বেলেন ফার্নান্দেজ
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৩, ০৬:৩২ পিএম
আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৩, ১১:১৪ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
আলজাজিরা থেকে

নিজের ‘ডিজিটাল মৃত্যুর’ জন্য আপনি প্রস্তুত কি?

এ যুগে মৃত্যুও ডিজিটালাইজেশনের বাইরে নয়।  ছবি : মার্টিন মেইজনার/ এপি
এ যুগে মৃত্যুও ডিজিটালাইজেশনের বাইরে নয়। ছবি : মার্টিন মেইজনার/ এপি

আপনার মৃত্যুর পর কে আপনার হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ পড়ে? কে আপনার পাসওয়ার্ড এবং অন্যান্য ক্রিপ্টো সম্পদ সম্পর্কে তথ্য পায়? মৃত্যুবরণ করাটা ক্রমেই আরও জটিল হচ্ছে।

জুনের মধ্যবর্তী সময়ে আমি যখন ইতালিতে ছিলাম, তখন ৪ জুন আমি ইতালিয়ান সংবাদপত্র লা রিপাবলিকা কিনি। বলা বাহুল্য ৪ জুনের পত্রিকাই কিনি। আমি সেইসব মানুষদের একজন, যারা এখনো প্রতিদিন হাতে একটি জলজ্যান্ত পত্রিকার কপি রাখতে চায়।

পত্রিকাটিতে গিওলিয়া ট্রামোন্টানো নামের ২৯ বছর বয়সী এক নারীকে হত্যার খবর বেশ গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়। চলতি বছরের মে মাসে মিলানে প্রেমিক আলেসান্দ্রো ইম্পাগনাতিয়েলো ওই নারীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। নিহত ওই নারী সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।

লা রিপাবলিকার ১২ নম্বর পৃষ্ঠাজুড়ে এই দম্পতির হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথন ছাপা হয়। বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে তাদের কথোপকথনের বিষয়বস্তুগুলোকে পৃথকভাবে তুলে ধরা হয়। পত্রিকাটি ট্রামোন্টানো ও ইম্পাগনাতিয়েলোর মাঝের কথাবার্তাকে বিভিন্ন আলাদা শিরোনাম দেয়। যেমন : ‘লিপস্টিক নিয়ে ঝগড়া’, ‘বিচ্ছেদের ঘোষণা’, ‘বাচ্চার ভবিষ্যৎ’, ‘গিওলিয়াকে হত্যার পর পাঠানো মেসেজ’।

বলা বাহুল্য, খুন নিয়ে মানুষের আলাদা ধরনের আগ্রহ রয়েছে। তবে, ডিজিটাল যুগে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় খতিয়ে দেখার অসুস্থ অভ্যাস নতুন মাত্রা পেয়েছে। খুবই স্বাভাবিক, এতে করে মানুষের গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

পিউগ্লিয়ায় ফেরত আসার আগ থেকেই আমি ট্রামোন্টানো হত্যা মামলা নিয়ে বেশ কিছু বিষয় শুনে এসেছি। করোনা মহামারির আগে গ্রীষ্মের ছুটিতে এক ইতালিয়ান বন্ধুর মায়ের সঙ্গে তাদের সমুদ্রপাড়ের ছোট্ট বাসায় সময় কাটাতাম আমি।

পিউগ্লিয়ার সত্তোরোর্ধ্ব বন্ধুরা আমাকে মিলানের এ খুনের ঘটনা নিয়ে সমস্ত কিছু জানায়। বরং এটা বললেই ভালো হবে, আমাকে তারা মনের মাধুরী মিশিয়ে খুনের গল্পটি শোনায়। এসব গল্প সত্য থেকে অনেক দূরে। তবে এসব উগ্র কথা শুনে মনে হবে—অপরাধ সম্পর্কে অভ্যন্তরীণ জ্ঞান নিয়ে অপরাধী ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থা বিচার করেই এসব বলা হচ্ছে।

ইতালিতে খুন নিয়ে হওয়া মধ্যরাতের টিভি শোগুলোতে এসব দৃশ্য দেখে আমার অনেকগুলো গ্রীষ্ম কেটেছে। এসব অনুষ্ঠানে অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি থাকে এবং ইতালিয়ান অঙ্গভঙ্গিমার বহিঃপ্রকাশ থাকে। আমার প্রায়ই মনে হতো, কোনটা এখানে বেশি গুরুত্ব পায়, ইতালির খুন নিয়ে বানানো টিভিশো—না কি ইতালিয়ানদের খুনের প্রতি আগ্রহ।

এ বছর আমার সেই বন্ধুর মায়ের বাসায় খুন নিয়ে একটি অনুষ্ঠান দেখে মনে হলো, এগুলো আলো আর শব্দের বিরতিহীন বিচ্ছুরণ যা আবার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সবাই যেন ইতালিতে হওয়া খুন সমন্ধে সবকিছু জানতে পারেন, এজন্যই এমনটা করা হচ্ছে।

খুন নিয়ে হামেশা এত আলোচনা হলেও, ইতালির বিভিন্ন উপকূলে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শরণার্থীদের কথা কখনোই বলা হয় না। রাষ্ট্রের শরণার্থীবিরোধী সামরিক তৎপরতার কারণে তারা করুণ পরিণতি ভোগ করে। তাদের প্রতি এই ব্যাপক অমানবিকতা চললেও—অন্যান্য খুনের ঘটনার মতো কখনোই তা চাঞ্চল্যকর উপায়ে প্রচার করা হয় না। শরণার্থীরা মৃত্যুর আগে হোয়াটস অ্যাপে কোনো মেসেজ পাঠিয়েছেন কি না তা কখনো জনসম্মুখে আনা হয় না।

ট্রেনটিনো প্রদেশে ২৬ বছর বয়সী এক যুবক ভালুকের আক্রমণে নিহত হলে সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। পিউগ্লিয়ায় আমার সঙ্গীরা তাদের মোবাইল ফোনগুলো আমার মুখের সামনে তুলে ধরেছিল যেন আমি মৃত্যুর আগে ওই যুবকের প্রেমিকার সঙ্গে ছবিগুলো দেখতে পারি এবং এডিট করে বসানো ভালুকটির আবছায়া তাদের পেছন থেকে উঁকি দেয়।

উদাহরণ হিসেবে ডিসেম্বরে আবরুজ্জো ন্যাশনাল পার্কে ভালুকের আক্রমণে মরতে বসা ৩৩ বছর বয়সী ব্যক্তির কথাও বলা যেতে পারে। এই ঘটনায় ওই ব্যক্তির স্ত্রীকে অর্ধমৃত অবস্থায় পাঠানো অডিও বার্তা ‘কোরিয়ে ডেলা সেরা’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সেকশনে ছাপা হয়।

অবশ্যই এ ধরনের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র খুঁজে বের করে সেটা প্রচার করা ইতালিয়ান সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক বিষয়। আমি নিজেকে ট্রামোন্টানো এবং ইম্পাগনাতিয়েলোর হোয়াটস অ্যাপ যোগাযোগ পড়ে ফেলার জন্য অপরাধী মনে করি এবং আমি চাই না আমার মৃত্যুর পর আমার কথোপকথন সবার স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয়বস্তু হোক। (তবে এটা কিছুটা স্বস্তির বিষয়, আমার ব্যক্তিগত নোটবুকে লেখা কথাগুলো অনেক সময় অস্পষ্টতার জন্য আমার নিজেরই পড়তে কষ্ট হয়।)

সেদিন বিগত যখন মৃত্যুর পর মানুষ শুধু শরীরের সঙ্গতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করত। বর্তমান যুগে ডিজিটাল পদচ্ছাপ নিয়েও দুশ্চিন্তার জায়গা তৈরি হয়েছে। ক্রিপ্টো সম্পদ থেকে শুরু করে পাসওয়ার্ড পর্যন্ত সবকিছুই ডিজিটাল উত্তরাধিকারিত্বের আওতাধীন।

এদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামগুলোর তাকালেই দেখা যায় বিশ্বব্যাপী কীভাবে তারা মানুষের গোপনীয়তাকে অসুস্থভাবে পদদলিত করছে। যুক্তরাজ্যের একটি গণমাধ্যমের উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘এক নারী বললেন, পরেরবার তুমি আমাকে খুন করবে।’ একটি গোপন বার্তায় সঙ্গীর কাছে ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর আগে তিনি এ কথা বলেছেন। এবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একটি সংবাদের উদাহরণ দেওয়া যাক। তারা লিখেছে, ‘তুনিশা শর্মার সঙ্গে শেজান খানের সঙ্গে ১৫ মিনিটের কথোপকথন চলার সময়েই তিনি আত্মহত্যা করেন।’ নিচে তাদের হোয়াটস অ্যাপ মেসেজের কথোপকথন তুলে ধরা হলো।’

সবচেয়ে বড় অস্বস্তির বিষয় হচ্ছে, খুনের ঘটনার এমন অসুস্থ বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে মৃত্যুর খবর ঘোষণার প্রাথমিক ফোরামে পরিণত করে এবং শোক জানানোর মাধ্যম হিসেবে গৃহীত হয়। পুরোনো সেই প্রবাদটিকে একটু ঘুরিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে তখন। যদি তুমি ইমোজি ছাড়া কিছু না বলতে পারো তাহলে কিছুই বলার প্রয়োজন নেই।

কেউ পুরোনো সেসব দিনের কথা বলতেই পারে—যখন সহানুভূতি জানানোর অর্থ এটা ছিল না, কিছু হলুদ মুখ কাঁদছে। মানুষের শোক এমন কোনো বস্তু ছিল না যেটা মুহূর্তেই ফেসবুক পোস্টে স্ক্রল করতে করতে জানিয়ে দিয়ে পরবর্তী বিষয়ের দিকে এগোনো যায়।

একটি ঘটনা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না। আমার এক সিনেমানির্মাতা ফেসবুক বন্ধু (যার প্রতি আমার সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে) তার আরেক বন্ধুর পরিবারের একজনের মৃত্যুতে ফেসবুকে কমেন্ট করল—সরি ফর ইউর লস (Sorry for ur loss)। আধুনিক কথোপকথন আমাদের সার্বিকতাকে খুব সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছে। এই বাক্যের ভেতরে সহজাত যে অমর্যাদা রয়েছে তা কমেন্ট করা ব্যক্তি ধরতে পারেননি এবং এমন একটি শব্দকে ছোট করে লিখেছেন যেটি এমনিতেই ছোট।

জীবন অপূরণীয় রকমের ডিজিটালাইজড হয়ে গেছে, সম্ভবত এটাও স্বাভাবিক যে মৃত্যুও এই ডিজিটালাইজেশনের বাইরে নয়।

মূল লেখা : বেলেন ফার্নান্দেজ, আলজাজিরার কলামিস্ট, স্বনামধন্য লেখক।

ভাষান্তর : সরকার জারিফ

[ নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দৈনিক কালবেলার সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, দৈনিক কালবেলা কর্তৃপক্ষের নয়। ]
কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জোড়া সেঞ্চুরিতে রেকর্ড জয় ভারতের

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রোগ্রামার শাহেদা মুস্তাফিজকে নিয়ে রাহিতুলের বই

বাপার সংবাদ সম্মেলন / ‘পরিবেশ রক্ষায় প্রতিবন্ধক আমলারা, বন্ধু হচ্ছে জনগণ’

সর্বক্ষেত্রে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করুন : সাবেক এমপি হাবিব

জুলাই ঘোষণাপত্র ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার অবৈধ : ফরহাদ মজহার

ভ্যাট-ট্যাক্স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের আহ্বান

ঢাকায় নাটোরবাসীর মিলনমেলা শুক্রবার

সোনারগাঁয়ে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের সুপারিশ সংবিধান সংস্কার কমিশনের

পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন মোখলেছুর রহমান

১০

শেখ পরিবার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ : দুদু 

১১

শীতে বাড়ছে ডায়রিয়া, ৮৫ শতাংশ রোগীই শিশু

১২

এসএমসি’র ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে লোগো উন্মোচন 

১৩

৪০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোটগ্রহণের প্রস্তাব

১৪

‘একদম চুপ, কান ফাটাইয়া ফেলমু’, অধ্যক্ষকে জামায়াত কর্মী

১৫

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন

১৬

বগুড়ায় নাশকতা মামলায় যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৭

বিয়েতে অস্বীকৃতি, বাবার গুলিতে মেয়ে নিহত

১৮

সাত কৃষককে ধরে নিয়ে গেল সন্ত্রাসীরা, মুক্তিপণ দাবি

১৯

ছাগলকাণ্ড : সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রিমান্ডে

২০
X