প্রয়াত আকবর আলি খান তার ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘Humpty Dumpty Disorder and Reform Strategies in Bangladesh’ প্রবন্ধে বাংলাদেশে ১৯৯১-২০১০ এর মধ্যে সূচিত বিভিন্ন প্রশাসনিক ও নীতি সংস্কার (যা মূলত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও দাতাগোষ্ঠীর চাপে হাতে নেওয়া)-এর তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ২৫টি কাঠামোগত সংস্কার উদ্যোগের মাত্র ৫টি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে বলে ধরা যায়। সম্প্রতি ওই তালিকা ধরে পড়তে গিয়ে দেখলাম এর অনেকগুলোই আবার গত দশকে উলটো দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
এই প্রবন্ধে আকবর আলি খান তার দীর্ঘ প্রশাসনিক ও গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে যেসব ইশারা পাঠককে দিতে চেয়েছেন তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর শিরোনাম- Humpty Dumpty Disorder। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ডিজঅর্ডার বলতে তিনি আমাদের স্কুলজীবনে পঠিত নার্সারি রাইমের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন- ‘Humpty Dumpty sat on a wall Humpty Dumpty had a great fall All the king's horses and all the king's men Couldn't put Humpty Dumpty together again.’
বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রশাসনিক সংস্কার প্রশ্নে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা থেকে তার মূল্যায়ন হলো- এদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই সংস্কারের অতীত। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন, ‘All the king's horses and all the king's men, Couldn't put Humpty Dumpty together again.’
প্রতিষ্ঠান সংস্কারের সাফল্যের ব্যাপারে পাবলিক পলিসির নানা গবেষণা থেকে প্রাপ্ত চিন্তার আলোকে তিনি বলছেন – ‘Institutional development works only if there are enough good employees who can effectively tame the bad employees. If good employees constitute a minuscule portion of total employees, institutional reform strategy will not work.’
তিনি আরও দেখাচ্ছেন অকার্যকর প্রতিষ্ঠান তার দুর্নীতিবাজ কর্মীদের আওতাধীন রেখে সংস্কার করার বাস্তব সীমা (threshold) আছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রচেষ্টা তারা ব্যর্থ করে দেয়। অতিমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভালো সমাধান হলো তাকে ভেঙে ফেলা, বিলুপ্ত করে ফেলা এবং আবার নতুন করে শূন্য থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এমন নজির আছে তিনি দেখাচ্ছেন- যেমন দুর্নীতিগ্রস্ত পিডিবি থেকে রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ড করার উদাহরণ।
২০১০ সালে এই প্রবন্ধ লেখার সময় তিনি সাম্প্রতিক শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, টাকা পাচার ইত্যাদির মাত্রা দেখেননি। তখনো যথেষ্ট দুর্নীতি ছিল, তবে তা পনেরো লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে আলোচিত হওয়ার পর্যায়ে বোধহয় পৌঁছে যায়নি!
আজকের ছাগলকাণ্ডের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিয়ে ভাবনার সময় একজন পাঠক হিসেবে দেখতে পাই বাংলাদেশের Humpty Dumpty রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর কখনোই বোধহয় কার্যকরভাবে সংস্কার করা যাবে না! আকবর আলি খান যে ইশারা রেখে গেছেন তা সত্য হয়ে উঠছে ক্রমেই- You can't put Humpty Dumpty together again!
তার পরামর্শ অনুযায়ী যদি আমরা চেষ্টা করি- বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, বিআরটিএ ইত্যাদি সেবাদানকারী কিছু প্রতিষ্ঠান না হয় ভেঙে আবার নতুন করে শুরু করা গেল, কিন্তু জনপ্রশাসন-পুলিশ-সামরিক বাহিনী-কর বিভাগ ইত্যাদিতে যে বিস্তৃত রেন্ট সিকিং কোয়ালিশন তৈরি হয়েছে- সেগুলো ভেঙে দিয়ে বাস্তবে কোনো রাজনৈতিক ম্যান্ডেটওয়ালা সরকার কিংবা ম্যান্ডেটবিহীন সরকার কি আদৌ কোনোভাবে টিকে থাকতে পারবে?
বাস্তবতা হলো- পারবে না! বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি সেই সংস্কারের বাস্তবতা পেরিয়ে এসেছে। দুর্নীতি রোধে বেতন বাড়িয়ে, পূর্বাচল ধরনের প্রকল্পে সরকারি কর্মচারীদের সুলভে জমি, সহজ ঋণে গাড়ি এসব দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ক্ষুধা কি আর নিবারণ করা যাবে? যখন তাদের বাসনা হয়ে উঠেছে কানাডার বাড়ি, দুবাইতে কন্ডোমিনিয়াম, দেশে নিজ নিজ এলাকায় বিস্তৃত জমিদারি? বরং তাদের দুর্নীতিতে বাধা দিলে এরা যে কোনো সরকারকেই বেকায়দায় ফেলে দেবে!
যে কোনো বড় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারই প্রথমত রাজনৈতিক, এরপর আসে তার নীতিসংক্রান্ত নানা কৌশলের প্রশ্ন। কিন্তু Humpty Dumpty Disorder থেকে উদ্ধারের কোনো বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক পথ আপাতত আমরা দেখি না। আরেক প্রয়াত লেখক শহীদুল জহিরের বইয়ের নাম থেকে ধার করে তাই বলতে হয়- এটাই আপাতত আমাদের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।’
গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজীম : উন্নয়নকর্মী
মন্তব্য করুন