কৈ মাছের প্রাণ- এই বাগধারাটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। 'কৈ মাছের প্রাণ' বলতে বোঝায় শক্তপ্রাণ যা সহজে মরে না বা যে সহজে মরে না। ব্যাংক ও পুঁজি বাজার লোপাটকারী, ঋণখেলাপি, মাফিয়া এবং অর্থ পাচারকারী হায়ানা, শকুন এবং হাঙ্গরদের তীক্ষ্ণ ক্ষুর, নখ এবং ধারালো দাঁতের আঘাতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বারংবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তাই ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের পর থেকে জোরে-সোরে আলোচিত হচ্ছিল শীঘ্রই বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুরূপ সংকটে পতিত হতে যাচ্ছে।
এ আশঙ্কা এখনো পর্যন্ত সত্যে পরিণত না হলেও এই সকল হায়ানা, শকুন এবং হাঙ্গরদের ত্রিমুখী ক্রমাগত আক্রমণে এক সময়ের তেজি অর্থনীতি এখন নিস্তেজ প্রায়। পাশাপাশি তারা অর্থনীতির চারণক্ষেত্র ধ্বংস করে দিয়েছে। ভোরের সামান্য শিশিরের আশায় থাকা এই নিস্তেজ এবং চারণক্ষেত্রবিহীন অর্থনীতিকেও দস্যুরা গলা টিপে ক্রমে ক্রমে আরও নিস্তেজ ফেলছে। এত কিছুর পরও অর্থনীতি যে এখনো টিকে আছে তা একমাত্র 'কৈ মাছের প্রাণ'-এর সাথে তুলনীয়।
কৃষক, শ্রমিক, মুটেমজুর এবং গার্মেন্টস কর্মী- যাদের ঘামে এবং হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে অর্থনীতি কৈ মাছের প্রাণ- হয়ে উঠেছে তাদের শত কোটি সালাম। সশ্রদ্ধ সালাম মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরের শৌচাগারের পরিচ্ছন্নতা কর্মী সামীসুল-এর মতো প্রবাসী শ্রমিকদের (ভোটার আইডি কার্ড-এ বানান বিভ্রাটের জন্য যার নাম সামিউল থেকে সামীসুল হয়ে গেছে; ফলে সামীসুল নামেই পাসপোর্ট করতে হয়েছে) যারা নিজেদের ভাগ্য বদলের আশায় মরুভূমির তপ্ত বালুতে পরিচ্ছন্নতা কর্মী, উঁচু দালানের কার্নিশের নির্মাণ শ্রমিক কিংবা কোনো শৌচাগারের পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে অবিরাম পরিশ্রমরত।
পাশাপাশি সশ্রদ্ধ সালাম জানাই সেই সকল নিষ্ঠাবান শিল্প মালিক এবং ব্যবসায়ী যারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কলকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রেখে এবং ব্যবসা পরিচালনা করে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে। আরও সালাম জানাই কৃষিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং শিক্ষকসহ সে সকল সৎ, নৈতিক ও নিষ্ঠাবান পেশাজীবীদের যারা অর্থনীতিতে স্বপ্ন বুনছে। অসংখ্য সালাম সে সকল দেশ প্রেমিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান আমলা, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং রাজনীতিবিদদের যাদের অবদানে দেশটা এখনো পুরোপুরি বসবাসহীন হয়ে পড়েনি।
আর যাদের তীক্ষ্ণ ক্ষুর, নখ এবং ধারালো দাঁতের আঘাতে অর্থনীতি ক্রমাগতভাবে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তাদেরকে সহস্র কোটি ধিক ও তিরস্কার। লক্ষ কোটি ধিক ও তিরস্কার তাদেরকেও যারা গলা টিপে অর্থনীতির জীবন বায়ু নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
এই সকল হায়ানা, শকুন, হাঙর এবং দস্যুরা হয়তো ভাবছে এই সম্পদ তাদের সুখ এনে দিবে । তা মোটেও নয়, আসলে সৃষ্টিকর্তা তাদের সামনে অভাব ঝুলিয়ে রেখেছে। যত বেশি সম্পদ আহরণ করে তাদের সে অভাব আরও বাড়তে থাকে যা অব্যাহত থাকে কবরের মাটি কিংবা শ্মশানের চিতা স্পর্শ করা না পর্যন্ত। তাদের এ সম্পদ তাদের উত্তরাধিকারীগণও ভোগ করতে পারবে না। বরং তা পরদেশে বাজেয়াপ্ত হবে। আর তারা জনরোষে, জনবিক্ষোভে এবং জনগণের অভিশাবে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
মন্তব্য করুন