ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৪, ০৫:৪২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

আসুন, ক্রিকেটীয় আবেগ ও ভালোবাসাকে দেশ গঠনে কাজে লাগাই

সৈয়দ আব্দুল হামিদ
ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথ চলা শুরুর পর থেকেই কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জিতলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। দলমত-নির্বিশেষে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠি, নিজে রঙ মাখি, অন্যদেরও রঙে রাঙিয়ে দেই, মিছিল করি এবং মিষ্টি-মুখ করি। তখন কে আ.লীগ, কে বিএনপি, কে জামায়াত, কে জাতীয় পার্টি কিংবা কে বামপন্থি তা ভেদাভেদ করি না। দলের মধ্যের কোনো উপদলীয় কোন্দলও বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আনন্দে সবাই একাকার হয়ে যাই এবং সবাই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেই। আবার কোনো ম্যাচে হারলে মন খারাপ করি, দুঃখ পাই এবং ব্যথিত হই। ভালো খেলে হেরে গেলে সমবেদনা জানাই। আর খারাপ খেলে হেরে গেলে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিই।

শুধু এখানেই ক্ষান্ত হই না- কখনো যারা খারাপ খেলেছে তাদের আবার কখনো পুরো দলকে গালি দেই এবং কটু মন্তব্য করি। সেই গালাগাল এবং কটু মন্তব্য থেকে দলের ক্যাপ্টেন, নির্বাচক, টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচ কিংবা ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ও পরিচালকরাও রেহাই পায় না। আর জিততে থাকা ম্যাচ হেরে গেলে তো আর কথাই নেই। কারও ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কটু এবং অশালীন মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করি না।

এসব করি কারণ আমরা দেশের আপামর জনগণ ক্রিকেটকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। তাই দলের প্রতিটি ভালো মুহূর্তকে উপভোগ করি এবং উৎসাহ জোগাই। জিতলে দলকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিই, পত্রিকা বা টেলিভিশনে লিড-নিউজ করি। আর প্রতিটি খারাপ মুহূর্তে আবেগ, উৎকণ্ঠায় এবং দুশ্চিন্তায় পতিত হই। তখন দলের মঙ্গল কামনায় যার যার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রার্থনাও করতে দেখা যায়। কেউ কেউ আবার মসজিদ, মন্দির, গির্জা কিংবা প্যাগোডায় শিরনি মানে। এসবের অর্থ দাঁড়ায় আমাদের একান্ত আকাঙ্ক্ষা, কামনা এবং প্রার্থনা- বাংলাদেশ দল ভালো খেলুক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক এবং জিতুক। নিশ্চয়ই শুধু ক্রিকেটকে ভালোবাসার জন্য আমরা এসব করি না। আসলে ভেতরে বেতরে আমরা প্রত্যেকে দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসি, তাই এসব করি। প্রবাসে এই ভালোবাসা বহুগুণে বেড়ে যায়। দেশকে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মাধ্যমে ঘটে থাকে। এটা স্বভাব সুলভ ও স্বাভাবিক এবং অন্যান্য জাতির ক্ষেত্রেও তা সত্য।

কিন্তু, স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বৈরাচারের পতন ছাড়া দেশের অন্য কোনো অর্জন আমরা ক্রিকেটে কিংবা ফুটবলে জেতার মতো দলমত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে উপভোগ করতে পারছি না। বরং কারোর মাধ্যমে কোনো অর্জন সাধন হলে আমরা কেউ আনন্দিত হচ্ছি আবার কেউ বা বেজার হচ্ছি। আবার দেশের কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষতিতে বা সংকটে ক্রিকেট বা ফুটবলে হারার মতো দুঃখ, কষ্ট এবং বেদনা অনুভব করি না। কারোর কপালে কালো রেখার ভাঁজ তেমন দেখি না। কাউকে প্রলাপ করতেও দেখি না। নিজের গায়ে আঁচড় পড়া না পর্যন্ত এ ক্ষতি নিয়ে আমাদের কারোর কোনো দুশ্চিন্তাও থাকে না। দেশ এ সব ক্ষতির সম্মুখীন হলে বরং কোনো কোনো পক্ষকে খুশি হতে দেখা যায়। কারণ ঘোলা জলে মাছ শিকারের মতো দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে নিজের আখের গোছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা আমরা করোনাকালে দেখেছি এবং এখনো দেখছি।

এর কারণ, আমরা দেশকে ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো একটি টিম হিসেবে ভাবতে পারছি না। স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে দেশকে টিম হিসেবে ভাবতে পারছিলাম বলেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছিলাম। একলা চলো নীতিগ্রহণ এবং আমাদের সামাজিক বন্ধন ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য এমনটা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিবিসির তথ্য মোতাবেক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে পুয়ের্তো রিকো দ্বীপের ম্যাকাক প্রজাতির বানররা প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে নিজেদের সামাজিক বন্ধন ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে।

তাহলে ক্রিকেটে হারলে আমরা এত উৎকণ্ঠিত হই কেন? কেন দল হারলে প্লেয়ার থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোর্ড পর্যন্ত সবার দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ি? আবার দলগত নৈপুণ্যের বদলে কেউ ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখালে তার দিকে সমালোচনার তীর ছুড়ি কেন? তারা তো আমাদের কারুর সন্তান। আমাদের রক্ত তাদের শরীরে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা তো আমাদেরই ডিএনএ বহন করছে। তাহলে কেন তাদের স্বভাব-চরিত্র আমাদের থেকে আলাদা হওয়ার আশা করি? আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যেমন বাক্তিকেন্দ্রীকতা, স্বার্থপরতা, কুটিলতা, জটিলতা, হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি মিশে আছে সেগুলো তাদের স্বভাবে প্রকাশ পাবে তা কি স্বাভাবিক নয়?

দেশের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড, লেনদেন ও আচার আচরণে যেখানে আদর্শ এবং জবাবদিহিতা বলে কিছুই নেই সেখানে ক্রিকেটারদের নিকট আদর্শিক প্রাপ্যতা আশা করা কতটুকু সমীচীন? এ যেন নিজেরা অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে সন্তানদের সৎ থাকা এবং আদর্শবান হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার মতো অবস্থা। ভেজাল আদর্শ ধারণ করে, ভেজাল চিন্তা লালন করে, ভেজাল শিক্ষাগ্রহণ করে, ভেজাল খাবার খেয়ে এবং দূষিত পরিবেশে বড় হয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা ক্রিকেটে এবং ফুটবলে যতটুকু দ্যুতি ছড়ায় তাই নিয়েই আমাদের সন্তুষ্টি থাকা উচিত।

এর থেকে বেশি আকাঙ্ক্ষা করলে ক্রিকেটীয় আবেগ এবং ভালোবাসা দিয়ে প্রথমে সমাজ এবং দেশ গঠন করতে হবে যেখানে ক্রিকেট বা ফুটবলে জেতার মতো দেশের প্রতিটি অর্জন সর্বজনীনভাবে সবাই মিলে উপভোগ করবো এবং দেশের প্রতিটি অমঙ্গল, ক্ষতি এবং সংকটকালে তা মোকাবিলায় দলমত, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ব। তাই আসুন, ক্রিকেটীয় আবেগ এবং ভালোবাসা দিয়ে সমাজ এবং দেশ গঠনে অগ্রগামী হই।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা পলিটেকনিক-বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ, আহত ২৮ জন ঢামেকে

নারায়ণগঞ্জে ধানক্ষেতে পড়েছিল অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ

খানসামা উপজেলা ছাত্র অধিকার পরিষদের কমিটি গঠন

সোমবার বন্ধ থাকবে ঢাকা কলেজ

ঢাকা পলিটেকনিক ও বুটেক্সের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ

বগুড়ায় জাপার সাবেক এমপিসহ আ.লীগের ১৬৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা

সিলেটে বাসদের মিছিল-সমাবেশ

তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ঐক্যবদ্ধ : নয়ন

৩০ লাখ টাকা ছিনতাই করতে ছুরিকাঘাত, আটক ১

সচিব পদমর্যাদায় নিয়োগ পেলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ

১০

রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি ঘোষণা

১১

‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতি দূর করতে হবে’

১২

পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাব জব্দ

১৩

ব্রিটিশ বাজারে ‘গাজা কোলার’ বাজিমাত

১৪

ইহুদি তরুণদের মধ্যে বাড়ছে গাজায় হামলাবিরোধী মনোভাব

১৫

টাকা না দিলেই গায়ে সাপ ছেড়ে দেওয়ার হুঁমকি

১৬

খুলনায় তিন শতাধিক ব্যক্তির নামে মামলা, জানে না বাদী

১৭

অরবিস উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতালের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শুরু

১৮

মাদক সংশ্লিষ্ট কাউকে ধরিয়ে দিলেই ৫ হাজার টাকা পুরস্কার

১৯

তিন মাস পর চাঁবিপ্রবির শিক্ষা কার্যক্রম শুরু

২০
X