চলমান গাজা যুদ্ধ স্টারবাকস এবং ম্যাকডোনাল্ডসের মতো পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো বয়কটের ঢেউকে নতুন করে উসকে দিয়েছে। ভোক্তা অধিকার কর্মী এবং সাধারণ জনগণের এই বয়কট আন্দোলন কোম্পানিগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। যদিও বয়কটের ফলে কোম্পানিগুলোর সরাসরি আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। তারপরও এর ফলে করপোরেট এবং জনসম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এটি বৈশ্বিক সংকট, ভোক্তার আচরণ এবং করপোরেট নীতির জটিল সম্পর্কের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
ফলে, ভোক্তা আন্দোলনকে ক্রমবর্ধমান সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক প্রবল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বয়কটের ক্ষেত্রে ভোক্তার অনুপ্রেরণা লাভের বিষয়টি একেকজনের একেক ধরনের হতে পারে। এ নিয়ে বিপণন বিভাগ ও ভোক্তা আচরণ বিশ্লেষণকারী গবেষকরা বিস্তর গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, ভোক্তার অনুভূতির কার্যকারিতার ব্যাপারটি তাকে বর্জনে অনুপ্রাণিত করে। সামাজিক কারণগুলো যেমন- বিশ্বাসযোগ্য বার্তা, প্রত্যাশিত সামগ্রিক অংশগ্রহণ এবং কার্যকর অনুভূতিও তার সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ড ও পণ্য বর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, বয়কটকে মত প্রকাশের এমন একটি কাঠামো হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে ক্ষোভ এবং আবেগও মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
একটি সফল বয়কটের ইতিহাস ভোক্তাদের উৎসাহ যোগানোর পাশাপাশি করপোরেট সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থান, খরচকে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার দাবি ও বিনিয়োগ এবং অন্য উদ্যোগগুলো বর্জনের এই চর্চা ও মূলনীতির বিবর্তনকে সামনে এনেছে। ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অবৈধ বসতির বিষয়ে ভোক্তাদের সক্রিয় হয়ে ওঠা একটি বড় ঘটনা। বর্তমান সংঘাতের আগে, বয়কট, বিতাড়ন এবং নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলন ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের সমসাময়িক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, বিশেষ করে 'অপারেশন কাস্ট লিড' লিড’ (২৭ ডিসেম্বর, ২০০৮- ১৮ জানুয়ারি, ২০০৯) । বিডিএস আন্দোলনের প্রচারণা নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে সমান্তরালভাবে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের উদ্যোক্তারা বর্ণবাদবিরোধী ক্যাম্পেইন পরিচালনাকারীদের আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি প্রতিধ্বনিত করে বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের সমর্থন আদায় করেন। তবে বিডিএস আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগানোর ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
সামাজিক মাধ্যমের আবির্ভাব সত্ত্বেও, বিডিএসের আন্দোলনের সামগ্রিক প্রভাবের ক্ষেত্রে দেশভেদে ভিন্নতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ আর্থিক বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বয়কটের কারণে স্টারবাকসের বিক্রি ৪ শতাংশ কমে যাওয়ায় সীমিত আর্থিক প্রভাব পড়ে। বিপরীতে, মধ্যপ্রাচ্যে স্টারবাকসের কুয়েতি ফ্রাঞ্চাইজি প্রতিষ্ঠান ‘কুয়েত আলশায়া গ্রুপ’ সম্প্রতি জানিয়েছে যে, বয়কটের কারণে তারা ২০০০ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে (মোট কর্মীর প্রায় ৪ শতাংশ)।
একইভাবে, মিসর, জর্ডান ও সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বয়কটের কারণে ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ম্যাকডোনাল্ডসের বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ০ দশমকি ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অথচ এটি হওয়ার কথা ছিলো সাড়ে পাঁচ শতাংশ। গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিডিএস মুভমেন্ট ফিলিস্তিনের আটারতে অবৈধ বসতি এলাকায় স্থাপিত ‘জেনারেল মিলস’ এর পিলসবারি কারখানাটি বন্ধে চাপ সৃষ্টিতে সফল হয় এবং কারখানাটি ইসরায়েলি মালিকানাধীন বোদান হোল্ডিংসের কাছে বিক্রিতে বাধ্য হয়।
সাম্প্রতিক সাফল্যের মধ্যে রয়েছে- জিফোরএস (G4S), ক্লুক এবং পুমার মতো কোম্পানিগুলোতেও প্রভাব পড়ায় তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং স্পন্সরশিপের মধ্যে সমন্বয় করতে হচ্ছে, যা ইসরায়েলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এছাড়া, ইসরায়েলি অবৈধ বসতিতে সেবার অফার দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় এয়ারবিএনবি’র মতো ডিজিটাল ট্যুরিজম প্লাটফর্মও বয়কটের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। মোদ্দাকথা, এসব প্রচারাভিযান বর্জন আন্দোলনের সমর্থন আদায়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। উপরের কেস স্টাডিগুলো ভোক্তার বয়কট প্রচারাভিযানের তিনটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য সামনে নিয়ে আসে। সেগুলো হলো-
১। নৈতিক প্রেরণা, যা একইসঙ্গে নৈতিক ভোক্তা মতবাদ এবং বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাবে। ২। সমষ্টিগত পদক্ষেপ কোম্পানিগুলোর নীতি পরিবর্তনে প্রভাব ফেলে। ৩। ভোক্তার দীর্ঘমেয়াদি চাপ জনমত গঠন করে এবং করপোরেট সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য করে।
যদিও নৈতিক ভোক্তা মতবাদের পেছনের অনুপ্রেরণা এবং এর সম্ভাব্য আর্থিক প্রভাবের বিষয়টি কোম্পানিগুলো কতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছে তার ওপর নির্ভর করে। কোম্পানিগুলোর মুনাফা লাভ, মানুষ ও পৃথিবীর স্বার্থ রক্ষা সংক্রান্ত পরিবেশগত, সামাজিক এবং পরিচালন দক্ষতা (ইএসজি) নির্ণয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হচ্ছে ‘ট্রিপল বটম লাইন’ সমর্থন। কোম্পানিগুলোর কৌশলগত অভিযোজন এবং করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) নীতি বাস্তবায়নে প্রভাবিত করতে ইএসজি হতে পারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
বয়কটের ধারণাটি সরাসরি ব্যবস্থাপনাগত ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, যেটি দায়িত্বশীল বিনিয়োগ ও ভোগের বিষয়টিকে ফুটিয়ে তোলে। যদিও সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাবের চিন্তাধারার ব্যাপারে ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে, সাম্প্রতিক বাজার প্রবণতায় দেখা যাচ্ছে, নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যবসাগুলো ক্রমেই এখন নানা প্রশ্ন এবং যাচাইয়ের মুখে পড়ছে। এভাবে, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত এবং সংকটের কারণে কোম্পানিগুলোর জন্য এখন ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ইএসজি কৌশলগুলো অন্যান্য নৈতিক মাত্রার সঙ্গে যুক্ত করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটরে প্রকাশিত ‘বয়কট ব্যাটলগ্রাউন্ড : ক্যান কনজ্যুমার অ্যাক্টিভিজম শেইপ অ্যা মার্কেটপ্লেস?’ (Boycott Battleground: Can Consumer Activism Shape a Marketplace?) নিবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন মোহসিন কবির।
মন্তব্য করুন