বগুড়া উত্তরবঙ্গের একটি শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর, যা উত্তরাঞ্চলের মূল কেন্দ্রভূমিতে অবস্থিত। বগুড়া জেলাকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে গণ্য করা হয়। বগুড়া জেলায় স্পিনিং মিল আছে ২টি, বড় শিল্প ১২টি, মাঝারি শিল্প ১৯টি, ক্ষুদ্র শিল্প ২,৩৫১টি, কুটিরশিল্প ১৭,৩৬০টি এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প রয়েছে ৪৭৫টি। বর্তমানে বগুড়া থেকে পাটজাত, ফাউন্ড্রি, ভোগ্যপণ্য, কুড়ার তেল (রাইস ব্রান অয়েল), হস্তশিল্প, কারুপণ্য, টুপি, পাটজাত দ্রব্য, সেচ পাম্প, মোটর পার্টস বা গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ, অয়েল ফিলটার বা এয়ার ফিলটার, সয়াবিনজাত পণ্য, তৈরি পোশাক, সৌদি রাজকীয় পোশাক, টিউবওয়েল বা নলকূপসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের রপ্তানিমুখী অনেক কারখানা রয়েছে। এ ছাড়াও বগুড়া জেলা থেকে নকশিকাঁথা, পাবদা, শিং মাছসহ হরেকরকম পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে।
বগুড়া জেলার উল্লেখযোগ্য রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হাসান জুট অ্যান্ড স্পিনিং মিলস, ওয়েস্টার্ন অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস, বিকে ট্রেডার্স, আরোতি ইমপ্রেক্স, মিল্টন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, আলাল অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস, আজাদ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি।
বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের শাওইল বাজারে এক বছরে তাঁতশিল্পের বিক্রি হয় প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা বলে যা স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। বগুড়া চেম্বার অ্যান্ড কমার্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বগুড়া জেলা থেকে ২০২৩ সালে শুধু ভারতে ৭ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১২ রকমের এবং ২০২১ সালে ১৬ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে বগুড়া জেলা থেকে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করে আসছে।
বগুড়া চেম্বার অ্যান্ড কমার্স সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে বগুড়া জেলা হতে ভারতে ০৩ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের রপ্তানি হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭৩ কোটি ৭৮ লাখ ৬১ হাজার টাকা। ২০২২ সালে বগুড়া জেলা থেকে ৫ কোটি ৭২ লাখ মার্কিন ডলার বা ৬২৯ কোটি ২০ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সেই হিসাবে বগুড়া জেলা থেকেই পণ্য রপ্তানি আয় শুধু ১ বছরেই কমেছে ২৫৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
২০২১ সালে বগুড়া জেলা থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়েছিল ৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার, ২০২০ সালে ৫ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ডলার, ২০১৯ সালে ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার। উল্লিখিত পরিসংখ্যান থেকে আমরা বুঝতে পারি, আকাশপথে বগুড়ার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকায় বগুড়ার রপ্তানি বাণিজ্য শ্লথ হয়ে আসছে। সম্প্রতিকালে পত্রিকার খবরে জানা যায়, ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্রগ্রামের পরে বগুড়া শহর গাড়ির (অটোমোবাইল) ব্যবসার ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে। প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০টি গাড়ি, যার বাজারমূল্য প্রায় ছয় থেকে আট কোটি টাকা। বগুড়ায় মাত্র দুই বছরে ১৫টি গাড়ির (কার-মাইক্রোবাস) শোরুম এবং ১৫-২০টি ছোট-বড় কার মেরামতের ওয়ার্কশপ বা গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। এগুলোর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ভিশন হলো- বাংলাদেশকে একটি অন্যতম মুখ্য বিমান চলাচল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার সারাদেশে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান সরকার সড়ক, নৌ ও রেল যোগাযোগে দেশব্যাপী বৈপ্লবিক উন্নয়ন করে চলেছে। সড়ক ও রেলপথে উন্নয়নে বর্তমান সরকার মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু, ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু রেলপথ প্রকল্প, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সরকার আকাশপথকেও বাংলাদেশ কে দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে চায়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকায় বিমানবন্দর আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রকল্প সমাপ্ত হলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বার্ষিক প্যাসেঞ্জার হ্যান্ডেলিং ক্যাপাসিটি বর্তমানের ৮ মিলিয়ন হতে ২০ মিলিয়ন এবং কার্গো হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি বর্তমানের ২.০৮ লক্ষ টন হতে ৮.২০ লক্ষ টনে উন্নীত হবে। এ ছাড়াও বর্তমান সরকার আকাশপথে যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের জন্য দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের কাজ করছে।
দেশের অন্যতম ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিল্পনগরী হিসেবে খ্যাত প্রাচীন পুন্ড্রনগরী আজকের বগুড়া জেলা। দেশের উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে বগুড়া জেলার অবস্থান হলেও অদ্যাবধি রাজধানী ঢাকার সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠেনি, তথা বগুড়ায় এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর চালু হয়নি। জানা যায়, বগুড়ায় বিমানবন্দর স্থাপনের জন্য ১৯৮৭ সালে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই শর্ট টেকঅফ অ্যান্ড ল্যান্ডিংয়ের উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য ২২ কোটি টাকার নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের পর বগুড়া সদর উপজেলার এরুলিয়া এলাকায় ১১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় ৬০০ ফুট প্রস্থের ৫ হাজার ফুট লম্বা রানওয়েসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হয়। কিন্তু আজও প্রয়োজনীয় রানওয়ে নির্মিত না হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে বেসামরিক বিমান চলাচল শুরু হয়নি। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বগুড়া বিমানবন্দরটিকে বাণিজ্যিক ভাবে চলাচলের জন্য আরও ন্যূনতম ৩ হাজার ৫০০ ফুট রানওয়ে বাড়ানো প্রয়োজন। এটা সম্প্রসারণ হলে রানওয়ের দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়াবে ৮৫০০ ফুট। বগুড়া বিমানবন্দরকে চলাচল উপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন মাত্র ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা মাত্র।
বগুড়া বিমানবন্দর চালু হলে শুধু যে বগুড়াবাসী উপকৃত হবে তা নয়। বগুড়ার পার্শ্ববর্তী জেলা সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা জেলার অধিবাসীরা সবমিলিয়ে এই ৫ জেলার বসবাস করে ১, ৩৩, ৯৫, ২৬৮ জন। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী আকাশপথের যোগাযোগ সুবিধা ভোগ করবে বগুড়া বিমানবন্দর চালু হলে। বগুড়ায় বিমান যোগাযোগব্যবস্থা হলে বগুড়া জেলার অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্য, পর্যটন, শিক্ষা, চিকিৎসা, সংস্কৃতি,আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যসহ অন্যান্য খাতে যেমন সমৃদ্ধির বিকাশ ঘটবে তেমনি বগুড়ার পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধা জেলারও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা ত্বরান্বিত হবে।
বগুড়া বিমানবন্দর চালু হলে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙা হবে, জেলায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে, তাতে কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ লোকের, যা জাতীয় উন্নয়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। বগুড়ায় ইতিমধ্যে দুটি ৫ তারকা মানসম্পন্ন হোটেল মম ইন এবং নাজ গার্ডেন গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া রয়েছে আন্তর্জাতিক শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়াম, যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের লীলাভূমি হাজার বছরের পুরাতন নগরী মহাস্থানগড় দেখতে প্রতি বছরেই দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক বগুড়ায় ঘুরতে আসে। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা বিমান চলাচল না থাকায় অমিত সম্ভাবনাময় বগুড়ার পর্যটনশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে, দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে।
তাই আমরা মনে করি বগুড়ায় অতিদ্রুত বেসামরিক বিমান চলাচলের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাণিজ্যিক বিমানবন্দর চালু করা অতি জরুরি। বগুড়া বিমানবন্দরের বাণিজ্যিক উড্ডয়ন কার্যক্রম শুরু হলে শুধু যে, বগুড়াবাসী বা উত্তরাঞ্চলবাসী উপকৃত হবে তা নয়, নিকট প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান ও ভারতের একাংশের জনগণের আকাশপথে চলাচল ও পণ্য পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে।
বগুড়া সহ উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ জনগোষ্ঠী কে আকাশ পথে সহজ ও দ্রুত যোগাযোগের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে অতিদ্রুত বগুড়া বিমানবন্দর বাণিজ্যিক চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে বগুড়াবাসী প্রত্যাশা করে।
মুহাম্মাদ মাছুদুর রহমান: পিএইচডি গবেষক, ঢাবি ও প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন-বগুড়া প্রফেশনালস ক্লাব
মন্তব্য করুন