জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহ ‘একটি বিপর্যয়’ ডেকে আনতে পারে। কিন্তু ইসরায়েল অংশের সীমান্তে প্রতিনিয়ত বোমা বর্ষণের মধ্যে বসবাসকারী ডেভিড কামারির মতে, এটিই হতে পারে সমাধানের পথ। গত মাসে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর ছোড়া একটি রকেট তার সীমান্তবর্তী শহর কিরিয়াত শ্যামোনার বাড়ির সামনের বাগানে এসে পড়ে। এতে তার বাড়ির বিভিন্ন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান।
কামারি জানান, তাদের পাশের পাহাড় থেকেই হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত এলাকার শুরু। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন, প্রতি রাতে বোমাবর্ষণ একটি সমস্যা।’ তিনি এখানেই জন্মেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আপনি যদি এখানে একরাত বসবাস করেন, তাহলে পাগল হয়ে যাবেন।’
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর হিজবুল্লাহ তাদের ফিলিস্তিনি মিত্রদের সমর্থনে বৃষ্টির মতো রকেট ছুড়তে শুরু করে। ফলে, কিরিয়াত শ্যামোনার অধিকাংশ বাসিন্দাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। কিছু সংখ্যক বাসিন্দা যারা রয়ে গেছেন, তাদের একজন ডেভিড। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে ৭১ বছর ধরে বসবাস করছি, আমি এখান থেকে যাব না, আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম, আমি ভীত নই।’ তিনি আরও বলেন, ‘হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ এবং হিজবুল্লাহকে হত্যা করাই এর সমাধান।’
হিজবুল্লাহর সিনিয়র কমান্ডারদের হত্যা এবং লেবাননের অভ্যন্তরে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার মধ্যদিয়ে ইসরায়েল তাদের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দিচ্ছে। চলতি মাসে হিজবুল্লাহও ইসরায়েল সীমান্তজুড়ে বিপুল বিপুল পরিমাণে ড্রোন ও মিসাইল ছুড়ে। ফলে, উভয় পক্ষ থেকেই হুমকি বেড়েছে। এই সপ্তাহের শুরুতে, গ্রুপটি ইসরায়েলের হাইফা শহরের সামরিক স্থাপনা এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ড্রোন ফুটেজ প্রকাশ করেছে। এতদিন দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর কথাবার্তা প্রতিরোধের কৌশল হয়ে উঠেছিল এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু যেভাবে সংঘাত চলছে এবং ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল থেকে ৬০ হাজারেরও বেশি বাসিন্দাকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, হিজবুল্লাহকে সীমান্ত থেকে জোরপূর্বক হটিয়ে দিতে ইসরায়েলি নেতা এবং জনগণ সামরিক বিকল্পকেই বেছে নিয়েছেন।
কিরিয়াত শ্যামোনার মেয়র অ্যাভিচাই স্টার্ন গত সপ্তাহে তার কার্যালয়ের পাশের সড়কে হিজবুল্লাহর রকেট আঘাত হানার দৃশ্য দেখান। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, বিশ্বে এমন কোন দেশ আছে, যে দেশ তার নাগরিকদের ওপর প্রতিদিন এমন হামলা মেনে নেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখানে জবাইয়ের জন্য রাখা ভেড়ার মতো বসে থাকব, কিংবা দক্ষিণাঞ্চলের মতো কোন দিন তারা আমাদের ওপর হামলা চালাবে সেজন্য অপেক্ষা করবো, তা হতে পারে না। সবাই এখন বুঝে গেছে, এখন অথবা পরে যুদ্ধকেই বেছে নিতে হবে।’ এখানকার এই বিপজ্জনক অচলাবস্থা নির্ভর করছে প্রায় ১০০ মাইল দক্ষিণে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধের ওপর। গাজায় যুদ্ধবিরতি উত্তরাঞ্চলেও উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু উভয় সংঘাতই অব্যাহত রেখেছেন। কারণ, তিনি তার সরকারের অতি ডানপন্থি মিত্রদের কাছে গাজা যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই হামাসকে নির্মূলের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন যে, এই উদ্দেশ্য সফল নাও হতে পারে। রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি ইসরায়েলি টিভিকে বলেন, ‘আমরা হামাসকে ধ্বংস করে দেয়া কিংবা হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি, এমন ধারণা জনগণের কাছে বিভ্রান্তিকর।’
অন্যদিকে, লেবানন সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ৯০ হাজার বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে যারা রয়ে গেছেন, তাদের মানসিক অবস্থাও একইভাবে বিষণ্ন। ফাতিমা বেলহাস নামের এক নারী ইসরায়েলি সীমান্ত এলাকা জেবাল এল বটম থেকে কয়েক মাইল দূরে বাস করেন। তিনি বলেন, প্রথমদিকে এই এলাকায় যখন ইসরায়েল বোমা হামলা চালাত তখন তিনি ভয়ে কাঁপতেন। কিন্তু এখন বোমা হামলা মেনে নিয়েই তিনি আর কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করছেন না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘আমি কোথায় যেতে পারি? অন্য জায়গায় আত্মীয়স্বজনরা আছেন, কিন্তু আমি কি করে তাদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিতে পারি?’ আমাদের কোন টাকা-পয়সা নেই। তার চেয়ে বরং নিজ বাড়িতেই সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুই ভালো। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্যদিয়েই বড় হয়েছি। তাই, আমরা ফিলিস্তিনিদের মতো আমাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত হব না।’
হুসেইন আবাল্লান সম্প্রতি ইসরায়েলের কিরিয়াত শ্যামোনা থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে লেবানন অংশে তার গ্রাম মেইজ আল জেবাল ছেড়ে চলে এসেছেন। তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সংকট এবং কোনো কাজকর্ম ও দোকানপাট না থাকায় সেখানে জীবনযাত্রা একেবারে অসম্ভব পড়েছিল। তিনি বিবিসিকে জানান, কিছু সংখ্যক মানুষ- বিশেষ করে বয়স্করা বাড়িঘর এবং খামারের জন্য সেখান থেকে আসতে চাননি। তিনি ইসরায়েলে হিজবুল্লাহর হামলাকে সমর্থন করে বলেন, "লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যেকেই বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করছে, বর্তমানে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।" তার মতে, প্রতিরোধই তাদের একমাত্র শক্তি।
তবে, উভয়পক্ষের জনগণের জন্যই এই সীমান্ত সংকট বর্তমানে যতটা কঠিন, একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ সেই সংকটকে তারচেয়েও ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কায় বৈরুতের কিছু বাসিন্দা তাদের জিনিসপত্র এবং পাসপোর্ট গুছিয়ে রেখেছেন। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ চলতি সপ্তাহে বলেছেন যে, ইসরায়েল কোথাও রেহাই পাবে না। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর রয়েছে অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণের দ্বারা একটি সুসজ্জিত সেনাদল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের রয়েছে অত্যাধুনিক সামরিক শক্তি। তাই, পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ উভয়ের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই যুদ্ধ ‘কল্পনাতীত ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’
ইসরায়েলের জন্য সমস্যার হলো- হিজবুল্লাহর রকেট প্রতিরোধ এবং দেশটির পরিত্যক্ত উত্তরাঞ্চলের লোকজনকে সরিয়ে আনা। হিজবুল্লাহর সমস্যা হলো- গাজায় যখন ইসরায়েলি বাহিনীর দ্বারা মিত্র হামাস আক্রান্ত হচ্ছে, সে তখন রকেট না ছুড়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না। সংঘাতময় এই পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, অঙ্কে ভুল করার ঝুঁকিও তত বাড়ছে। একইসঙ্গে, ইসরায়েলি সরকারের ওপরও এর থেকে উত্তরণের জন্য চাপ বাড়ছে।
৭ই অক্টোবর হামাসের হামলা ইসরায়েলের নিরাপত্তার হিসাব নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। সীমান্তের নিকটবর্তী বাসিন্দা এবং সরকারের বিভিন্ন পদে ক্ষমতায় থাকা লোকজনদের অনেকেই বলছেন, অতীতে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যে ধরনের চুক্তি হয়েছিল, তা এখন আর যথেষ্ট নয়। টম পেরি নামের এক ইসরায়েলি বাস করেন কিবুতয মালকিয়ায়, তার পাশেই লেবানন সীমান্তের বেড়া। চলতি মাসের শুরুর দিকে যখন হিজবুল্লাহর রকেট তার বাড়ির সামনে আছড়ে পড়ে, তখন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মদপান করছিলেন। তিনি বলেন, "আমি মনে করি, জাতিসংঘ মহাসচিবের সতর্কবাণী সঠিক- যুদ্ধ এই এলাকার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মনে হচ্ছে যে, আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। কোন চুক্তি চিরস্থায়ী নয়, কারণ তারা আমাদের মৃত্যু চায়। ইসরায়েল যদি হিজবুল্লাহকে নির্মূল করতে না পারে, তাহলে আমাদের চিরকাল যুদ্ধ করেই ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।"
তিনি আরো বলেন, ‘৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েলি নেতারা সব বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন কৌশলই তাদের কাছে নেই। ৭ অক্টোবর আমাদের সেনাবাহিনী এবং দেশের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এবং তারা ছিলেন আমাদের নেতা। কিন্তু এসব নেতাদের আমাদের দরকার নেই।’
ইসরায়েলের সংঘাত শেষ হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তনের দাবি আরো জোরালো হতে পারে। একদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবির পক্ষে অব্যাহত সমর্থন বৃদ্ধি, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকায় প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এখন সময় নিয়ে খেলছেন।
অনুবাদ : মোহসিন কবির
মন্তব্য করুন