রামজি বারাউদ
প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৪, ০৫:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ইসরায়েল কি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে?

বিক্ষোভে ইসরায়েলি জনগণ। পুরোনো ছবি
বিক্ষোভে ইসরায়েলি জনগণ। পুরোনো ছবি

যদিও গত ১৮ জুন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন যে, ইসরায়েলে কোনো গৃহযুদ্ধ হবে না। তবে, তার বক্তব্য ভুল হতে পারে। নেতানিয়াহুর এই বিবৃতি ইসরায়েলে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে দেওয়া। বিশেষ করে বেনি গ্যান্টজ এবং গ্যাদি এইজেনকটসহ কয়েকজন ওয়ার কেবিনেট মন্ত্রিসভার সদস্যের বহুল প্রত্যাশিত পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে। তারা দুজনই ইসরায়েলি আর্মির সাবেক চিফ অব স্টাফ।

কিন্তু তাদের এই পদত্যাগ প্রয়োজন অনুসারে, নেতানিয়াহুকে একঘরে করে ফেলতে পারেনি। কারণ তার জনপ্রিয়তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে ডান এবং কট্টর ডানপন্থিদের সমর্থনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এটি ইসরায়েলি সমাজে গভীর ও ক্রমবর্ধমান ফাটলকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলেছে। এর ফলে, শেষ পর্যন্ত দেশটিকে রাজনৈতিক উত্থান থেকে একটি প্রকৃত গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইসরায়েলের বিভাজনকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণের মতো একইভাবে দেখার সুযোগ নেই। গাজা যুদ্ধেরও অনেক আগে গল্পটির শুরু। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের তিনটি দলের নেতারা কাহল লাভান বা, "ব্লু অ্যান্ড হোয়াইট" নামে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

কোয়ালিশনের দুজন প্রতিষ্ঠাতা, গ্যান্টজ এবং মোশে ইয়া’অ্যালনও সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। তারা দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী এবং দেশের বৃহত্তর সমাজে ব্যাপকভাবে সম্মানিত। নির্বাচনে তাদের আপেক্ষিক সাফল্য সত্ত্বেও নেতানিয়াহুকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে তারা রাস্তায় নেমে এসেছেন। রাজধানীর তেল আভিভসহ ইসরায়েলের অন্যান্য শহরে বিক্ষোভকে ছড়িয়ে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি হালকা কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। একটি অদ্ভুত জোট সরকারের পতনের পর নেতানিয়াহুর সব বিরোধী শক্তির দ্বারা এই আন্দোলন সংঘটিত হয়। দেশের ওপর চেপে বসা ডান এবং কট্টর ডানপন্থি শাসনের অবসানই ছিল যার একমাত্র লক্ষ্য।

"ডান" এবং "কট্টর ডানপন্থি" এই টার্মগুলো এই ধারণাই দিতে পারে যে, ইসরায়েলের রাজনৈতিক সংঘাত মূলত আদর্শগত। যদিও ইসরায়েলের রাজনীতিতে মতাদর্শ একটি ভূমিকা পালন করে, কিন্তু নেতানিয়াহু এবং তার মিত্রদের প্রতি ক্ষোভ মূলত ইসরায়েলের রাজনীতিতে নতুন অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাবনার দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত। এর দ্বারা দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। সুতরাং, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এই ক্ষোভের শুরু এবং গাজা যুদ্ধ শুরুর আগে হাজার হাজার ইসরায়েলি অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভ শুরু করে।

গ্যান্টজ এবং ইসরায়েলি সামরিক ও উদারপন্থি অভিজাতদের দ্বারা সমর্থিত ওই গণবিক্ষোভের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল- নেতানিয়াহুকে ক্ষমতার রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনে বাধা প্রদান, যা বিগত ৭৫ বছর ধরে ইসরায়েলি সমাজকে শাসন করেছে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে, সেই দাবি শাসকগোষ্ঠীর পদত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়। রাজনৈতিক বিভাজনের কারণ হিসেবে যে বিষয়টি গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো- ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই নেতানিয়াহুর ইসরায়েলের বিচার ব্যবস্থাকে কোনঠাসা করা। তবে যে কারণে গৃহযুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করেছে সেটির শেকড় ছিল একেবারেই ভিন্ন এবং আরও গভীরে। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধের গল্পটি ইসরায়েলি রাষ্ট্রের মতোই পুরোনো। এ নিয়ে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো হয় ভিন্ন কারণ নির্দেশ করছে, নয়তো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি তার আরেকটি মিথ্যাচার।

গত ১৬ই জুন, নেতানিয়াহু বিদ্রোহী সামরিক জেনারেলদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন যে, "আমাদের দেশে একটি সেনাবাহিনী আছে এবং আরেকটি দেশের কোনো সেনাবাহিনী নেই।" সত্যিকার অর্থে, ইসরায়েল সশস্ত্র সংঘাতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যদিয়েই টিকে আছে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের শুরু থেকেই দেশটির সামরিক বাহিনী বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছে। এ কারণে, একটি অলিখিত চুক্তি রয়েছে যা সেনাবাহিনীর জেনারেলদেরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিশেষ আসন দিয়েছে। এরিয়েল শ্যারন, এহুদ বারাক এবং ইসরায়েলের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বেন গুরিয়নসহ অন্যদের মতো সবাই তাদের সামরিক সংশ্লিষ্টতার কারণে ইসরায়েলের রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু ক্ষমতায় এসে এর সবকিছুই পরিবর্তন করেছেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি সামরিক বাহিনীকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে ফেলা এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করতে ইসরায়েলের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পুনর্গঠন করতে শুরু করেন। আর এসব করতে গিয়ে তিনি মূলত, ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ইসরায়েলের রাজনৈতিক ভারসাম্যের মূল স্তম্ভকে লঙ্ঘন করেন। ফিলিস্তিনি জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলের কাজটি শেষ করার আগেই, সদ্য জন্ম নেয়া ইসরায়েলে নাকবার সময় দেশটিতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ মে, বেন গুরিয়ন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) গঠনের বিষয়ে একটি আদেশ জারি করেন। সে সময় ইরগুন এবং লেহি (স্টার্ন গ্যাং) সহ কিছু ইহুদিবাদী মিলিশিয়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংরক্ষণে একটি ডিক্রির জন্য লড়াই করেছিলেন।

সেখান থেকেই মূলত, কথিত "অ্যালটালেনা অ্যাফেয়ার" (১৯৪৮ সালে সংঘটিত সহিংস সংঘর্ষ) এর সূচনা। আইডিএফ'র ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী হ্যাগানা (প্রধান ইহুদবাদী প্যারা মিলিটারি ফোর্স) ইরগুনের (আরেকটি প্যারা মিলিটারি ফোর্স) উদ্দেশ্যে অ্যালটালেনা কার্গো জাহাজে করে আনা একটি অস্ত্রের চালান আটকানোর চেষ্টা করেছিল। তখন ইরগুনের প্রধান মেনাচেম বিগিনের (যিনি ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন) নেতৃত্বে ভয়ানক সংঘর্ষ হয়। এর ফলে ইরগুনের অনেক সদস্য নিহত ও গণগ্রেপ্তারের শিকার হয় এবং জাহাজে গোলাবর্ষণ হয়।

আজকাল ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলোতে অ্যালটালেনা অ্যাফেয়ারের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। কারণ, গাজা যুদ্ধ ইতোমধ্যে ইসরায়েলি সমাজকে নানা ভাগে বিভক্ত করছে। এই বিভাজন সামরিক বাহিনীকে সেই ছোট্ট গৃহযুদ্ধের পরে অর্জিত ঐতিহাসিক ভারসাম্য রক্ষা থেকে সরে আসত বাধ্য করছে। অ্যালটালেনা অ্যাফেয়ার এমন একটি ঘটনা, যা ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের মাত্র কয়েকদিন পরেই একটি রাষ্ট্র হিসাবে তার ভবিষ্যৎ শেষ করে দিতে পারত।

গাজা নিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ এই সংঘাত প্রকৃতপক্ষে, শুধু গাজা, হামাস কিংবা হিজবুল্লাহকে ঘিরে নয়, বরং ইসরায়েলের নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েও। ফলে, ৭ই অক্টোবরের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বলির পাঁঠা বানানো এবং গাজায় সামরিক অভিযানের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেওয়া হলে, আইডিএফকে হয় কোণঠাসা হয়ে থাকতে হবে, নয়তো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংঘর্ষের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি পরেরটি বেছে নেওয়া হয়, তবে গৃহযুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

মোহসিন কবির, মিডল ইস্ট মনিটর অবলম্বনে অনুদিত

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X