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী নিহত

জাতিসংঘের কাছে সংস্কার প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক তুলে ধরল জামায়াত

খুলনায় হাসিবুর হত্যায় ২১ ছাত্রলীগ নেতার যাবজ্জীবন

সফলতার সাথে টিসিএস আমস্টারডাম ম্যারাথন সম্পন্ন দৌড়বিদ ইমামুরের

সরকারের সুতোয় টান কোথায় থেকে আসছে জানতে চায় জনগণ : রিজভী

চবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার ৫

তামাকের ক্ষতিহ্রাস পণ্যের নিয়ন্ত্রণে যুক্তিসংগত নীতিমালা চায় বেন্ডস্টা

নাইকো দুর্নীতি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ৪ নভেম্বর

ইরানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ৭ ইসরায়েলি গ্রেপ্তার

১০

পুলিশের ওপর হামলা করে আসামি ছিনতাই, আহত ৫ 

১১

বিএসআরএফ সদস্যদের জন্য গ্রুপ বিমা চুক্তি

১২

‘আন্দোলনে উসকানিদাতাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশের নির্দেশ’

১৩

বিডিআর বিদ্রোহ : বিস্ফোরক আইনের মামলা শুনানির নতুন তারিখ 

১৪

মুম্বাইতে শাকিব খান 

১৫

৩৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ / সালমান এফ রহমানের তথ্য চেয়ে ৬৩ ব্যাংকে দুদকের চিঠি

১৬

ইনিংস হারের শঙ্কায় বাংলাদেশ

১৭

চলে গেলেন আয়রন মেডেন গায়ক পল ডি’আনো

১৮

পায়রা বন্দরে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত

১৯

হাসিনার পদত্যাগপত্রের অবশ্যই ভূমিকা রয়েছে : ফরহাদ মজহার

২০
X