ব্র্যাড লেন্ডন
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৪, ০১:৫৫ পিএম
আপডেট : ২৩ জুন ২০২৪, ০৩:৩৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
সিএনএন’র বিশ্লেষণ

হামলা না করেই চীন যেভাবে তাইওয়ান দখলে নিতে পারে

তাইওয়ান ভূখণ্ডে চীনের থাবা। গ্রাফিক্স : সংগৃহীত
তাইওয়ান ভূখণ্ডে চীনের থাবা। গ্রাফিক্স : সংগৃহীত

চীনের সামরিক বাহিনী তাইওয়ানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে বেইজিংয়ের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে তাদেরকে একটি গুলিও চালাতে হবে না বলে সতর্ক করেছেন প্রখ্যাত এক থিংক ট্যাংক। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, কমিউনিস্ট পার্টি হয়তো তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী একদিন তাইওয়ান প্রয়োজনে জোরপূর্বক দখলে নেবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের স্বায়ত্তশাসিত দেশটির বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ বিষয়টিকে সামনে এনেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনের নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতির বিষয়টি সেই ভয়কে আরও জোরালো করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্লেষক এবং সামরিক কৌশলবিদরা দীর্ঘদিন ধরে চীনের ব্যাপারে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবছেন। আর তা হলো- পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ অথবা সামরিক অবরোধ।

কিন্তু ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’র (সিএসআইএস) একজন থিংক ট্যাংক এ ব্যাপারে সতর্ক দিয়ে তৃতীয় একটি পন্থার কথা বলছেন। এই পন্থাটি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমমনা মিত্রদের জন্য অনেক বেশি কঠিন হবে বলেও জানান তিনি। আর সেটি হলো তাইওয়ানকে কোয়ারেন্টাইন বা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা।

‘গ্রে জোন’ কৌশল ব্যবহার ও বাস্তবায়ন যুদ্ধের ঠিক একধাপ নিচের হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। চীনের কোস্ট গার্ড, কথিত সামুদ্রিক মিলিশিয়া এবং বিভিন্ন পুলিশ ও সমুদ্র নিরাপত্তায় নিয়োজিত এজেন্সিগুলো তাইওয়ানকে পুরো কিংবা আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। সিএসআইএস থেকে প্রকাশিত নতুন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভবত দেশটির বন্দরগুলোকে অচল করে দেওয়া এবং দ্বীপটির ২৩ মিলিয়ন নাগরিকের জন্য জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ প্রবেশ বন্ধ করে দিতে পারে চীন। বিশ্বের সুবৃহৎ সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মি- পিএলএ’র নৌ, বিমান এবং স্থলবাহিনীর মতো উপাদানগুলো এক্ষেত্রে হয়তো নৈমিত্তিক এবং সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন- বনি লিন, ব্রায়ান হার্ট, ম্যাথিউ ফুনাইওল, সামান্থা লু এবং ট্রুলি টিন্সলে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাইওয়ানের ওপর চাপ প্রয়োগ ব্যাপক বাড়িয়েছে। উত্তেজনা থেকে সরাসরি সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে একটি হামলার আশঙ্কার ব্যাপারে অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়া হলেও বেইজিংয়ের কাছে তাইওয়ানের ওপর জবরদস্তি, হামলা, একীভূত করে নেওয়া কিংবা শাস্তি দেয়া ছাড়াও বিকল্প রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

চলতি মাসের শুরুতে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা সামিট ‘সাংগ্রি-লা ডায়ালগ’ চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুন সতর্ক করে বলেন, তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে কেউ কোন পদক্ষেপ নিলে ‘তারা নিজেদের শেষ ধ্বংস ডেকে আনবে।’

একজন দোভাষীর মাধ্যমে ডং আরও বলেন, ‘আমরা তাইওয়ানের স্বাধীনতার পদক্ষেপ রুখে দিতে সংকল্পবদ্ধ এবং এটাও নিশ্চিত করতে চাই যে, এমন চক্রান্ত কখনোই সফল হবে না।’ তিনি তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি এবং অফিসিয়াল যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের’ নিন্দা জানান। চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা কোস্টগার্ড জাহাজগুলোর সঙ্গে ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর নৌকাগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ফলে গ্রে জোন কৌশলের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে আরো দৃশ্যমান করে তুলেছে।

প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায় যে, বেইজিং এর সেনারা একটি কুঠার এবং অন্য ব্লেড জাতীয় অস্ত্র দিয়ে ফিলিপাইনের সেনাদের হুমকি দিচ্ছে। ম্যানিলা জানায়, চীনের উসকানিমূলক ওই সংঘর্ষে তাদের একজন সেনার একটি কেটে যায়। সেকেন্ড থমাস শোলের (দক্ষিণ চীন সাগরে একটি ডুবন্ত দ্বীপ) কাছে এবারের এই সংঘর্ষ পূর্ববর্তী সংঘাতের তুলনায় একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। একইসঙ্গে, উন্নত মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ তাইওয়ানের বিরুদ্ধে বেইজিংয়ের সামরিক এবং অর্থনৈতিক হুমকি চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের অধীনে অনেক বেশি বেড়েছে। চীনের বর্তমান ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ান দীপকে নিজেদের বলে দাবি করছে, কিন্তু এটি কখনোই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এখন তারা দ্বীপটিকে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একীভূত করার অঙ্গীকার করেছে।

কিন্তু সিএসআইএস এর প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বেইজিং এর কাছে এমন একটি শক্তিশালী বিকল্প রয়েছে যা চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিকে কেবল যুদ্ধ থেকেই দূরে রাখবে না, বরং তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো তার মিত্রদেরকে সংঘাতের সূচনাকারীর ভূমিকায় ঠেলে দিতে পারে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিশ্বের অন্যান্য কোস্টগার্ড বাহিনীর মতো চীনের কোস্টগার্ড বাহিনীও একটি আইন প্রয়োগকারী এজেন্সি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর অর্থ হলো রাষ্ট্রটির চারপাশে জাহাজ চলাচল বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এ ধরনের পদক্ষেপই হলো কোয়ারেন্টাইন যা, অবরোধ থেকে কিছুটা ভিন্ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনে অবরোধকে একটি যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘চায়না কোস্টগার্ড কর্তৃক কোয়ারেন্টাইন আরোপ একটি যুদ্ধ ঘোষণা নয়।’ ফলে এতে জড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রকে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে রিপোর্টে সতর্ক করা হয়।

‘তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট’ এর অধীনে দ্বীপটির আত্মরক্ষায় ওয়াশিংটন বৈধভাবে প্রয়োজনীয় অস্ত্রসহ যেকোনো কিছু সরবরাহ করতে পারবে। কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আইনগত বৈধ প্রয়োজনকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি তাইওয়ানকে রক্ষায় আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারের বিষয়টি বারবারই বলে যাচ্ছেন। তার এই হুমকি ওয়াশিংটনের ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ অবস্থানের বিরোধী হওয়ায় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা পিছু হটেন।

দ্বীপটির চারপাশে নিয়মিত চীনের সামরিক বিমান মহড়া দেয়, কখনো এটি একদিন কয়েক ডজন বারও হয়ে থাকে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টা নাগাদ ২৪ ঘণ্টায় ৩৬টি চীনা সামরিক বিমান তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা শনাক্তকরণ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে।

সিএসআইএস প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অবরোধের পরিবর্তে কোয়ারেন্টাইনের ফলে চীনকে তাইওয়ান প্রণালীতে প্রবেশ বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না। এর অর্থই হলো, আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতার স্বার্থে ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হস্তক্ষেপের সবচেয়ে বড় দাবিটি হারাতে পারে।

যুক্তিসংগত হলেও চীনের জন্য এখনো ঝুঁকিপূর্ণ

বাইরে থেকে যারা সিআইএসের রিপোর্টকে বিশ্লেষণ করেছেন, তারা সিএনএনের কাছে ওই প্রতিবেদনকে যুক্তিসংগত বলে জানিয়েছেন। তবে বিষয়গুলো কীভাবে কাজ করবে সে ব্যাপারে তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে সন্দেহ জানিয়েছেন। বিশেষ করে অর্থনীতির বিষয়টি কি করে বেইজিং এর পক্ষে থাকবে না সে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। ইউএস প্যাসিফিক কমান্ডস জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের অপারেশন বিভাগের সাবেক পরিচালক কার্ল সুস্টার বলছেন, কোয়ারেন্টাইন বজায় রাখা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হবে।

একদিকে তাইপেই ৬০ দিনের কোয়ারেন্টাইনে হাল ছেড়ে দেবে না। অন্যদিকে, বেইজিং এই দীর্ঘ সময় ধরে তার প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখা এবং সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কি হজম করতে পারবে? বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তাইওয়ান প্রণালীতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হলে বেইজিংয়ের বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

লন্ডনের কিংস কলেজের ওয়ার অ্যান্ড ট্র্যাটিজির প্রফেসর অ্যালেসিও প্যাটাল্যানো উল্লেখ করেন, কোভিড নাইন্টিনের কারণে চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেট উত্তরণের জন্য তাদেরকে লড়াই করতে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস এবং ইলেকট্রিক গাড়ি রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপের মতো নতুন বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের ফলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। প্যাটাল্যানো চীনের উদ্দেশে বলেন, ধৈর্যধারণই হতে পারে তাইওয়ানকে ‘একীভূতকরণ’ লক্ষ্য অর্জনের মূল চাবিকাঠি।

তিনি বলেন, উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং হামলার বিষয়টি ‘ব্যয়সাপেক্ষ’। একইসঙ্গে, যুদ্ধ কেবল জীবনই কেড়ে নেয় না, জাতীয় সম্পদেরও ক্ষতি করে।

সিএনএন অবলম্বনে অনুবাদ: মোহসিন কবির

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজধানীতে প্রায় এক কেজি স্বর্ণ ছিনতাইয়ের অভিযোগ

পর্তুগাল-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের জমকালো উদ্বোধন

সাকিবরা আইপিএলে দল না পাওয়ায় ফাহিমের ‘দুখ’

পাকিস্তানের সামনে বাংলাদেশ

আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে ঢাবিতে সমাবেশ ও মশাল মিছিল

ফ্যাসিবাদী রাজনীতি চিরতরে নির্মূল করতে হবে : জুয়েল

ইসকনকে নিষিদ্ধ ও সাইফুল হত্যার প্রতিবাদে বশেমুরবিপ্রবিতে বিক্ষোভ মিছিল

হাসনাত-সারজিসকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ঢাবিতে বিক্ষোভ

বিএনপির বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের ষড়যন্ত্র চলছে: আজাদ

‘প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতে ব্যবহারিক জ্ঞান প্রয়োজন’

১০

হত্যাচেষ্টার পর হাসনাত-সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস

১১

যে কারণে মিরপুর থেকে সরে গেল এনসিএল

১২

আইনজীবী হত্যায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুজনসহ অংশ নেয় ১৫ জন

১৩

জন্মস্থান সৈয়দপুর যাচ্ছেন বেবী নাজনীন

১৪

কাউকে আর রাষ্ট্র নিয়ে খেলা করতে দেওয়া হবে না : জেএসডি 

১৫

ফেসবুক লাইভে দুর্ঘটনার বর্ণনা দিলেন রাফি

১৬

আন্দোলনে নিহত শ্রমিক দল নেতার মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন

১৭

কাবাডি বিতর্কের মূলে ‘৮ কোটি’!

১৮

আ.লীগের ‘গুজব সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে মানববন্ধন

১৯

ডিআরইউ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন কালবেলার জাকির হোসেন

২০
X